যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। ৫ জন প্রসূতির সিজার অপারেশন, একজনের মৃত্যু, ২ জনের যমে মানুষে চলতে থাকা লড়াই আর একজনের একটু একটু করে সুস্থ হয়ে ওঠার ঘটনা বহু জরুরি প্রশ্নকে সামনে এনে দাঁড় করিয়েছে। হ্যাঁ, দুর্ঘটনা ঘটলে, মানুষ মারা গেলে, বিষ মদেই হোক বা রোড অ্যাকসিডেন্টেই হোক বা হাসপাতালে ধর্ষিতা হয়ে বা ভুল চিকিৎসায়, পরিকাঠামোর অভাবে, জাল ওষুধের ফলে মারা গেলে হই চই হয়, কিন্তু ঘটনা ঘটলে আমাদের কাছে কিছু তথ্য এসে হাজির হয়, বুঝতে পারি আমরা কতটা অসহায়। ঠিক কতটা খারাপ অবস্থায় আছি আমরা?
মেদিনীপুর মেডিক্যাল কলেজের এই প্রসূতি মৃত্যু সেই ছবিটা আমাদের সামনে তুলে ধরল আর একবার। পাঁচজন প্রসূতির সিজার হয়েছিল, সময়টা মোটামুটি রাত ১১টা থেকে ভোর সাড়ে ছটা। আর এই সাত আটঘন্টা ধরে হিউম্যান এররের ছড়াছড়ি। সিজার করা হবে মানে গোদা বাংলায় পেট কাটা হবে, সজ্ঞানে তো নয়, অজ্ঞান করে সেই অপারেশন করা হবে, সিনিয়র অ্যানেস্থেটিস্ট নেই, গর হাজির। পিজিটি ফার্স্ট ইয়ারের একজন সেই কাজ করতে এলেন, উপস্থিত নার্সরা জানাচ্ছেন, শিরদাঁড়াতে সেই ইনজেকশন দিতে গিতে তিনবার সূচ ফোটাতে হল, সেই অনভিজ্ঞতার জন্য সেই রোগীকে কতটা মূল্য দিতে হল? এরপর জানা যাচ্ছে এই ধরনের একটা সিজার অপারেশনে সময় লাগে ৪৫-৫০ মিনিট, এখানে দেড় ঘন্টা সময় লেগেছে, মানে সেই রোগীর ইন্টারনাল মাসল, ভেতরের মাংসপেশী থেকে শুরু করে বিভিন্ন অর্গান উন্মুক্ত ছিল নির্ধারিত সময়ের চেয়ে অনেক বেশি, সেই সময়ে কতটা ইনফেকশন হয়েছে? কতটা সংক্রমণ হতে পারে? একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার বলছেন, মারা যাওয়া জন্য যথেষ্ট। সিনিয়র ডাক্তারেরা একজনও ছিলেন না, অথচ নির্দেশিকা বলছে একজন সিনিয়র ডাক্তারের দেখরেখেই এই ধরনের অপারেশন করতে হবে। ওই জুনিয়র ডাক্তারদের আর উপস্থিত নার্সদের ব্যান থেকে জানা যাচ্ছে যে দুটো অপারেশন নাকি সমান্তরাল ভাবে করেছে এই টিম, অথচ স্ট্রিক্ট প্রোটোকল আছে প্রতিটি অপারেশনের সময়ে ডাক্তারবাবু, বা পুরো টিমকে স্যানিটাইজ করতে হবে, আলাদা গাউন পরতে হবে, আলাদা গ্লাভস ব্যবহার করতে হবে, দুটো অপারেশন একসঙ্গে চলতে থাকলে আর দুটোর টিমই যদি একই হয়, তাহলে সেটা নিশ্চয় মেনে চলা হয় নি। সবচেয়ে বড় কথা হল এই ধরনের ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে এই টিমের পক্ষ থেকে লিখিত ভাবে যা জানানো হয়েছে, তাতেও বিস্তর গরমিল। তাই বলছিলাম কিছু রোগীর মৃত্যু হবেই, কারণ তা আন আভয়ডেবল, সেসব মৃত্যুকে এড়ানো কঠিন, কোনও কোনও ক্ষেত্রে অসম্ভব, কিন্তু সেই মৃত্যু যদি হিউম্যান এররের ফলে হয়, ডাক্তারবাবুদের ভুলে হয়, তাঁদের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার ফলে হয়, তাহলে সেই দায় কাউকে না কাউকে তো নিতেই হবে, শাস্তি তো পেতেই হবে।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | চল রাস্তায় সাজি ট্রামলাইন
প্রায় সরকার পক্ষের কথাই বললাম। কিন্তু যা বললাম তাতে তথ্য আছে, যথেষ্ট যুক্তি আছে। কিন্তু এবারে আর একটু খতিয়ে দেখা যাক, একটু অন্যদিক থেকে। পরিসংখ্যান বলছে, সারা দেশে শিশু জন্মের ২০-২২ শতাংশ সিজারিয়ান বেবি, মানে পেট কেটে বাচ্চা বার করতে হয়। যদি প্রাইভেট নার্সিং হোম আর হাসপাতালের হিসেব বাদ দেওয়া হয় তাহলে তা কমবেশি ১৫ শতাংশ। কিন্তু আমাদের স্বাস্থ্যসচিবই জানাচ্ছেন আমাদের রাজ্যে আপাতত এই হার ৪৪ শতাংশ, হ্যাঁ ঠিকই শুনেছেন ৪৪ শতাংশ। ইন ফ্যাক্ট দেশের মধ্যে সবথেকে বেশি। জাতীয় গড় থেকে এত বেশি কেন? এতটা ফারাক হলে তা তো এক বিরাট গবেষণার বিষয়, এতটা ফারাক জেনেটিক গঠনের, খাদ্যাভাসের, জীবন যাপনের এক বিরাট ফারাককে চিহ্নিত করে, কিন্তু তা তো সত্যি নয়। তাহলে? আর একটা সম্ভাবনার কথা আমার এক ডাক্তার বন্ধু জানালেন, নর্মাল বেবির জন্ম দেওয়ার ওপরে সারাক্ষণ একটা নজরদারি রাখতে হয়, তাকে ওই অক্সিটোসিন দিতে হয়, ইউটেরাস কনট্রাকশনের জন্য, তারপর নজর রাখতে হয়, আর পালটা ব্যবস্থা হল এত সময়সাপেক্ষ ব্যাপারে না গিয়ে সিজার করে ফেলা। প্রাইভেট হাসপাতালে কিছু চাহিদা থাকে, ডাক্তারবাবু অত কষ্ট সহ্য করতে পারবে না, আপনি সিজার করে দিন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে? সেখানে তো একটা নির্দিষ্ট প্যারামিটার নিশ্চই থাকবে, এই এই সিমটম হলে নর্মাল ডেলিভারির আগেই সিজার অপারেশন করতে হবে। তো মেদিনীপুরে যে পাঁচ জনের সিজার অপারেশন হল সেখানে কি এরকম কোনও হিস্ট্রি পাওয়া যাচ্ছে? এমারজেন্সি নোট কোথায়? কেন করা হল সিজার?
এইখানে বলে রাখি ওয়ার্লড হেলথ অর্গানাইজেশনের মতে ১০-১৫ শতাংশের বেশি সিজার হওয়া উচিত নয়। কিন্তু মেদিনীপুরে তড়িঘড়ি সিজার করার কারণ কী ছিল? জানা নেই। যেমন জানা নেই যে ওই আরএল স্যালাইন নিয়ে বহু প্রশ্ন ওঠার পরেও সার্কুলার দিয়ে তা আগেই বন্ধ করা হল না কেন? জানা নেই যে এই সমস্ত ওষুধ স্যালাইন ইত্যাদি পরীক্ষা করে দেখার যে সরকারি বিভাগ সেখানে ৯৯ শতাংশ পদ কেন খালি পড়ে আছে? জানা নেই কেন এই দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর পরেই সরকারের টনক নড়ল এবং এই লম্বা লিস্টের ওষুধ ইত্যাদিকে অবাঞ্ছিত, ব্যানড ঘোষণা করা হল? কাজেই হিউম্যান এরর খুঁজে বার করতেই হবে, দোষীদের শাস্তি দিতেই হবে, কিন্তু এই মৃত্যুর জন্য পরিকাঠামোকে ঢেলে সাজানোর প্রয়োজনও বুঝতে হবে, স্বাস্থ্য বিভাগের খালিপদ খুব তাড়াতাড়ি ভর্তি করতে হবে।