রাষ্ট্র পরিচালনা, রাষ্ট্রের কাঠামোর মধ্যে বসে দেশ পরিচালনা ইত্যাদি হল রাজনৈতিক দলের কাজ। ভোটে দাঁড়াবে, সরকার তৈরি করবে। আর সেই রাজনৈতিক দলের একটা নির্দিষ্ট মতামত থাকে, যে কোনও বিষয়েই দলের মতামতই নেতাদের মুখে শোনা যায়, কখনও সখনও তার ব্যত্যয় হলে সংবাদমাধ্যমে হইচই হয়, একই দলের দুজন নেতা দু’রকমের কথা বলছে, কিছুদিনের মধ্যেই ওই দুই মতামতের একটাই সেই দলের মত হয়ে ওঠে। মানে রাজনৈতিক দল হল এক মনোলিথিক স্ট্রাকচার, একই কথা, একই মত, একই ভাষা, একই দৃষ্টিভঙ্গি। দলের মধ্যে নানান মত থাকতেই পারে, কিন্তু দলের মত একটাই। অন্যদিকে নাগরিক সমাজ? তার একটা নির্দিষ্ট মতামত হওয়াটা সম্ভব নয়, যে কোনও রেজিমেন্টেড স্ট্রাকচারের সঙ্গে তার বিরোধ চিরটাকালের। ঋত্বিক ঘটক, সলিল চৌধুরি, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, উৎপল দত্ত থেকে পৃথ্বীরাজ কাপুর বা বলরাজ সাহানি, কৈফি আজমি থেকে জাভেদ আখতার পর্যন্ত ইতিহাস দেখুন, বার বার সংঘাত বেঁধেছে, বার বার এনারা এক মুক্ত চিন্তার কথা বলেছেন। এবং সেই কথাবার্তায় এক ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা আছে, এক ব্যক্তির অপরিসীম স্বাধীনতার কথা আছে, যা সবসময়েই সংগঠন আর ব্যক্তির মধ্যে এক বিরাট দেওয়াল খাড়া করেছে, করে, করবেই। যা বলতে চাইছি তা হল রাজনৈতিক দলের মতো সিভিল সোসাইটির মানুষজনদের একটা বক্তব্য, একটাই মতামত থাকা সম্ভব নয়, সেটা বিভিন্ন ইস্যুতে বিভিন্ন আকার নিতেই থাকে, এ আমরা বারবার দেখেছি। কেন এই কথা উঠল? উঠল কারণ গতকাল সাংবাদিক সম্মেলন করে কিছু বুদ্ধিজীবী সিভিল সোসাইটির মানুষজন এক নতুন মঞ্চের কথা ঘোষণা করেছেন, সেটাই বিষয় আজকে, রিমঝিম অপর্ণাদের অরাজনৈতিক সংগঠন, উদ্দেশ্যটা কী?
সেই রিক্লেইম দ্য নাইটের রিমিঝিম, ওদিকে ২০১১-তে পরিবর্তনের মুখ অপর্ণা সেন, ক’দিন আগেই দেউচা পাচামির রাজ্য সরকারের তরফে কমিটিতে থাকা পরমব্রত চট্টোপাধ্যায়, এতদিন কোনও কিছুতেই না থাকা চূর্ণি গাঙ্গুলি এবং সিপিএমের সব অনুষ্ঠানে থাকা কমলেশ্বর মুখার্জি, এই বাংলায় যোগেন্দ্র যাদবের অনুগামী অভীক সাহা, প্রাক্তন তৃণমূল রাজ্যসভা সদস্য জহর সরকার ইত্যাদিরা মিলে এক মঞ্চ তৈরি করেছেন। তাঁরা নাকি রাজনৈতিক নন, তাঁরা নাকি কারও পদত্যাগ চাইবেন না, তাঁরা আরজি করের ঘটনাকে সামনে রেখে নারী সুরক্ষার কথা বলবেন, এক সিভিল সোসাইটি প্রেসার গ্রুপ হিসেবে কথা বলার জন্য এই মঞ্চ তৈরি হল।
আরও পড়ুন: Aajke | কংগ্রেস-সিপিএম কাজিয়ার সূত্রপাত হয়ে গেল এই বাংলায়
প্রথমেই জানিয়ে দেওয়া হল তাঁরা রাজনীতির মুখও নন আবার অরাজনৈতিকও নন। তাহলে আসলে তাঁরা কী? এই প্রশ্ন তো উঠবেই। ধরুন ক’দিন আগেই এই রাজ্যের দু’ নম্বর মন্ত্রীর বান্ধবীর বাড়ি থেকে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উদ্ধার হল, তাঁরা কোনও কথা বলেছেন? ধরুন এই রাজ্যেই ৫০ লক্ষ টাকা নিয়ে এক সুপারি কিলার তৃণমূলের এক কাউন্সিলরকে খুন করেছে, তাঁরা কোনও কথা বলেছেন? এই রাজ্যের বিরোধী দলনেতা সাফ বলেছেন যে তাঁরা এ রাজ্যের সংখ্যালঘুদের ভোট চান না, ওনারা ওই ৭০ শতাংশ হিন্দুদের ভোট চাইবেন। এ নিয়ে কি এই মঞ্চ কথা বলবে? বললে এই মঞ্চের সবাই কি বলবেন? তন্ময় ভট্টাচার্য, এক সিপিএম বিধায়ক একজন মহিলা সাংবাদিকের কোলে বসে পড়লেন, তিনি দলের মধ্যেই ইতিমধ্যেই দোষী সাব্যস্ত হয়েছেন, এই মঞ্চ কি তাঁকে জেলে পোরার কথা বলবে? আসলে কোনও একটা বিশেষ ইস্যুতে বুদ্ধিজীবী বা সিভিল সোসাইটির একটা জমায়েত হয়, মঞ্চ তৈরি হতেই পারে, কিন্তু তা স্থায়ী মঞ্চ হয় না। হয় না কারণ আগেই বলেছি, বুদ্ধিজীবী, গায়ক, নায়ক, শিল্পীরা নানান ক্ষেত্রে নানান অবস্থান নিয়ে থাকেন। যেমন ধরুন যখন নন্দীগ্রাম সিঙ্গুর আন্দোলন চলছিল তখন কবি সুবোধ সরকার সেই আন্দোলনের বিরোধিতা করছিলেন, অভিনেতা কৌশিক সেন ওই আন্দোলনকে সমর্থন করছিলেন। আবার গত কিছু বছর ধরে ওনাদের অবস্থান ঠিক উল্টো, ১৮০ ডিগ্রি উল্টো। এবং আমার মনে হয় এটাই স্বাভাবিক, চিন্তাশীল মানুষজনের সব বিষয়ে একটা একই রকমের মতামত সম্ভব নয়, আশা করাটাও বোকামি, কাজেই তাঁদের মঞ্চ মানে আপাতত ফুটেজ খাওয়ার একটি জায়গা ছাড়া কিছুই নয়, বা ঝেড়ে কাশুন, অভয়া মামলার রায় বের হবে, এখন নতুন মঞ্চ তৈরি করে একটু জলঘোলা করে আদতে সেই আন্দোলন চলাকালীন তৈরি হওয়া জন আবেগকে অন্য দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। জমায়েত ইত্যাদিতে সফলতা পেলে রিমঝিম সিংহ আবার তাঁর লিঙ্কডিন প্রোফাইলে আর একটা নতুন তথ্য জুড়ে দিতে পারবেন, এই তো? আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, অভয়ার রায় বের হওয়ার ঠিক আগে অপর্ণা সেন রিমঝিম সিংহ ইত্যাদিরা যে তথাকথিত অরাজনৈতিক মঞ্চ তৈরি করতে চাইছেন তার পিছনের কারণ কী?
শিল্পী বুদ্ধিজীবীরা হয়ে উঠুন মানুষের কণ্ঠস্বর, তাঁরা সোচ্চারে বলুন মানুষের কথা। কিন্তু যখনই তাঁরা এক স্থায়ী মঞ্চ তৈরি করেন, তখনই প্রশ্ন ওঠে, উঠেছে, উঠবেই যে এর পিছনের কারণটা জানানো হোক। বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পর বিরোধী মানুষজন হঠাৎ এক মঞ্চে এসে একভাবে কাজ করবেন কী ভাবে? আর এ তো পরিবেশ দূষণ বা স্বচ্ছতা অভিযান নয় যে তার সপক্ষে এক ঐক্যমত্য আগে থেকেই আছে। বহতা সমাজে, রাষ্ট্র পরিচালনার বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইস্যুতে সেই ঐক্যমত্য নেই, থাকাটা সম্ভব নয়, কাজেই সেখানে একটা মঞ্চ গড়ে তোলার পরে তার উদ্দেশ্য নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়, আমরা এরকম মঞ্চ অনেক দেখেছি কি না, ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ডরায়, সবাই জানেন।