যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আরজি করের ধর্ষণ-খুনের মামলায় সিবিআই তদন্ত নিয়ে একগুচ্ছ প্রশ্ন তুলে কলকাতা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে গিয়েছিলেন নির্যাতিতার বাবা-মা। কিন্তু নির্যাতিতার পরিবারের পিটিশন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট গুরুতর আপত্তির কথা জানিয়েছে। প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। নির্যাতিতার পরিবারের তরফে আইনজীবীরা আদালতে জানিয়েছেন, তাঁরা সঞ্জয়ের ফাঁসি চান না। সিবিআইয়ের তদন্ত প্রক্রিয়া নিয়ে ৫৫টি পয়েন্টে বিস্তর গড়বড় আছে বলেই নাকি তাঁরা হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হয়েছেন, কিন্তু সেসব শোনার পরে এ দিন নির্যাতিতার পরিবারের তরফে আইনজীবী করুণা নন্দীর উদ্দেশে সিজেআই খান্না বলেন, “আপনাদের আবেদনে এমন কিছু বিষয় রয়েছে, যা বিতর্কিত। আদালতে আজ যা-ই বলা হোক, সেটার সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে।” তিনি আরও জানান, “আদালতে পিটিশন করার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। আপনাদের পিটিশনে এমন বিষয় উল্লেখ করবেন না, যা ডিফেন্স (অভিযুক্ত পক্ষ) ব্যবহার করতে পারে।”
এরপরে সেই পিটিশন নির্যাতিতার বাবা-মায়ের তরফ থেকে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। অর্থাৎ অগ্রপশ্চাৎ না ভেবেই যেভাবে তাঁরা বিভিন্ন পয়েন্ট তুলে মাঠে নেমেছেন তা শেষ পর্যন্ত ওই দোষী সাব্যস্ত হওয়া সঞ্জয় রায়কে বেকসুর খালাসও করেই দিতে পারে। অন্যদিকে এখনও পর্যন্ত সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ এই সঞ্জয় রায়ের বিরুদ্ধে আছে বলেই সিবিআই, রাজ্য সরকার তার সর্বোচ্চ সাজার দাবি করে উচ্চ আদালতে আপিল করেছে। তাহলে বলছি কেন যে এই ধর্ষণ খুনে একমাত্র অভিযুক্ত ওই সঞ্জয় রায় বেকসুর খালাস হয়ে যেতে পারে? এরকম হয় নাকি? এই প্রশ্নই তো সব্বার মাথায় ঘুরবে। আসুন সেই প্রশ্নটাই একটু আলোচনা করা যাক। শিয়ালদহ সাবজুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে ধর্ষণ খুনে দোষী সাব্যস্ত সঞ্জয় রায় কি বেকসুর খালাস হয়ে যেতে পারে?
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | আরজি কর মামলাতে সন্দীপ ঘোষ কতটা জড়িত?
হ্যাঁ, আসুন তাহলে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা করা যাক। আলোচনার আগেই বলে দিই আমার আইনজীবী বন্ধুরা অনেকেই জানিয়েছেন, হ্যাঁ এটা সম্ভব, অন্তত বেকসুর খালাসের দাবি নিয়ে সওয়াল করার জন্য নির্যাতিতার বাবা-মায়ের তোলা ৫০-৫৫টা প্রশ্নকে সামনে রেখে এই সওয়াল করাই যায়। এবং সেই আইনজীবী বন্ধুরাই জানালেন যে এই ক’দিন আগেই নাকি এক ধর্ষণ আর খুনের মামলাতে নিম্ন আদালতে দোষী ঘোষিত হওয়ার পরে সেই আসামিকে প্রমাণের অভাবে এবং বিভিন্ন বিষয় খুঁটিয়ে দেখে আইনজীবীর সওয়ালে সন্তুষ্ট হয়েই বেকসুর খালাস করা হয়েছে। তো সেই মামলাটার বিবরণ শুনে নিন।
২০১৪ সালে মুম্বইয়ের গোরেগাঁও থেকে অন্ধ্রপ্রদেশের এক তরুণী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারকে ধর্ষণ ও খুনের অভিযোগে ফাঁসির সাজা হয়েছিল চন্দ্রভান সুদাম সনপ নামে একজনের। বম্বে হাইকোর্টও বজায় রেখেছিল নিম্ন আদালতের প্রাণদণ্ডের রায়। কিন্তু নিজেকে নির্দোষ দাবি করে সেই রায়ের বিরুদ্ধে সনপ সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিল, দীর্ঘ সময় ধরে শুনানির পরে গত মঙ্গলবার শীর্ষ আদালতের তিন বিচারপতির বেঞ্চ তাঁকে বেকসুর খালাস করে দেয়। বিচারপতি প্রশান্ত কুমার মিশ্র, বিচারপতি বি আর গভই ও বিচারপতি কে ভি বিশ্বনাথনের বেঞ্চ তাঁদের রায়ে বলেন, তিনি নিরপরাধ। তাঁকে বেকসুর ঘোষণা করা হল। এদিকে ওই রায়ের পর বিস্মিত আইনজীবী মহল। অনেকেই প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছেন তা হলে ওই ভয়াবহ ধর্ষণ–খুন কে করেছিল? সেই অপরাধী এখন কোথায়? অনেকে সমাজমাধ্যমে এমন মন্তব্যও করেছেন যে, এ দিনের রায় তো প্রমাণ করে দিচ্ছে ২৩ বছরের ওই তরুণীর সঙ্গে আসলে কিছু হয়নি! পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে যখন কোনও অপরাধ প্রমাণের জন্য নির্ভর করতে হয়, তখন তা সন্দেহাতীতভাবে কোর্টের সামনে প্রাপ্ত তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে প্রমাণ করতে হবে। ১৯৮৪–র ‘শরদ বিরধিচাঁদ সারদা বনাম স্টেট অফ মহারাষ্ট্র’ মামলায় এই বিষয়ে মানে পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণের সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা দিয়েছিল। নিম্ন আদালত সনপকে খুন ও ধর্ষণে দীর্ঘ সওয়াল–জবাবের পরে ফাঁসির সাজা দেয়। পরবর্তীতে বম্বে হাইকোর্টও তা বজায় রাখে। তারা সরকার পক্ষের পেশ করা ১৪টি পারিপার্শ্বিক তথ্যপ্রমাণকে মান্যতা দিয়ে সনপের মৃত্যুদণ্ডের বাইরে আর কোনও শাস্তি হতে পারে না বলে মন্তব্য করে। এই রায়ের বিরুদ্ধে শীর্ষ আদালতে যান সনপ। মঙ্গলবারের রায়ে সুপ্রিম কোর্টের তিন বিচারপতির বেঞ্চের বক্তব্য, এই মামলায় যা প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে তার বাইরেও অনেক তথ্য আনা হয়েছে। সেই সব তথ্যকে সামনে রেখেই সুপ্রিম কোর্ট অভিযুক্তকে বেকসুর খালাসের রায় দেয়। কাজেই সমস্ত প্রমাণ ইত্যাদিকে সামনে রেখে নিম্ন আদালতের বিচারক আরজি কর মামলাতে যে রায় দিয়েছেন সেই রায় ও তদন্ত নিয়ে তেমন কোনও প্রশ্ন তোলা গেলে সঞ্জয় রায়ও বেকসুর খালাস পেতেই পারে এবং তখন ওই ধর্ষণ আর হত্যা এক রহস্য হয়েই থেকে যাবে, বলা হবে নো ওয়ান কিলড অর রেপড অভয়া। চিফ জাস্টিস সমেত উচ্চ আদালতের বিচারপতিরা তাই আগেভাগেই জানালেন যে অভয়ার মা-বাবা তাঁদের পিটিশনে যা যা বলেছেন তা কিন্তু সঞ্জয় রায়ের আইনজীবীরা ব্যবহার করতে পারেন, করলে তা আখেরে অভিযুক্তকে সাহায্যই করবে। এবং এখানেই প্রশ্নটা এসে দাঁড়াচ্ছে তাহলে অভয়ার বাবা-মা ঠিক কী চাইছেন?