বনের পশুদের দেখেছেন? বাঘ সিংহ হাতি ভাল্লুক থেকে ক্ষুদ্রতম স্তন্যপায়ী প্রাণীদের দু’ চারটে ব্যতিক্রম বাদ দিলে মোটামুটি সামাজিক কাঠামোটা একই রকম। মহিলা আর সন্তানরা পুরুষের অধীনে, সেই পুরুষের অবর্তমানে আর এক পুরুষের, অন্য কোনও গোষ্ঠীপতি পুরুষের কাছে হেরে গিয়ে পলাতক মহিলা বা তাদের সন্তানদের অধিকার নতুন গোষ্ঠীপতি পুরুষের। সেই দিক থেকে পোকাদের নিয়মকানুন বড্ড আলাদা, সেখানে নারীত্বের জয়জয়কার। সে নিয়ে আর একদিন পড়া যাবে। আপাতত স্তন্যপ্যায়ীদের চরিত্র নিয়েই কথা। আরেকটা তত্ত্ব হল সৌন্দর্যের, কোনও প্রতিষ্ঠান তো সৌন্দর্যের ব্যাখ্যা করে দিয়ে যায়নি, তবুও আমাদের সাধারণ ধারণা যাকে সুন্দর বলে সেই বিচারে স্তন্যপায়ীদের মধ্যে মানুষ ছাড়া প্রায় সমস্ত ক্ষেত্রেই পুরুষরাই সুন্দর। কিন্তু মানুষের বেলায় এসে এক বিরাট তফাত, এখানে সৌন্দর্যের সাধারণ বিচারে মেয়েরা অনেক অনেক এগিয়ে, কাজেই তার অধিকার নিয়ে লড়াই সেই শুরু থেকেই জারি। অধিকারের প্রবৃত্তি একই থেকে গেছে। ছোট ছোট গোষ্ঠী শেষ হয়ে পাকাপোক্ত সামন্ততন্ত্র এসেছে, রাজা, নবাব, সুলতান, সম্রাটেরা এসেছে, নিয়ম পাল্টায় তো নিই উল্টে আরও পাকাপোক্ত হয়েছে বিজেতাদের প্রথম অধিকার হেরোদের বউ, মেয়ে। এবং তা অনায়াসে। স্বধর্মে হেরে গেলে জহরব্রত হত? শোনা যায়নি। বিধর্মীরা জিতে গেলে তখন মহিলারা জহরব্রতে যেতেন সতীত্বের প্রশ্ন নয়, প্রশ্ন ধর্মের। সাভারকর তো মারাঠা বীর শিবাজির সমালোচনা করেছেন, হেরে যাওয়া মুঘলদের স্ত্রী কন্যাদের ধর্ষণ কেন করা হল না এই প্রশ্ন তুলে, মানে মুঘলদের ধর্ষণ করেছে হেরে যাওয়া রাজা রাজড়াদের স্ত্রী কন্যাদের, শিবাজিরও করা উচিত ছিল, এটাই বক্তব্য ছিল ওনার।
হ্যাঁ, এই ধর্ষণের সঙ্গে যৌনতার সম্পর্ক নিতান্ত শারীরীক, তা জরুরিও নয়, যেটা জরুরি তা হল সাবজুগেশন, পদানত করে রাখা, তোমার স্বামী আমার সঙ্গে যুদ্ধ করতে এসেছিল, এত বড় স্পর্ধা, এবার তুমি আমার পদানত হবে, এই তো মোদ্দা কথা। অমন যে সভ্যতার পরাকাষ্ঠা ভিক্টোরিয়ান এরা, রানি ভিক্টোরিয়ার যুগ, সেখানেও ওম্যান কিলাররা সমাদৃত হতেন সর্বত্র। ওরিয়েন্টাল কালচারে তো অন্তঃপুর, জেনানা মহল, হারেমে নারীর সংখ্যা বীরত্বের পরিচায়ক হয়েছে যুগে যুগে। শিল্পবিপ্লব জন্ম দিল শ্রমিকের আর শ্রম জন্ম দিল নারী স্বাধীনতার। হ্যাঁ সেই সময় থেকেই নারী তার ডানা মেলতে শিখল, তার আত্মমর্যাদার প্রশ্ন এল সবার সামনে। এবং বামপন্থা, আরও ভালো করে বললে মার্কসিজম এই লিঙ্গবৈষম্যের জায়গাটাকে চিহ্নিত করল, ঘা দিল, এবং অন্য আরও অনেক কিছুর মতোই ইউরোপীয় উদার সমাজ এই নারী স্বাধীনতাকে গ্রহণ করল। ক্রমশ নারী যে তার শ্রমের ভূমিকাকে সামনে রেখেই এগিয়ে এসেছিল, সে তার আগল ভাঙার সাহস দেখাল, এবং বাকি পুরুষ সমাজ তাতে সায় দিল, তারাও সঙ্গী হল, বন্ধু হল। কিন্তু সারা পৃথিবীতে অসম বিকাশ, ধর্মীয় অনুশাসন, শিক্ষার প্রসার ইত্যাদি নানান বিষয় এই নারী স্বাধীনতার পরিপূর্ণ বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে, আবার কোথাও কোথাও তা নিজের তৈরি গোলকধাঁধায় হারিয়েছে। আমাদের মতো অসম সামাজিক বিকাশ আর প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের নানান নিয়মের বেড়াজালে সেই নারী স্বাধীনতা এক বিচিত্র আকার নিয়েছে। এখানে যে মহাপুরুষ বলেন নারী নরকের দ্বার, তিনি পূজিত হন, যিনি নারী সংসর্গে অধঃপতন হয় বলে মনে করেন এমনই নয় প্রচার করেন তিনি লক্ষ লক্ষ মহিলা পুরুষের গুরুদেব। যিনি আপামর বিশ্বে মানবতা আর নারীদের অধিকার নিয়ে এক আইকন হলেন তিনিই তাঁর অপ্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রীকে গর্ভবতী করেন, ১৩ বছরে ১৭ বার, মানে ছ’ মাস, সাত মাসে গর্ভপাত হওয়ার পরেই আবার গর্ভবতী হয়েছেন সেই নারী। যিনি রাতের বেলায় স্ত্রীকে ছেড়ে মুক্তির পথ খুঁজতে বেরিয়ে যাচ্ছেন তিনিও মহাপুরুষ আবার যিনি নিজের স্ত্রীর পরিচয়ই গোপন রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি দেশের আপাতত জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | চুরিবিদ্যা মহাবিদ্যা জানেন সেটা মোদিজি
এদেশে নারীর ঋতুমতী হওয়া এখনও অশুভ, অপবিত্র, তাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষেধ, দুর্গাপুজোয় দেখেছি শাশুড়ি চুল ধরে হিড়হিড় করে তাঁর বউমাকে পুজো দালান থেকে বার করে নিয়ে যাচ্ছেন, কারণ সে অপবিত্র। উপস্থিত নারীরা একটা কথাও বলেনি, বরং মেয়েটির আহাম্মকি দেখে ক্রুদ্ধ। ঋতুকাল শেষ হলেই তিনি যেতে পারেন শবরীমালা মন্দিরে, ঋতুমতী হওয়া নাকি এতটাই অপবিত্র। যে দেশের আর্থিক সংস্থার বিজ্ঞাপন বলে দেয়, পুত্রের পড়াশুনো আর কন্যার উপযুক্ত বিয়েশাদির জন্যেই তাদের স্কিম সবথেকে ভালো, যে দেশে বাইকের বিজ্ঞাপনে ম্যাচো পুরুষেরাই বাইক চালায়, পিছনে বসে থাকে চুল হাওয়ায় ওড়া নারী, এই পথ যদি না শেষ হয়, যেখানে এক পুরুষের পারফিউম কিংবা তার অন্তর্বাসের ইল্যাস্টিক দেখেই নারীরা পিপীলিকার মতো ছুটে আসে। এবং এই সব লুকিয়ে চুরিয়ে নয়, প্রকাশ্যে, সবাই জানে, সবাই দেখে, সেই তারাই এক ধর্ষণের পরে কলরব করে ওঠে, ঠিক যেন মুরগির খাঁচার থেকে একটা মুরগিকে বার করে নেওয়ার পর বাকিরা করে ওঠে, তারপর থেমে যায়, যতক্ষণ না বার একজনকে বের করা হয়। সেই একই আদিম তাড়না, আবার বলছি এর সঙ্গে যেটুকু সামান্য যৌনতা জড়িত তাকে যৌনতা বলাও অপরাধ, এ কেবল এক অধিকার বোধ, একরাশ অসম্মান, একরাশ অবহেলা আর অশ্রদ্ধা। সেই ছোট্টবেলা থেকে গড়ে উঠেছে এই সমস্ত ধারণাগুলো, রাবণ পণ্ডিত, ধার্মিক বীর ছিলেন, ওই একটা দোষ করেছিলেন বটে, কিন্তু তারও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে। পরে শিবের মুখ থেকেই এসেছে সেই কথা, ওনার দোষ সীতাহরণ নয়, তাহলে তো তা শুধুই পাপ হত, তাঁর দোষ সাধু হয়ে সীতাহরণ, এতে সাধুদের বদনাম হয়েছে, রাম কা নাম বদনাম না করো। সীতার নামে বদনাম হলে তো আছেই অগ্নিপরীক্ষা, রাম কা নাম বদনাম না করো, রাম নামছেন ফ্যাক্টরি তেল ভাসা দূষিত গঙ্গাজলে, কিন্তু ন্যারেটিভ হল রাম তেরি গঙ্গা মইলি হো গয়ি। আর এই সবের সঙ্গে মিশে গেল এক অদ্ভুত বৈষম্য, গ্রাম বোঝে না শহরের ভাষা, সিনেমা তাও নাকি মফসসলের আর শহরের আলাদা, এক অংশ ইংরিজি শিক্ষা, আধুনিক সমাজের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে গেল, অন্য এক বিরাট দল পড়ে রইল ঘেঁটু পুজো, ইতুপুজো আর নারী লোকাচারের আড়ালে। এরই মধ্যে চলে এল টিভি, ইন্টারনেট, মোবাইল, সব মিলিয়ে এক খিচুড়ি ব্যাপার। এক মেয়ের সাধারণ জীবন অন্যের কাছে ইঙ্গিতবহ হয়ে উঠেছে তা সেই মেয়ে জানলই না, যখন জানল তখন দেরি হয়ে গেছে। এক পুরুষ মোবাইলে পর্ন দেখে নিজেকে সেই নীল ছবির নায়ক হিসেবে ভাবতে শুরু করল, নারী ধর্ষণের যাবতীয় উপাদান সমাজের পরতে পরতে।
কিন্তু হঠাৎ এক ঘটনায় যখন চিৎকার হয় তখন সেই খণ্ডচিত্র নিয়েই আমরা আলোচনায় নামি। কোনও এক পণ্ডিত বলেই দেয় সাফ, ওসব উৎস, ন্যারেটিভ নিয়ে কথা বলার দিন শেষ, রেপ হয়েছে এবার ফাঁসি চাই, এর বাইরে কোনও আলোচনাই চলবে না। এবং আমরা আমাদের স্মৃতি হাটকালে দেখতে পাব যতবার এরকম ঘটনা ঘটেছে, যতবার, ততবারই আমাদের সংবাদমাধ্যম থেকে বিদগ্ধ মহল প্রায় একই আলোচনায় মত্ত হয়েছে। হাসিনা শেষ তো আরজি কর, আরজি কর শেষ হবে কোনও এক নেতার ঘরে পাওয়া ৫০ কোটি ক্যাশ গোনার মেশিন দিয়ে, তারপর আসবে তিন রাজ্যের নির্বাচন। আমাদের এই কন্যার জায়গায় অন্য কেউ তখন তৈরি হচ্ছে কোনও এক জায়গায়, বাড়িতে বলে এসেছে ফিরবে, হবু স্বামীর সঙ্গে গপ্পো করে ঘুমনোর আগেই সে ধর্ষিতা হবে, তার পেলভিক বোন ভাঙা কি না, তাঁর অবিন্যস্ত পোশাকে ক’জনের বীর্য লেগে ছিল, কবে মোমবাতি মিছিল হবে ইত্যাদি তো তার পরের ঘটনা। মূল সমস্যা অনেক গভীরে, ফাঁসি কিংবা এনকাউন্টারে তার সমাধান নয়। প্রত্যেক নারী আর পুরুষ তাদের শৈশব থেকেই যেদিন বুঝতে পারবে লিঙ্গের ভিন্নতা এক শারীরিক প্রকরণ মাত্র, তা দিয়ে বিচারের কিছুই নেই সেদিন সম্ভবত, হ্যাঁ সেদিনেও সম্ভবত ধর্ষণের বিষয়টা অকারণ মনুষ্যেতর প্রাণীর আচরণ হয়ে থেকে যাবে। সমাজের মহান লোকজনেরা, মহাপুরুষেরা, তাঁদের কর্মে, বাণীতে, উপদেশে চরম নারীবিদ্বেষী হয়ে থেকে যাবেন আর ম্যাজিকের মতো সমাজ থেকে নারীবিদ্বেষ উবে যাবে। তা হওয়ার নয়, আমাদের বাজার নারীকে পণ্য হিসেবেই ব্যবহার করবে, তার শরীরের প্রত্যেক অঙ্গ বিজ্ঞাপিত হবে বাজারের ঊর্ধ্বগতি আনতে আর ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে তা সম্ভব নয়। দেশের অশিক্ষা থাকবে, বৈষম্য থাকবে আর লিঙ্গবৈষম্য টিকটিকির ল্যাজের মতো খসে পড়বে তা কিন্তু হওয়ার নয়। আরও মনোযোগ দিয়ে এ নিয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে, ক্রমাগত কথা বলে যেতেই হবে, অন্তত শুরুয়াত তো হোক। ইতিমধ্যে প্রশাসন দায় নিক, পুলিশ তার কাজ করুক, অপরাধীরা শাস্তি পাক, অপরাধের কিনারা হোক, এসবই আপাতত খানিক তালিতাপ্পি দেওয়ার কাজ, কিন্তু সেটাও জরুরি। একাজগুলো করার সঙ্গে সঙ্গে মাথায় রাখুন মূল কাজ, যা আমাকে আপনাকে প্রতিদিন চালিয়ে যেতে হবে, প্রতিদিন বলে যেতে হবে মানুষের অধিকারের কথা, বৈষম্য মুক্ত সমাজের কথা।