গ্রাম বাংলার দূর্গা পুজো বীরভূম: শহরের কোলাহল নেই, মেই গাড়ির ধুলো ধোঁয়া। শহুরে জাঁকজমক ছাড়াই সুরুলের জমিদার বাড়িতে (Surul Sarkar Jamidar Bari) নিরিবিলি পরিবেশে পুরনো রীতি মেনে আজও চলে উমা আরাধনা। শামিল হন বহু মানুষ। বর্তমানে ঝাঁ চকচকে পুজোর মাঝে এই পুজো যেন এক অন্যরকম অনুভূতি।
ময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক কিছু বদলালেও সাবেকি পুজোর গন্ধ আজও এতটুকুও ম্লান হয়নি। দীর্ঘ ২৮৯ বছর ধরে একইভাবে পুজিতা হচ্ছেন দেবী। বাড়ির পারপাশে রয়েছে বনেদী আনার গন্ধ। পাঁচ খিলানের ঠাকুরদালান, সামনে থামযুক্ত নাটমন্দির, নানারঙের কাঁচের ফানুস আর বেলজিয়াম কাঁচের ঝাড়বাতি মনে করিয়ে দেয় সাবেকি ঐতিহ্য আর রাজকীয় জৌলুসের কথা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাম বাংলার বহু পুজোকে আধুনিকতা গ্রাস করলেও বীরভূম সুরুলের সরকার বাড়ির পুজোর পরিবর্তন হয়নি। আজও পুজোয় মিশে মাটির গন্ধ, শিকড়ের টান আর আভিজাত্য। এখনও ডাকের সাজে সাজানো হয় সাবেকি প্রতিমা। পরানো হয় সোনা ও রূপোর গয়না। প্রতিমার রঙ তপ্তকাঞ্চন। চালচিত্রে আঁকা থাকে শিব ও দুর্গার বিয়ের দৃশ্য। প্রতিমার সাবেকি রূপটি আজও অপরিবর্তিত রয়েছে। দেশ-বিদেশের ছড়িয়ে থাকা সরকার বাড়ির সদস্যরা প্রতি বছর এই পুজোয় মিলিত হন ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি বর্ধমানের নীলপুরের ঘোষবাড়ির ছেলে ভরতচন্দ্র সস্ত্রীক চলে আসেন সুরুলে। তাঁর গুরু বাসুদেব ভট্টাচার্যের বাড়িতে। সুরুল ছিল বৈষ্ণব ধর্মগুরুর শ্রীপাট। ভরতচন্দ্র গুরুদেবের শ্রীপাট ছেড়ে আর ফিরে যাননি বর্ধমানে। তাঁর পুত্র কৃষ্ণহরি ও তাঁর ছেলেরা সেই সময় ফরাসি ও ইংরেজ কুঠিয়ালদের সঙ্গে ব্যবসা করে পরিবারের শ্রীবৃদ্ধি করেন। বহু জমিদারবাড়ির পুজোর ঠাটবাট আজ ফিকে! ব্যতিক্রম সুরুল সরকার বাড়ি। অর্থ বা পারিবারিক সমস্যা কোনও দিন পুজোয় অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়নি।
আরও পড়ুন: চন্দননগরের বসু বাড়ির দুর্গাপুজো, ৫১৬ বছরের পুরনো
জমিদার বাড়ির দুর্গাপুজোতে প্রাচীন প্রথা অনুযায়ী, শোভাযাত্রা হয় দর্শনীয়। দিঘিতে স্নান করিয়ে সাবেকি পালকি করে নবপত্রিকা মন্ডপে নিয়ে আসা হয়। সানাই, কাঁসর, ঢোল বাজিয়ে শোভাযাত্রা হয়।
বাড়ির সদস্যদের কথায়, এখনও সপ্তমীর সকালে পালকি, নহবত আর জমিদারী মাধুর্য্যে ঘট ভরতে যায় সুরুলের দুই তরফের পুজো উদ্যোক্তারা। ফিরে এসে নাড়ুর হরিলুঠ করেন বাড়ির এয়োস্ত্রীরা। তখন নিচে আঁচল পেতে দাঁড়ান এলাকার মায়েরা। আনন্দ মেতে ওঠেন সকলে। প্রথা অনুযায়ী, তিনদিন বলি হয়। অষ্টমীর দিন ছাগ বলি , নবমী দিন আখ , সপ্তমীতে চাল কুমড়ো বলি হয় । দশমীর দিন সকালে ঘট বিসর্জনের পরে পরিবারের সদস্যেরা নারায়ণ মন্দিরে মিলিত হন। আজও সেখানে শাঁখ বাজিয়ে শঙ্খ চিলের আহ্বান করা হয়। তার পর বিসর্জন দেওয়া হয় প্রতিমা। এখানে কোন অন্য ভোগ হয় না।
কাছারি বাড়িতে রন্ধন শালায় ভিয়েন বসে, মিষ্টান্ন ভোগ হয়। দশজন কারিগর থাকেন। পুজো চারদিন মেলা অন্যতম আকর্ষণীয়। হাজার হাজার মানুষ আসেন। দুর্গাপুজোর চারটি দিনের জন্য আমরা সারাবছর অপেক্ষা করি থাকি। কারণ, কর্মসূত্রে সুরুল জমিদার বাড়ির অনেকে দেশ ও দেশের বাইরে থাকেন। পুজো চারদিন একসঙ্গে মিলিত হয়ে সকলে খুব আনন্দ করি, জানালেন সুরুল জমিদার বাড়ির মেয়ে কল্যানী সরকার।
বিগত প্রায় ৩০০ বছর ধরে সরুন জমিদার সরকার বাড়ির দুর্গা প্রতিমা একই রকম সাবেকিয়ানা ভাবে চলে আসছে। মূর্তির কোন পরিবর্তন হয় না। বীরভূমের খয়রাশলের বাসিন্দা গোবিন্দ প্রসাদ সূত্রধর, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সুভাষ সূত্রধর এই তিন পুরুষের হাত ধরে একইভাবে একই রকম মা দুর্গার মূর্তি করে আসছে। প্রতিমার কোন ছাঁচ হয় না। হাতেই নির্মাণ করা হয়। রংয়ের কোনও পরিবর্তন থাকে না। ডাকের সাজে সাজানো হয় দেবী দুর্গাকে। কারণ, মা তো মা ই হয়। মা কখনো পরিবর্তন হয় না। বহু পুজো মণ্ডপে মা দুর্গা সেজে ওঠে কখনো চালের কখনো আবার ডালের। বিভিন্ন রূপে ধরা দেয় মা দুর্গা। তবে সুরুল জমিদার বাড়িতে সেটা হয় না। জানালেন মৃৎশিল্পী সুভাষ সূত্রধর।