একটা লোকগান, নিশ্চয়ই অনেকেই শুনেছেন— ও মানুষ, তোমার দুটো কান, দুটো চোখ, দেখবা আর শুনবা। একটা মুখ তো? কথা কম কবা। এটা বহু মানুষ মনে রাখে না, বলে, বলতেই থাকে, ফুলঝুরি ছোটায় মুখ খুললেই। সব সময় যে সমস্যা হয় তাও নয়। কিন্তু কিছু সময় তো থাকে যখন নীরবতার প্রয়োজন হয়, মুখ বন্ধ করে রাখার প্রয়োজন হয়, তখন যাঁরা বলেন, তখন যাঁরা বেফাঁস কথা বলেন, তাঁরা হলেন নির্বোধ। আজকাল যে শব্দটার প্রতিশব্দ কাঞ্চন, লাভলি, উদয়ন, বাঁকুড়ার অরূপ ইত্যাদি। তৃণমূলের কেউ ধর্ষণ করেছে? খুন করেছে? করেনি তো। কিন্তু রাজ্যের সরকারে তো তৃণমূল দল, তাদের হাতেই তো সরকার আর প্রশাসন, সেই রাজত্বে এমন ভয়ঙ্কর একটা ঘটনা ঘটলে তার দায় তো বর্তায় শাসকদলের উপরে। সেটা মাথায় থাকবে না? প্রতিটা কথা অন্যভাবে নিচ্ছে মানুষ, প্রতিটা কথায় মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়া জানাচ্ছে। তার মধ্যে তৃণমূলের কিছু নির্বোধ মুখ খুলছেন আর নর্দমার পাঁকের মতো জঘন্য কথা বের হচ্ছে। প্রথমত, এমন এক সময়ে মানুষের মাথায় আছে সেই ভয়ঙ্কর মৃত্যু, ধর্ষণ, সামনেই আছে তার বাড়ির বউ, মেয়ে, বোন দিদি, সুরক্ষার প্রশ্ন তাকে বিচলিত করছে। সেই মানুষজন এক সুষ্ঠু পুলিশি ব্যবস্থা চাইছে, চারিদিকে ভয়াবহ দুর্নীতি তাকে ভাবাচ্ছে। তেমন এক সময়ে নির্বোধের মতো কথা বলা বন্ধ করুন, এটাই বললেন তৃণমূল দলের দু’ নম্বর নেতা, সেটাই বিষয় আজকে, মুখ সামলে: অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুখ খুলেছেন কাঞ্চন মল্লিক, মুখ খুলেছেন লাভলি মৈত্র। ওদিকে বাঁকুড়ার অরূপ চক্রবর্তী আর উত্তরবঙ্গের উদয়ন গুহ তো আজকের নয়, মুখ খুললেই বিতর্ক। এই লেভেল থেকে ছড়ানো শুরু হলে তলার স্তরে গিয়ে তা কী হবে সেটা সব্বার জানা, কাজেই যা হওয়ার তাই হচ্ছে। কেবল এই ক’দিনের মধ্যে কাজের কাজ তো কিচ্ছু হয়নি, কিন্তু তৃণমূল দলের কতজন তাঁদের মুখ খোলার পরে ক্ষমা চাইলেন দেখুন। আমি ওই তলার সারির কাকে সাসপেন্ড করা হল সেসব ধরছিও না।
আরও পড়ুন: Aajke | সংবাদমাধ্যম নিজেরাই তদন্ত করছে, বিচারও করছে, শাস্তির নিদানও দিচ্ছে
প্রথমে মমতা বললেন, ফোঁস করা নিয়ে, ডাক্তারদের আন্দোলন নিয়ে। পরের দিন তিনি তার ব্যাখ্যা দিলেন, মানে সামলানোর চেষ্টা হল। পরের দিন কাকলি ঘোষ দস্তিদার কিছু বললেন, পরের দিন ক্ষমা চাইলেন। তার পরের দিনই কাঞ্চন মল্লিক আন্দোলন সম্পর্কে, ডাক্তারদের মাইনে বোনাস নিয়ে যা খুশি তাই বললেন, ঝড় উঠল সমালোচনার। নিজের বউকে দিয়ে জবাব লেখালেন, এবং শেষে ক্ষমা চাইলেন, ততক্ষণে যা হওয়ার তা হয়ে গেছে। ওদিকে লাভলি যা বলছেন তা আরও সাংঘাতিক, বলছেন বদলা হবে। কাজেই অভিষেক সামলাতে নামলেন, জানালেন জনপ্রতিনিধিরা যেন এসব কটু মন্তব্য না করেন। কিন্তু সমস্যা হল তৃণমূল দলে কি সেই কথা শোনার অভ্যেস আছে? এক অসম্ভব মুখোমুখি লড়াই করে, প্রতিদিন জান বাজি রেখে লড়াই করে তৈরি হয়েছে এই বাংলা জুড়ে তৃণমূলের র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল। কেউ মার খেয়েছেন, কারও বাবা-কাকা মার খেয়েছে, মারা গেছে, গ্রামছাড়া হয়েছে। তাদের রাজনীতিতেই এক ধরনের তিক্ততা ছিল। বিজেপি আসার পরে তা আরও তিন চারগুণ বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে, কাজেই সেই ছিলার মতো টান টান করা তৃণমূল র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল এই রাত-দখল ইত্যাদি দেখে বমকেই ছিল, তার উপর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই ফোঁস করতে বলেছেন, ব্যস। চারিদিক থেকে ফোঁস ফোঁস শব্দ আর তার থেকেও বেশি কলরব সর্বত্র, মানুষের মেজাজ আরও চড়ছে। তেমন এক সময়েই যুবরাজ হাল ধরতে নেমেছেন, সাফ জানালেন, মুখ সামলে। হ্যাঁ, ওই যে দুটো কান আর দুটো চোখে দেখবা আর শোনবা, একটাই তো মুখ, কথা কম কবা। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, এই অশান্ত সময়ে দলের লোকজনদের মুখের ভাষা সংযত করার পরামর্শ দিলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়, আপনাদের কী মনে হয় সেটা আখেরে তৃণমূলের কাজে দেবে? নাকি কথা না বলাকে মানুষ দুর্বলতা বলে মনে করবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় একটা নতুন সংস্কৃতি তৈরি করতে চাইছেন। রাজনৈতিক দলের এক কর্পোরেট কালচার, এক ধরনের ডিসিপ্লিন আর হায়ারার্কি, কতটা পারবেন? জানি না, কিন্তু এই বিষয়গুলো তৃণমূলে অজানা, বা এটাও বলা যায়, সাধারণভাবে বাংলার রাজনীতিতে যে আকচাআকচি হয়, যে ধারা মেনে রাজনীতি চলতে থাকে তার আপন পথে, অভিষেক সেখান থেকে বের হয়ে এক নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি তৈরি করতে চান। দলের ওল্ড গার্ডেরা তা মেনে নেবেন? দলের র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল সেটা মেনে নেবে? জানি না, তবে মেনে নিলে আগামী দিনে এক নতুন তৃণমূলকে দেখতে পাব আমরা, এ নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই।