জয়জ্যোতি ঘোষ
১৯৮৭ সালে ভারত সফরে আসে বিশ্বত্রাস ওয়েস্ট ইন্ডিজ (West Indies) ক্রিকেট (Cricket) দল। সেই দলের অধিনায়ক আইজ্যাক ভিভিয়ান আলেকজান্ডার রিচার্ডস। তখনও নাইট উপাধিতে ভূষিত হয়ে “স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস” হননি তিনি। তখন শুধুই ভিভিয়ান রিচার্ডস, ক্রিকেট দুনিয়ায় পরিচিত ভিভ নামে।ভিভ তখন সারা বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান, বিপক্ষের বোলারদের ত্রাস।ভিভ কে সামলাতে ভারতীয় বোলারদের রাতের ঘুম উড়ে গেল।অনেক পরে যখন সচিন তেন্ডুলকাররের সঙ্গে তুলনা হচ্ছে ভিভ রিচার্ডসের (Viv Richards) তখন ইমরান খান বলেছিলেন- সচিন নিঃসন্দেহে বিরাট ব্যাটসম্যান কিন্তু ভিভকে বল করার সময় বোলারদের বুকের মধ্যে যে থরথরানি হত তা সচিনের ক্ষেত্রে হয়না। পেলে যেমন ফুটবল সম্রাট, মারাদোনা যেমন ফুটবলের রাজপুত্র তেমনই ভিভ রিচার্ডস হলেন ক্রিকেটের রাজা- কিং রিচার্ডস।
ভিভের বাড়ি ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের একটি দ্বীপে, নাম অ্যান্টিগুয়া। বাড়ির সামনে সোনালি সমুদ্রতট, অজস্র নারকেল গাছের সারি,সেখান দিয়ে বয়ে চলেছে ক্যারিবিয়ান সাগর। বাবা ম্যালকম রিচার্ডস ছিলেন একজন ফাস্ট বোলার।শৈশবে বাবার সঙ্গে ক্রিকেট খেলতেন, নৌকা করে ভেসে পড়তেন উত্তাল সমুদ্রে।মাছ ধরে ফিরে আসার সময় বাপ-ব্যাটা মিলে গাইতেন ক্যালিপসো।
আরও পড়ুন: বিনেশের রুপো নিয়ে ‘দুঃসংবাদ’ দিলেন অলিম্পিক কমিটির প্রধান
শৈশবের সেই সহজ সরল শিশুটি কিন্তু হারিয়ে যায়নি,আজীবন সেই সরল শিশুটিকে লালন করেছেন ভিভ। নীনার (Neena Gupta) সঙ্গে যখন এক পার্টিতে আলাপ হল ভিভের তখন অ্যান্টিগুয়ায় তার প্রাসাদোপম অট্টালিকা। বাবা মারা গেছেন, রয়েছেন বৃদ্ধা মা, স্ত্রী মারিয়ম এবং দুই শিশুপুত্র।
নীনা বলছেন – আমাদের মুম্বাইয়ের হিরোদের দেখি দুটো ছবি হিট করলেই যেন মাটিতে পা পড়ে না।অথচ এই বিশ্ববিখ্যাত মানুষটির মধ্যে এতটুকু ইগো নেই।একটুও টেবিল ম্যানার্স মানেন না।কাঁটা চামচ সরিয়ে রেখে সাধারণ মানুষের মত হাত দিয়ে খান,খেতে খেতে দেদার কথা বলেন, শব্দ করে কফি খান, কে কী ভাবলো না ভাবলো পাত্তাই দেন না এবং সমানে এর ওর পিছনে লাগেন, লেগপুল করেন, মজা করেন,সারাক্ষণ শুধু হাসেন,হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়েন।মনে হল ওনার জগৎ জোড়া খ্যাতি ও বিপুল অর্থ ওনার সারল্যকে বিনষ্ট করতে পারেনি।ইমরান খান বা সুনীল গাভাসকরের মধ্যে যে আভিজাত্য রয়েছে তার কানাকড়িও নেই এই মানুষটির মধ্যে, যেটা আছে সেটা হল অকৃত্রিম সারল্য।
নীনা প্রেমে পড়লেন ভিভের।নীনার আর দোষ কী,আমরা সবাই তখন ভিভের প্রেমে পাগল।নীনার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়তে লাগলো, বিভিন্ন পার্টিতে দেখা যেতে লাগলো দুজনকে।এরই মধ্যে কোনো একটি অভিজাত পার্টিতে ভিভকে সঙ্গে আনার জন্য ঢুকতে দেওয়া হল না নীনাকে কারণ সেই অভিজাত পার্টিতে কোনো কালো মানুষের প্রবেশাধিকার নেই।
তিন মাস পরে দেশে ফিরে গেলো ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট দল। একদিন নিজের শরীরে অন্য একটি প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করলেন নীনা। হ্যাঁ নীনা সন্তান-সম্ভবা যে সন্তানের জনক ভিভিয়ান রিচার্ডস।ভিভ কিন্তু অস্বীকার করলেন সন্তানের পিতৃত্ব।বললেন – নীনা তার ভালো বন্ধু, ব্যস…সন্তানের জন্মদাতা তিনি নন।
ভিভ রিচার্ডস এর সঙ্গে লড়াই করার ক্ষমতা নীনা গুপ্তার নেই। অতএব একা একা কাঁদা ছাড়া নীনার আর কিইবা করার আছে! অসহায় নীনার কাছে ছুটে এলেন তার চার বন্ধু। ওম পুরী,নাসিরুদ্দিন শাহ,শাবানা আজমি এবং সতীশ কৌশিক।এদের মধ্যে সতীশ কৌশিক তখন অবিবাহিত। সতীশ কৌশিক নীনাকে কথা দিলেন, ভিভকে তাঁরা সবাই মিলে বোঝাবেন। যদি একান্তই রাজি না হন ভিভ তাহলে সতীশ বিয়ে করবেন নীনাকে।সন্তানের দায়িত্ব নেবেন।নীনার সন্তান বড় হবে তাঁর পরিচয়ে।
মনে রাখতে হবে সময়টা ১৯৮৭ সাল। অবশেষে বহু টালবাহানার পরে সন্তানের পিতৃত্ব স্বীকার করে নিলেন ভিভ।নীনা জন্ম দিলেন একটি কন্যা সন্তানের। ভিভ তার কন্যার নাম রাখলেন মাসাবা।মাসাবার গায়ের রঙ কালো, মাথায় ক্যারিবিয়ানদের মত কোঁকড়ানো চুল।
এরপর প্রতি বছর দু এক মাস করে মেয়ের কাছে কাটিয়ে গেছেন ভিভ।কিন্তু বিয়ে করেননি কারণ নিজের স্ত্রীকে ডিভোর্স দেওয়ার কথা কখনও ভাবেননি ক্রিকেটের রাজা।২০০৮ সালে নীনা বিয়ে করেন বিবেক মালহোত্রাকে।তার আগে অবধি ভিভ সাহায্য করেছেন নীনাকে,মাসাবার ভরণ পোষণের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করেছেন।
নীনা কখনও অ্যান্টিগুয়াতে যাননি কিন্তু দীর্ঘ সময় মাসাবাকে নিজের বাড়িতে নিয়ে রেখেছিলেন ভিভ।শৈশবে প্রতি বছর স্কুলে ভ্যাকেশন পড়লেই মাসাবা চলে যেতেন অ্যান্টিগুয়াতে তার পিতৃগৃহে।মারিয়ম স্বীকার করে নিয়েছিলেন তাঁর স্বামীর অবৈধ সন্তানকে।
২০০৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ বিশ্বকাপের দায়িত্ব নেয়। সেইসময় চব্বিশ বছরের কন্যার কাঁধে হাত রেখে খেলা দেখছেন প্রৌঢ় পিতা, এই ছবি সব সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল। মাসাবার বিয়েতে সশরীরে উপস্থিত ছিল ভিভের গোটা পরিবার।নিজের হাতে কন্যা সম্প্রদান করেন নাইট উপাধিতে ভূষিত স্যার ভিভিয়ান রিচার্ডস।
আরও খবর দেখুন: