যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। সেই বুদ্ধিমান চোরেদের দলের কথা মনে পড়ল। তাদের এক দল গ্রামে ঢুকল, তারপর কারও গোয়াল থেকে বাছাই করা খান পাঁচ ছয় গরু নিয়ে গ্রামের উত্তর পানে রওনা দিল। আর একজন ওই গরুর গলায় বাঁধা ঘণ্টাগুলো নিয়ে গ্রামের দক্ষিণ পানে রওনা দিল। ঘণ্টা বাজছে ঝুম ঝুম, ততক্ষণে গ্রামের লোকজনের ঘুম ভেঙেছে, তারা শব্দ কানে পেয়েই দক্ষিণ দিকে রওনা দিল, মার মার, চোর চোর, ধর ধর। এদিকে কিছুদূর গিয়েই সেই চোর ঘণ্টা ফেলে ধাঁ। গ্রামবাসীরা পেল ঘণ্টা, ততক্ষণে গ্রামের সীমানার বাইরে গরু পাচার হয়ে গেছে, কোথায় গেছে? বীরভূম না সন্দেশখালি তা আমি জানি না। তবে এটা চোরেদের পুরনো কায়দা, হিন্দিতে বলে ধ্যান বটাও, মনোযোগ অন্যধারে করিয়ে দাও, সেই সুযোগে চোরাই মাল নিয়ে কেটে পড়ো। বাসে উঠে পকেটমার পকেটমার শুনলে আগে পকেটে হাত দিন, কারণ আপনি পকেটমার খুঁজতে ব্যস্ত, সেই সময়েই আপনার পকেটটাই হয়তো টার্গেট।
ঠিক সেইভাবেই আরজি করের অধ্যক্ষ, এখন ক্রমশই বোঝা যাচ্ছে যে তাঁর নেতৃত্বেই গড়ে উঠেছিল এক চক্র যারা বিভিন্ন দুর্নীতিতে জড়িত ছিল। কিন্তু কিছু লোকজন সম্ভবত তাদেরকে বাঁচানোর জন্যই তাদের ঘাড়ে খুন আর ধর্ষণের অভিযোগ আনার চেষ্টা করেছিল। মানে ওরাই খুনি, ওরাই ধর্ষক, তাই ওদের জেলে পোরো। এবার তদন্ত শেষ, যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ ইত্যাদি সামনে রেখে দেখা গেল ওই ধর্ষণ আর খুনে একমাত্র অভিযুক্ত কেবল ওই সঞ্জয় রায়। মামলা চলল, নিচু আদালত থেকে উঁচু আদালতে, সওয়াল জবাব, তথ্যপ্রমাণ, উকিলে উকিলে ঘমাসানের পরে আবার রায় দোষী ওই একজন সঞ্জয়, এবং সেই সময় একটা দোষও প্রমাণিত নয়, নির্দোষ এই তকমা গলায় নিয়েই জেল থেকে সসম্মানে বেরিয়ে আসত আরজি কর ধর্ষণ হত্যাকাণ্ডের মামলায় অভিযুক্ত সন্দীপ ঘোষ অ্যান্ড কোম্পানি। বেরিয়ে এসেই অনায়াসে বলত যে আমার বিরুদ্ধে কোনও প্রমাণ নেই, আমি নিষ্কলুষ। কিন্তু সেই প্ল্যানটা খাটেনি। সিবিআই সম্ভবত বুঝতে পেরেই এই মামলার সাপ্লিমেন্টারি চার্জশিট না দিয়েই আর্থিক দুর্নীতি আর বাটপাড়ির মামলাটাকেই এগিয়ে নিয়ে যেতে চান। যাঁরা এই সুযোগে সন্দীপ ঘোষের বিরোধিতার নামে আসলে তাদের সাহায্য করার প্ল্যান নিয়েছিলেন, তাঁরা খানিক ক্ষুব্ধ, তাঁরা হতাশ।
আরও পড়ুন: মধুবন্তীর সঙ্গে সাদা কালো | তিলোত্তমার বাবা-মা এবং দোষীর সাজা
আসুন ব্যাপারটাকে আরও র্যাশনালি দেখা যাক। এই আরজি কর ধর্ষণ হত্যা মামলাতে সন্দীপ ঘোষ কি অভিযুক্ত নন? আসলে উত্তর হ্যাঁ এবং না। ধর্ষণ আর হত্যা অপরাধের প্রত্যক্ষ দায় নিশ্চয়ই ওই সঞ্জয় রায়ের। সেই ধর্ষণ করেছে, খুনও করেছে। আমাদের বিচার আইন বলছে এই কাজ করার জন্য তার শাস্তি অনিবার্য। আমাদের দেশে এখনও ফাঁসি আছে, সেটাই সর্বোচ্চ। তাই কেউ ফাঁসি চাইবেন, আমাদের মতো লোকজন যাঁরা ফাঁসির বিরুদ্ধে তারা যাবজ্জীবন জেলই তো চাইব। কিন্তু ওই সন্দীপ ঘোষ? সে কীভাবে দায়ী? না সে শারীরিকভাবে এই খুন বা ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত নয়, সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ বলছে যে সে এই ধর্ষণ বা খুনের দূরতম চক্রান্তের সঙ্গেও জড়িত ছিল না। কিন্তু একবার ভেবে দেখুন আরজি করে যদি ন্যূনতম সুরক্ষার ব্যবস্থা থাকত, তাহলে ওই মাতাল লম্পট ছেলেটি মাঝরাতে ওইভাবে হাসপাতালে ঢুকে এই কাজ করে যেতে পারত? আরজি কর জুড়ে যে বিরাট দুর্নীতি নিয়ে ব্যস্ত থাকার ফলেই সেখানকার সুরক্ষার মতো জরুরি বিষয় তিনি দেখে ওঠার সুযোগই পাননি তা কি সত্যি নয়? নিশ্চয়ই তিনি ফিজিক্যালি এই ধর্ষণ বা খুন করেননি কিন্তু প্রতিষ্ঠানের মাথা হিসেবে তিনি কি এই দায় এড়াতে পারেন? আরজি কর হাসপাতালে তাঁর বিরুদ্ধে যাবতীয় দুর্নীতির জবাবদিহি তো তাঁকেই করতে হবে। এই প্রত্যেকটা কথা সঠিক।
কিন্তু সমস্যা হল আমাদের অনেকেই ব্যাপারটা হয় জেনে বা না জেনেই গুলিয়ে ফেলেছেন। যদি তিলোত্তমার ধর্ষণ আর খুন মামলাতে এই সন্দীপ ঘোষকে প্রত্যক্ষ দোষী হিসেবেই প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়, তাহলে তিনি অনায়াসে বেরিয়ে আসবেন ক্লিন চিট নিয়ে। অন্যদিকে যদি তাঁকে এই যাবতীয় দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত করা হয় তাহলে তাঁর শাস্তি অবধারিত। যাঁরা জেনে ওই সন্দীপ ঘোষকে আড়াল করার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে এমন এক অভিযোগ এনে ক্লিন চিট নিয়ে বেরিয়ে আসার সুযোগ করে দিতে চান তাঁদের বিরুদ্ধে আমার কিছু বলার নেই, কিন্তু যাঁরা চান ওই নৃশংস ধর্ষণ আর খুনের জন্য প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষ দায়ী ওই সন্দীপ ঘোষকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়ার দাবি করেন তাঁদের জানাই, রাজ্য সরকারের গড়িমসির পরে ওনাকে চার্জশিট দেওয়ার অনুমতি পেয়ে গেছে সিবিআই এবং ওনার বিরুদ্ধে যে সাক্ষ্যপ্রমাণ হাজির, তা এড়িয়ে তিনি জেল থেকে বেরিয়ে আসতে পারবেন বলে মনে হয় না। কেবল মাথায় রাখুন চোর কিন্তু উত্তর দিকে গেছে, দক্ষিণ দিকে ঢং ঢং ঘণ্টা শুনেই দক্ষিণমুখো হয়ে দৌড়বেন না।