যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। দলের সম্মেলনে নির্বাচন এড়ানোর প্রাণপণ চেষ্টার পরেও নির্বাচন হয়েছে, এবং সিপিএম উত্তর চব্বিশ পরগনা সাধারণ সম্পাদক হেরে গেছেন। এই হারটাকে আগে বুঝুন। না বুঝলে আলোচনা এগোবেই না। সেই তলা থেকে নির্বাচিত হয়ে আসা ডেলিগেটরা বিপ্লব কোন পথে, তা আটকে আছে কেন, কোন সীমান্তে, কেউ তার খোঁজ পেয়েছে নাকি, সেই বিপ্লবকে সাধারণ রামা শ্যামাদের কাছে কোন উপায়ে নিয়ে যাওয়া যাবে, ইত্যাদি বিষয়ে প্রচুর আলোচনা পরে এ রাজ্যে বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে একইভাবে লড়াই করার সিদ্ধান্তটা আবার ঝালিয়ে নেওয়ার পরে আদত যে ব্যাপারটা প্রথম থেকেই ইন্টারেস্টিং তা হল, এবার ভুলোদা কি সম্পাদক হবে? এবার মনা কাকা কি জেলা কমিটিতে যাবে? হ্যাঁ এখনও পর্যন্ত এটাই হল সিপিএমের যাবতীয়, শাখা, লোকাল, এরিয়া, জেলা, রাজ্য বা দেশ জোড়া দলের সম্মেলন যাকে ওঁরা পার্টি কংগ্রেস বলেন তার মোদ্দা ইন্টারেস্টিং বিষয়। কারণ বাকিটা না, সব্বার জানা। তাতে ভাষার ইতর বিশেষ হতেই পারে, আদতে ওই একই বক্তব্য ঘুরে ফিরে আসে। ধরুন এবারের সিপিএম আগামী পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব পড়ে টিআরপি তোলার জন্য কোনও কোনও সাংবাদিক, “সিপিএম দল তৃণমূল নিয়ে আলাদা করে ভাবতে চায়”, এমন এক তত্ত্ব বের করে হেব্বি আলোচনা চালিয়ে গেল। শেষমেশ দেখুন ওই দলিলেই সাফ লেখা আছে In West Bengal, while conducting mass struggles and movements, special attention should be paid to work among the rural poor and organizing them. The Party has to focus more on the political and ideological fight against the BJP while opposing both the TMC and the BJP.
মানে খুব সাফ, তৃণমূল এবং বিজেপি দুই দলের বিরুদ্ধেই অল আউট লড়াই লড়তে হবে, যা তাঁরা গত এক দশকের বেশি ধরে লড়ে আসছেন। কোনও আলাদা ভাবনা নেই, থাকা সম্ভব নয়, এক ফসিল দলের কাছ থেকে নতুন কোনও পথ পেতে গেলে যে প্রবল ভূমিকম্প দরকার, তা অনুপস্থিত। এবং সেই জন্যেই এসব সম্মেলনে ওই কমিটিতে কে গেল ছাড়া রোমাঞ্চকর আর কী-ই বা থাকতে পারে? সেটাই আছে আর তাই নিয়েই এখনও সংবাদমাধ্যমের খানিকটা রুচি আছে, না হলে দেখেছেন কাউকে এসইউসিআই যে এত্ত বছরের পরে সবার অলক্ষে ক’ বছর আগেই তাদের দলের ন্যাজায় কমিউনিস্ট শব্দটা জুড়েছে, তা নিয়ে আলোচনা করতে? এই তথ্য কি কেউ জানেন? কেন তাঁরা কমিউনিস্ট হলেন তাও বা কেউ জানেন? আসলে এগুলো অপ্রয়োজনীয় ইনফর্মেশন। সিপিএমের জেলা সম্মেলনের রিপোর্টিংগুলো পড়বেন, দেখবেন ওই কে হইলেন পরবর্তী সম্পাদক, সেটাই আদত ইন্টারেস্টিং নিউজ পয়েন্ট, বাকিটা কিনু গোয়ালা বা শঙ্কর মুদিও জানে, কারণ ওইখানেই ওই খবর ঠোঁঙা হয়ে যায়। ওই ৮৪-৮৫ সাল থেকে আজ অবধি সিপিএম দলের মোদ্দা কথা এবং অবস্থানে কোনও পরিবর্তন নেই, এমনকী জ্যোতি বসুর ঐতিহাসিক ভুল প্রসঙ্গেও, পার্টির সহজ বক্তব্য, ওটা ক্লোজড চ্যাপ্টার। পাশে লেখা থাকবে কমরেডস, সংসদীয় ঝোঁক বর্জন করুন। যা বুঝে নেওয়ার বুঝে নিন। তো সেই হেন দলের উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা সম্মেলনে গতবারের জেলা সম্পাদক হেরে গেছেন, এটাই হল খবর।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | লেনিন, লেলিন, লেলিল
এবারে আসুন আর একটু অন্যদিক থেকে বিষয়টাকে দেখা যাক। অন্য সব দলে তো এই লোক দেখানো নির্বাচনও নেই, বিজেপি সর্ববৃহৎ দল, সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে সর্ববৃহৎ দলে নির্বাচন হয় না, নির্বাচন হয় না তৃণমূল সমেত আরজেডি, আপ, বহুজন সমাজ পার্টি, বিজেডি, ডিএমকে বা দেশের অন্য কোনও ছোট দলে। কংগ্রেসে নির্বাচনের ঐতিহ্য ছিল, গান্ধীজির প্রার্থীর বিরুদ্ধে লড়ে জিতেছিলেন সুভাষচন্দ্র বোস, এ রাজ্যে নির্বাচন হয়েছিল মমতা না সোমেন, সেই প্রশ্নে, সে নির্বাচন নিয়ে বিস্তর অভিযোগ আছে, কংগ্রেসের নেতারাও বলেন ওটা ছিল রিগড ইলেকশন, মানে কংগ্রেসের কেবল নির্বাচন নয়, সে নির্বাচনে রিগিংও আছে। কিন্তু সিপিএম বরাবর বলেন তাঁদের প্রতিনিধিরা নির্বাচিত। তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন সবে খানিক খোলামেলা হয়েছে, গ্লাস্তনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকার আমলে। সেই সময়ে নাকি গর্বাচভ বাজারে গিয়েছিলেন তরমুজ কিনতে, তো এক দোকানদার তাঁকে দেখেই বলেন কমরেড গর্বাচভ, আপনি আপনার পছন্দমতো তরমুজ বেছে নিন, গর্বাচভ অবাক, আছে তো একটাই তরমুজ, বাছব কী ভাবে? পদ্ধতিটা কী? তো দোকানদার সহজ উপায়টা বলে দিয়েছিলেন, আমরা যেভাবে রাষ্ট্রপতিকে বাছি, সেভাবেই বেছে নিন। হ্যাঁ, রাষ্ট্রপতি পদে একজনই থাকতেন, তবুও নাকি নির্বাচন হত। একবার তো কোনও এক অঞ্চলে কমরেড স্তালিন ১১৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, তো পরে এক ব্যাখ্যাও এসেছিল, পাশের অঞ্চলের মানুষেরা কমরেড স্তালিনকে এত পছন্দ করতেন যে তাঁরাও নাকি এই অঞ্চলেও ভোট দিয়ে গেছেন, খ্যাতির বিড়ম্বনা।
এটাই সিপিএম কেন, প্রত্যেক কমিউনিস্ট দলের সম্মেলনের নির্বাচন পদ্ধতি, এক প্যানেল আসে, ৪৫/৬০/৭০/৮০ জনের। সব গোষ্ঠীর থেকে লোকজন নিয়ে, আলাপ আলোচনা করে, তারপর সেই প্যানেল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পাশ হয়ে যায়, ইহাই সিপিএমের গণতন্ত্র। কিন্তু এবারে সে গণতন্ত্রের নতুন চেহারা। কিন্তু এখানেও কহানি মে টুইস্ট হ্যায়। একবারও ভাববেন না যে সম্মেলনে জেলা সম্পাদক নির্বাচিত হন, নির্বাচিত হয় জেলা কমিটি। তো উত্তর চব্বিশ পরগনার জেলা কমিটিতে ৭৪ জনের ঠাঁই হয়, সেই মতো ৭৪ জনের এক অফিসিয়াল প্যানেল, মানে ওই যে বোঝাবুঝির ভিত্তিতে এক লিস্ট যার সম্মতিকে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বলা হয়, সেই ৭৪ জনের প্যানেল আসতেই ২৭ জন আরও জানালেন যে আম্মো থাকব, বাকি সব জেলায় বাবা বাছা করে গণতন্ত্র বজায় রাখা গেছে, এ জেলাতে তাও হল না এবং নির্বাচন হল, তাতে গতবারের বিদায়ী সম্পাদক ওই ৭৪ জনের তালিকাতেও থাকতে পারলেন না। গণতন্ত্রের কী মহিমা! উত্তর ২৪ পরগনার মতো এক জেলার দু’ দুবারের জেলা সম্পাদক ভোটাভুটিতে জেলার ৭৪ জন নেতার লিস্টের মধ্যেই থাকতে পারলেন না। নাম ছাপানো যাবে না এই শর্তে এক একদা যুব নেতা জানালেন আসলে প্রতিটা জেলার মাথায় বসানো হয় এক বিশেষ লবির প্রতিনিধিকে, নির্বাচন যদি সত্যিই সব জেলাতেই হয়, ৭০ শতাংশ জেলার সম্পাদকেরা হেরে যাবেন। কিন্তু উনি উচ্চঘর, কংসরাজার বংশধর, মানে বলতে চাইছিলাম এরপরেও বলতেই হবে যে সিপিএমে গণতন্ত্র আছে।