উপ রাষ্ট্রপতি পদে রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড়কে কি সমর্থন দিতে চলেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? রাজ্য ও জাতীয় রাজনীতিতে এটাই এখন লাখ টাকার প্রশ্ন। যদিও তৃণমূল কংগ্রেসের তরফ থেকে এখনও পর্যন্ত কোনও ইঙ্গিতই ভেসে আসেনি। দলের শীর্ষস্তর থেকে সকলকে নির্দেশ দিয়ে দেওয়া হয়েছে, এ ব্যাপারে আগামী ২১ জুলাইয়ের আগে কেউ যেন কোনও মন্তব্য না করেন। শহীদ দিবসের দিন বিকেলে কালীঘাটে তৃণমূল নেতৃত্বের বৈঠকের পরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ততদিন পর্যন্ত তৃণমূলের কৌশল অজ্ঞাতবাসেই থাকবে বলে মনে করা হচ্ছে। এই অনুমানের কারণ, রবিবার উপ রাষ্ট্রপতি পদে বিরোধী দলগুলি প্রার্থী দেবে কি না, তা নিয়ে ডাকা বৈঠকে থাকছে না তৃণমূল কংগ্রেস। এনসিপি সুপ্রিমো শারদ পাওয়ারের বাড়িতে অ-বিজেপি মনস্ক বিরোধী দলগুলি এদিন বিকেলে বসবে।
যদিও এই ফাঁকেই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদজ্ঞাপক ধনখড়ের এক টুইটের উত্তরে তৃণমূল সাংসদ দেব তাঁকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। উপ রাষ্ট্রপতি পদে তাঁর সাফল্য কামনাও করেছেন তিনি। এতেই ধনখড়কে নিয়ে তৃণমূলের অবস্থান কী হতে চলেছ, তা নিয়ে জোর চর্চা শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
জগদীপ ধনখড় পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদে দায়িত্ব নেন ২০১৯ সালের জুলাইয়ে। প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তথা আইনজ্ঞ ধনখড় রাজভবনে ঢোকার পর থেকে প্রায় রোজ দায়িত্বের সঙ্গে কখনও রাজ্য সরকার, কখনও রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা, কখনও সরাসরি মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সংঘাতে নেমেছেন। কথায় কথায় সরকারের শীর্ষ আমলাদের, এমনকী মমতাকেও রাজভবনে তলব করতে পিছপা হননি। বিভিন্ন বিল নিয়ে তাঁর সঙ্গে রাজ্যের বিরোধ বেধেছে। বিধানসভায় রাজ্যপালের লিখিত ভাষণ নিয়ে ধনখড় আপত্তি তুলেছেন। শাসকদলের নেতারা এমনকী মুখ্যমন্ত্রীও বিভিন্ন সময় তাঁকে বিজেপির হয়ে কাজ করার অভিযোগে বিদ্ধ করেছেন।
এহেন তিক্ত সম্পর্কের রাজ্যপাল ধনখড়কে উপ রাষ্ট্রপতি পদে বিজেপি প্রার্থী করার পরেই অনেকে আশা করেছিলেন তৃণমূল কংগ্রেস প্রথম চোটেই না করে দেবে। কিন্তু, উলটে নয়াদিল্লিতে পাওয়ারের বাড়িতে ডাকা বৈঠকে তৃণমূলের গরহাজিরা ধোঁয়াশা বাড়িয়ে তুলেছে। বিশেষত, ১৮ জুলাই হতে চলা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে মমতারই উদ্যোগে ১৭টি বিরোধী দল মিলে যশবন্ত সিনহাকে প্রার্থী করে। তারপর ধনখড়কে উপ রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী করে মোদি তাঁকে ‘পুরস্কৃত’ করার পর মমতার দলের এই নীরবতা সাধারণ মানুষের মধ্যে গুঞ্জন সৃষ্টি করেছে। বিশেষত, কয়েকদিন আগেই দার্জিলিং সফরে মমতা-ধনখড়ের ৩ ঘণ্টার চা-পান বৈঠকের কারণে জনমানসে কানাকানি শুরু হয়ে গিয়েছে।
সকলে জানতে চাইছেন, তাহলে কি মমতা উপ রাষ্ট্রপতি পদে ধনখড়কে মেনে নিতে চলেছেন? যদি তাই হয়, তাহলে কেন? মমতা কি অন্য বিরোধী দলগুলির স্পষ্ট অবস্থান জেনে, তারপর সিদ্ধান্ত নেবেন? কারণ, সংসদের বাদল অধিবেশন শুরু হওয়ার মুখে। এই অবস্থায় বিরোধী দলগুলির সম্মিলিত কৌশল নিয়েও আলোচনা হওয়া দরকার। সেখানে তৃণমূল সাংসদরা কী ভূমিকায় নামবেন, তাও স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। এই অবস্থায় ধনখড়ের মতো প্রার্থীকে নিয়ে তৃণমূলের মৌণব্রত বুঝতে পারছে না সমমনোভাবাপন্ন দলগুলি।
কিন্তু, তৃণমূলের এই কৌশলের পিছনে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চাল রয়েছে। প্রথম হল, মমতা চাইছেন, বিরোধী দলগুলি তাঁর অনুপস্থিতিতে কাকে প্রার্থী করে, তা বুঝে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, তারা যদি সর্বসম্মত প্রার্থী দেয়, তবে তাঁকে সমর্থন দিলে বা না-দিলে তৃণমূলের কী ফায়দা! তৃতীয়ত, ধনখড় উপ রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ায় সাত তাড়াতাড়ি তাঁকে রাজ্যপাল পদ থেকে এখনই ইস্তফা দিতে হবে। অতএব ধনখড়কে নিয়ে আপাতত তৃণমূল রাতে শান্তিতে ঘুমোতে জেতে পারবে। সে কারণে এই মুহূর্তে তাঁকে নিয়ে আর মাথাব্যথার কারণ নেই। এমনকী ধনখড় যদি নির্বাচনে জিততে নাও পারেন, তাহলে সম্মানের প্রশ্নে তিনি অন্তত আর পশ্চিমবঙ্গের রাজভবনে ফিরছেন না, এটা মোটামুটি হলফ করেই বলা যায়। সব মিলিয়ে জগদীপ ধনখড়ের উপ রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হওয়া নিয়ে রাজ্য বিজেপি যতটা মনোবেদনায় রয়েছে, মমতা ততটাই আনন্দিত ও নিশ্চিন্ত হয়েছেন।
রাষ্ট্রপতি পদে বিজেপিকে রুখতে তাদের দলেরই প্রাক্তন সেনানীকে প্রার্থী করান তৃণমূল নেত্রী। পাশে দাঁড় করান কংগ্রেস-বাম সহ অ-বিজেপি দলগুলিকে। কিন্তু, এবার তাঁর রাজ্যের রাজ্যপালই দেশের উপ রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন, এই গৌরবটা কি ছাড়তে পারবেন তৃণমূল নেত্রী! বিশেষত কথায় কথায় ‘ব্যথিত ও অপমানিত’ হওয়া ব্যক্তিটাই যখন আর রাজভবনে থাকবেন না। রথ দেখা আর কলা বেচার— দুটো লাভই বোধহয় ছাড়তে নারাজ তৃণমূল।