বড়বাজার থেকে পোস্তা, সে তো ছিলই অবাঙালিদের এক কেন্দ্র, সিনেমা কত কথা বলে, সেই কবে জনঅরণ্য, ৭৬ সালের ছবি, রাজাকাটরা অঞ্চলে শুটিং, দোকানদারেরা সবই অবাঙালি। সেই সময়ে ব্যবসায়ী বলতে আমাদের সাহিত্য সিনেমা অবাঙালি, মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীদেরই দেখিয়েছে, ঋত্বিক, সত্যজিতের ছবিতে তাঁরা আছেন, উপন্যাসে, গল্পে তাঁরা আছেন। কিন্তু তা ছিল এক এলাকাভিত্তিক ছবি, এক শ্রেণিভিত্তিক অবস্থান। কিন্তু সেই আগল খসে গেছে কবেই, সেই অবাঙালিরা বাড়তে বাড়তে উত্তরের অর্ধেক আর দক্ষিণের ৭০ শতাংশ দখলে এনেছে, কাজেই সবকিছু পাল্টাচ্ছে। পাল্টাচ্ছে স্ট্রিট ফুড থেকে সিনেমা, ভাষা থেকে পোশাক। এক আমূল পরিবর্তন, প্যারাডাইম শিফট। আমরা প্রথমে কানই দিইনি, আমাদের রাজ্য রাজধানী থেকে অনায়াসে হিন্দি খবরের কাগজ ছাপা হয়, ডেইলি উর্দু সংবাদপত্র একটা নয় তিনখানা, এমনকী চীনে ভাষায় সংবাদপত্রও বের হয়, আমাদের আন্তর্জাতিকতাবাদের গর্ব ঝরে ঝরে পড়ছিল। আমরা দশজনে একজন অবাঙালি থাকলেও অসম্ভব ভুল ব্যাকরণ আর উচ্চারণে হলেও ইংরিজি বা হিন্দিতে কথা বলার চেষ্টা চালিয়ে গেছি। আমরা এমনকী পঁচিশে বৈশাখে ভ্যারিয়েশন আনার জন্যই হিন্দি বা ইংরিজিতে রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়ে শুনিয়েছি, মানুষ হাততালি দিলে কৃতার্থ হয়েছি। আমরা ট্যাক্সি থামলেই জিজ্ঞেস করেছি গড়িয়াহাট জায়গা কেয়া? আমরা বাংলা সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি গদার, ত্রুফো, অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান দেখেছি। সব মিলিয়ে আমাদের কাছে আমাদের বাঙালিয়ানা ছিল এক শোকেসে রাখা পুতুল যা অবরে সবরে বের করে দেখে আবার যত্ন করে রেখে দিতেন সব্বাই। আমরা পয়লা, পঁচিশে বৈশাখ, বড়জোর ২২ শ্রাবণ আর দুর্গাপুজোর দিনগুলোতে বাংলা ভাষাকে নিয়ে সেলিব্রেট করতাম, তার থেকে বেশি কিছু? এখনও নয়। কিন্তু আমাদের অজান্তেই খুব সন্তর্পণে বেড়ে উঠেছে হিন্দিভাষী এলাকা, বাড়বাড়ন্ত হয়েছে তাঁদের পছন্দের শুদ্ধ নিরামিষ আহার ব্যবস্থার, বেড়েছে তাঁদের উৎসবের বাহার এবং আমরা টের পাচ্ছি হঠাৎই বদলে গেছে চারপাশ। এমন এক সময়ে দক্ষিণ থেকে আওয়াজ এল দিস ফার অ্যান্ড নো ফার্দার, অনেক হয়েছে আর নয়, আমাদের ভাষা সংস্কৃতি বিপন্ন হতে দেব না। এম কে স্তালিন বললেন যে হিন্দি ভাষার চাপে মরে যাচ্ছে উত্তর ভারতের বেশ কিছু ভাষা। হঠাৎই আমরা টের পেয়েছি এক কায়াপলট হয়ে গেছে, বদলে গেছে ডেমোগ্রাফি, বিচ্ছিন্নভাবে হলেও তা বাঙালির বুকে বেজেছে, সেটাই আজকের বিষয়, এবারে বাঙালি জাগো।
বাংলার রাজধানীতে মেট্রোরেলের এক বুকিং ক্লার্ক অনায়াসে বলে দিচ্ছেন, হিন্দি মে বোলো, মুঝে বাংলা সমঝমে নহি আতা, নহি তো হাটো ইইয়াহা সে। কী কাণ্ড, আমরা নিজভূমে পরবাসী? আমার রাজ্যে এমনকী মেট্রোর টিকিট কাটতে হলে হিন্দি জানতে হবে? চতুর্দিকে হিন্দি। আর কেবল কি ভাষা নাকি? ভাষার হাত ধরে সংস্কৃতি, ভাষার হাত ধরে খাবার, ভাষার হাত ধরে পোশাক, সব পালটে যাচ্ছে হু হু করে।
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু অধিকারী ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে দুটো কথা
যে কোনও উৎসবে বাঙালি সুপুরুষের গাল ভর্তি দাড়ি, গোলাপি, ভায়োলেট, কমলা, সবুজ রংয়ের পাঞ্জাবি পরে ঘুরছে, এমন পোশাক এমন সাজগোজ আগে দেখেছেন কখনও? মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত পরিবারের বাচ্চারা যে স্কুলে পড়ছে তার বেশিরভাগের প্রথম ভাষা ইংরিজি, দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি, অ্যাডিশনাল লাঙ্গোয়েজ ফ্রেঞ্চ, চাইনিজ। বাংলা গায়েব। সিনেমা হলে চিকেন রোল, এগ রোল উঠে গেছে তাও বছর দশেক হল, পুরোটাই ভেজ, শুদ্ধ শাকাহারী লেখা ভোজনালয় চারিদিকে দেখতে পাবেন। চারিদিকে তাকান, হোর্ডিংয়ের বেশিরভাগ হয় ইংরিজি নয় হিন্দি আর না হলে কদর্য বাংলায় লেখা। এক বাঙালি লেখকের ৫০০ কপি বই বিক্রি হলে সেলিব্রেশন হয়। বিশাল বিশাল হাউজিং কমপ্লেক্স, গরিষ্ঠাংশ অবাঙালিদের দখলে, সাধারণ কমিটি থেকে পুজো কমিটি সবটাই তাঁদেরই দখলে, এবং স্বাভাবিকভাবেই নবরাত্রি পালন হচ্ছে। এবং এর পরে আসছে বিজেপির সেই আগ্রাসী নীতি, চাপিয়ে দেওয়া ভাষা আর জনসংখ্যার ভিত্তিতে সাংসদের সংখ্যা নির্ধারণ। চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দি, বলা শুরু হয়ে গেছে ওটাই নাকি রাষ্ট্রীয় ভাষা, বলছেন বিভিন্ন নামী দামি সেলিব্রিটিরা, বাবা-মায়েরা ভাবছেন হিন্দি পড়লে চাকরিতে সুবিধে হবে, প্রথমে ইংরিজি শেখো তারপর হিন্দি, সরকারও তাই চায়। ওদিকে গোবলয়ে হু হু করে বাড়তে থাকা জনসংখ্যার সঙ্গে সাযুজ্য রেখেই বাড়বে সাংসদ সংখ্যা। কেবল গোবলয়ের হিন্দিভাষী, হিন্দু, শাকাহারি মানুষদের ভোটেই জিতে যাবে বিজেপি, এক স্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাত। বুঝতে পেরে তামিলনাড়ুর স্তালিন হাঁক দিয়েছেন, ভাষা বাঁচান, সংস্কৃতি বাঁচান, খাদ্যাভ্যাস বাঁচান। হ্যাঁ, আমাদেরও যথেষ্ট দেরি হয়েছে কিন্তু রুখে দাঁড়াতেই হবে, এই মুহূর্তে বাঙালি গৌরবকে সামনে রেখে চাপিয়ে দেওয়া হিন্দি আর গোবলয়ের সংস্কৃতিকে প্রত্যাখ্যান করতেই হবে। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনাদের কি মনে হয় না বেশ কিছু বছর ধরে কেবল কলকাতা নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের জনসংখ্যার এক চরিত্রগত পরিবর্তন হচ্ছে, হু হু করে বাড়ছে হিন্দিভাষি এলাকা, চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দি ভাষা, সিনেমা, সংস্কৃতি? কেন এমনটা হচ্ছে বলে আপনাদের মনে হয়? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অবহেলায় বটবৃক্ষ শুকিয়ে যায়, এ তো এক সংখ্যালঘু ভাষা, এ তো এক তুলতুলে সংস্কৃতি। গত ৫০ বছরে কেবল এই কলকাতা মহানগর নয়, পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন এলাকার ডেমোগ্রাফি বদলেছে, চোখে পড়ার মতো বদলেছে, বদলেছে দোকানপাট, খাদ্যাভ্যাস থেকে বাকি অনেক কিছুই। আমরা যদি এখনও এই বিষয়টাকে গুরুত্ব না দিয়ে চুপ করে বসে থাকি, যদি এখনও মনে করি এমনিই কেটে যাবে দিন, তাহলে মাথায় রাখুন কেবল এই ভারতেই গত দেড়শো বছরে ৩৭টা ভাষা বলার একটা লোকও আর বেঁচে নেই। হ্যাঁ, যদি ভাষা মরে তাহলে তার সংস্কৃতি সমেত সেই জাতি মুছে যাবে, ভবিষ্যতে কলকাত্তা জাদুঘরের এক কোণে সাজানো থাকবে বাঙালি যুবক যুবতীর মডেল, লেখা থাকবে কিছুকাল আগে এনারাই এই অঞ্চলে বাস করিতেন, এখন উবে গেছেন।