১৮তম লোকসভার প্রথম অধিবেশন বসেছিল সকাল ১১টায়। তার আগে দিল্লি থেকে ভাষণ দিয়েছিলেন মোদি। জানিয়েছিলেন, নতুন বিশ্বাসের সঙ্গে নতুন উদ্যমে অধিবেশনের কাজ শুরু হবে। সহমতের ভিত্তিতেই কাজ করবে তাঁর সরকার। বিরোধীদের উদ্দেশে তিনি বলেছিলেন, ‘‘এখনও পর্যন্ত বিরোধীরা আমাকে হতাশ করেছে। তবে আশা করছি, সংসদে তারা সুষ্ঠুভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করবে। মানুষ স্লোগান নয়, কাজ চায়।’’ দুটো কথা খেয়াল করার মতো, যখন ১৭তম লোকসভার শেষদিনে মোদিজি বক্তৃতা দিতে উঠেছিলেন তখন কী বলেছিলেন? মানুষ বিরোধীদের এমন শিক্ষা দেবে যে তাঁরা সংসদের মধ্যে নয়, দর্শক আসনে বসে থাকবেন। নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, কংগ্রেসের ম্যানিফেস্টো তো পাকিস্তানের মুসলিম লিগের কপি। আর সেদিন বলছেন সহমতের কথা। কিন্তু যদি সেটাও সত্যি করে চাইতেন তাহলে প্রোটেম স্পিকার নিয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই তিনি বিরোধীদের সঙ্গে কথা বলতেন, বলেননি। উনি সহমতের ভিত্তিতে চলার কথা ভাবতেই পারেন না, উনি ভাবতেই পারেন না যে রাজ্যে নির্বাচিত সরকার আছে, আর সেগুলো প্রত্যেকটা ডাবল ইঞ্জিন নয়, বিরোধীরাও রাজ্যে রাজ্যে সরকারে আছে, সেগুলো নির্বাচিত সরকার, সেই রাজ্যের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট কোনও ব্যাপারে রাজ্যসরকারের সঙ্গে কথা বলতে হবে, এটাই যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর রীতিনীতি। না, এসব শিক্ষাদীক্ষা বা সাধারণ সৌজন্য ওনার নেই, উনি আমাদের এই বাংলার নদীর জল বাঁটোয়ার নিয়ে একতরফা কথা বলবেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার, আলোচনা করার সাধারণ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সৌজন্যবোধ তাঁর নেই। তিনি আজ সহমতের ভিত্তিতে সরকার চালানোর কথা বলছেন।
অনেকে বলবেন যে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই তাই এই সব কথা বলছেন, তাও নয়, দেখে নেবেন উনি যেভাবে চালিয়েছেন সেইভাবেই চালিয়ে যাবেন। ১৭তম লোকসভাতে শপথগ্রহণের সময়ে ঠিক ১ ঘণ্টা তিন চার মিনিট পরে তিনি বেরিয়ে গেছিলেন সংসদের আসন ছেড়ে, এবারেও হুবহু ওই ১ ঘণ্টা ৩ মিনিট পরেই বের হয়ে গেলেন, এটা ওনার স্বভাব। উনি সহমতের ভিত্তিতে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে সরকার চালাতে পারবেন না। আর তাই আমরা শিওর যে এই কোয়ালিশন সরকার টিকবে না। ওদিকে নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা যখন সাংসদ হিসাবে শপথ নিচ্ছিলেন, তখনই সংসদের বাইরে বিক্ষোভ দেখাচ্ছিলেন বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’র সাংসদেরা। সোমবার ১৮তম লোকসভার প্রথম অধিবেশনের দিনই সংবিধান বাঁচানোর দাবি তুলে গান্ধীমূর্তির পাদদেশে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন বিরোধী সাংসদদের একাংশ। সেখানে হাতে সংবিধান নিয়ে বিক্ষোভ দেখিয়েছেন কংগ্রেসের সনিয়া গান্ধী, মল্লিকার্জুন খাড়্গে, তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, সৌগত রায়, সমাজবাদী পার্টির ডিম্পল যাদব, ডিএমকে-র কানিমোঝিরা। হ্যাঁ ছিলেন মহুয়া মিত্রও, সব মিলিয়ে কংগ্রেস আর তৃণমূল সাংসদদের এই উপস্থিতি সেদিন এক অন্য অধ্যায়ের সূচনার মতোই লাগছিল। বিরোধী সাংসদদের এক ছোট অংশ অবশ্য সংসদের ভিতরেই ছিলেন। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান যখন সাংসদ হিসাবে শপথ নিচ্ছেন, তখন বিরোধী বেঞ্চ থেকে ‘নিট-নিট’ বলে স্লোগান দিয়েছেন কিছু সাংসদ। বোঝাই যাচ্ছে এখানেই শেষ হবে না, আবার অধিবেশন শুরু হলেই নেট এবং নিট-এ অনিয়ম এবং প্রশ্নফাঁসের অভিযোগ নিয়ে উত্তাল হবে লোকসভা, কাজেই ধরে নিতেই পারেন এটা ছিল তার ট্রেলার। প্রোটেম স্পিকার নির্বাচন নিয়ে মতান্তরের জেরে সংসদে শপথগ্রহণের অনুষ্ঠান বয়কট করার কথা জানিয়েছিলেন ডিএমকে-র দলনেতা টিআর বালু, কংগ্রেসের কে সুরেশ এবং তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। কেন সবচেয়ে বেশি বার জিতে আসা সাংসদ কংগ্রেসের কে সুরেশকে ওই দায়িত্ব না দিয়ে কটকের বিজেপি সাংসদ ভর্তৃহরি মহতাবকে দেওয়া হল, সেই প্রশ্ন নিয়ে এককাট্টা ছিল বিরোধী শিবির, এই ঐক্যও আগামী দিনে বজায় থাকবে। সাংসদদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যাওয়ার পরেই স্পিকার নির্বাচন, তা নিয়ে সরগরম, বিভিন্ন আলোচনা শুরু হয়েছিল দিল্লির রাজনৈতিক মহলে। কিন্তু ওই যে, সহমত ইত্যাদি এক বাগাড়ম্বর মাত্র, যো মাঙ্গো দেঙ্গে, স্পিকার তো ব্যস অপনা হি হোগা, বলেই নিজেদের সেই ওম বিড়লাকেই স্পিকার আসনে বসিয়েছে বিজেপি নেতৃত্ব আর সেই সুযোগ বুঝে নীতীশ এবং চন্দ্রবাবু রাজ্যের জন্য হার্ড বার্গেনিংয়ে নেমে পড়েছেন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ন্যায়সংহিতাতে কতটা ন্যায়?
অমরাবতীতে নতুন রাজধানী খানিক ইন্দ্রপ্রস্থের মতো তৈরি করতে চান চন্দ্রবাবু, প্রচুর পয়সার দরকার, বেশ কিছুটা পয়সা আসছে বিশ্ব জোড়া তেলুগু এনআরআইদের কাছ থেকে যাঁরা ওই রাজধানীর মধ্যেই বড় বড় হাউজিং, রেস্তোরাঁ চেন, স্কুল-কলেজ খুলতে চান, সে পয়সা আসছে হু হু করে। আর তার উপরে কেন্দ্র সরকারের টাকা আসলে তিন চার বছরের মধ্যে তৈরি অন্ধ্রপ্রদেশের নতুন রাজধানীই হবে আগামী নির্বাচনে চন্দ্রবাবু নাইডুর তুরুপের তাস। কাজেই তিনি এই সরকারকে খুব বেশি ঘাঁটাবেন না, কেবল তাঁর নজর থাকবে মুসলমান ভোটের দিকে, কারণ ওই মুসলমান ভোট না পেলে আবার নির্বাচিত হওয়াটা বেশ মুশকিল হবে। ওদিকে নীতীশ কুমার গোঁ ধরেই আছেন বিহারকে বিশেষ রাজ্য তালিকায় আনতে যা নিয়মমাফিক সম্ভব নয়, মাত্র এক বছরের মধ্যেই অক্টোবর নভেম্বর ২০২৫-এ বিহারে নির্বাচন, কাজেই নীতীশকে প্রস্তুতি নিতেই হচ্ছে। তিনি যে কেবল বিশেষ রাজ্যের তালিকাতে বিহারকে নিয়ে যেতে চাইছেন তাও নয়, তিনি রাজ্যে সম্রাট চৌধুরি এবং আরও কয়েকজন বিজেপি নেতাকে নিয়ে খুশি নন, সেটা প্রকাশ্যেও বুঝিয়ে দিয়েছেন। সাফ বলেছেন, ওই সম্রাট চৌধুরিকে পাগড়ি খুলতেই হবে, যাদের মনে নেই তাঁদের জন্য বলছি, বিজেপির এখন উপমুখ্যমন্ত্রী সম্রাট চৌধুরি নীতীশ-তেজস্বী মন্ত্রিসভা তৈরি হওয়ার পরে বলেছিলেন নীতীশকে না হারানো পর্যন্ত মাথার পাগড়ি খুলব না। কিন্তু নীতীশ আবার দল বদলেছেন তিনি হয়েছে তাঁরই উপমুখ্যমন্ত্রী কিন্তু পাগড়ি খোলেননি। নীতীশ সাফ জানিয়েছেন, ওটা খুলতে হবে, সম্রাট চৌধুরির পাগড়ির চেয়ে মোদিজির গদি অনেক বড় তাই সম্রাট চৌধুরি পাগড়ি খুলেছেন এবং বিজেপির রাজ্যস্তরের নেতারা নীতীশের ওই মদের উপর নিষেধাজ্ঞা নিয়েও প্রশ্ন তুলছেন। সেটাও উড়িয়ে দিয়েছেন নীতীশ কুমার কিন্তু সব মিলিয়ে নাইডুর চেয়ে বিজেপির মাথাব্যথা আপাতত নীতীশকে নিয়ে সেটা পরিষ্কার। মোদিজি এর মধ্যেই যথারীতি সাতসকালে ১১টা নাগাদ ওনার ওয়ান ওয়ে কমিউনিকেশন মন কি বাত নিয়ে হাজির হয়েছেন, সংসদে লোকসভা, রাজ্যসভাতে মুখ খুলেছেন। কিন্তু যা দেশের মানুষ জানতে চাইছিল তার একটা কথাও বলেননি। আমরা মাত্র এই ক’টা বিষয়ে ওনার কিছু কথা শুনতে চাইছি।
১) ওনার তো ৫৬ ইঞ্চির সিনা, ছাতি, আমি বলছি না উনিই বলেন, তো ওই ৫৬ ইঞ্চি ছাতি নিয়ে এক বছর দু’ মাস অবধি মণিপুরে যেতে পারলেন না কেন? কিসের ভয়ে? উনি জওহরলাল হবেন? ব্রিটিশের জেলে ৯ বছর কাটিয়েছেন, উনি মনে মনে তাঁর সমকক্ষ হতে চান, কিন্তু তাঁর শিক্ষা ছেড়েই দিলাম, তাঁর দেশপ্রেমের কথাও ছেড়ে দিলাম, তাঁর সাহিত্যকীর্তির কথাও ছেড়ে দিলাম, কেবল মানুষ হিসেবে তাঁর সাহস, রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা, ওই হিংস্র ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে দেশের প্রতিটা কোণে গিয়ে তিনি হাজির হয়েছিলেন, সেইটুকু ক্ষমতাও মোদিজির আছে? প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লক্ষ টাকা সিকিউরিটির জন্য খরচ করার পরেও দেশের প্রধানমন্ত্রী এক বছর দু’ মাস ধরে জ্বলতে থাকা দেশের এক জনগোষ্ঠীর সামনে হাজির হওয়ার সাহসটুকুও দেখাতে পারলেন না, ২) আপনার মন কি বাত-এ বললেন না কেন যে এই পরীক্ষা প্রশ্নপত্র লিক হওয়ার পিছনে কারা? এবং আপনি এ বিষয়ে এখনও চুপ করে বসে আছেন কেন? এটা তো আপনার সেই পৃথিবীতে কোথাও না থাকা এন্টায়ার পলিটিক্যাল সায়েন্সের পরীক্ষা নয়। ৩) কৃষকদের মিনিমাম সাপোর্ট প্রাইসের গ্যারান্টি কবে দেবেন? তাদের এই দাবি নিয়ে সরকার কী ভাবছে? ৪) মাত্র পাঁচদিন আগেও ছত্তিশগড়ে দুজন সংখ্যালঘু মুসলমান মানুষকে গরুর মাংস পাচার করছে এই অপরাধে পিটিয়ে মারা হল? আর কতদিন এই অন্যায় চলবে? ৫) নির্বাচনী বন্ড বেআইনি, সুপ্রিম কোর্টের রায়। কিন্তু বিজেপিই এই বন্ডের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা একলাই প্রায় ৬০ শতাংশ টাকা পেয়েছে, এটা নিয়ে কবে সিবিআই তদন্ত হবে? আপনার মন কি বাত-এ বলেননি, সংসদে বলেননি, আর কবে বলবেন? আর যদি মনে হয় আপনার আগড়ুম বাগড়ুম মানুষ শুনবে আর বিশ্বাস করবে তাহলে শুনে রাখুন মানুষ ট্রেলারটা দেখিয়েছে, এবার দেশ জুড়ে আসল সিনেমাটা শুরু হবে, আর সে সিনেমার শেষে পরাজিত নায়কের ভূমিকায় দেশের মানুষ দেখবে আর চিৎকার করবে, দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান।