অনেকে বলেন যে কেজরিওয়ালের কোনও আদর্শই নেই, আসলে আদর্শ বলতে তাঁরা সম্ভবত বাম বা বিজেপির মতো এক রিজিড ইডিওলজির কথা বলেন। এবং খেয়াল করে দেখুন বাকি সব বিজাপি বিরোধী দল সাম্প্রদায়িকতা, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা গণতান্ত্রিক কাঠামো সংবিধান নিয়ে কমবেশি একই রকম ভাবনাচিন্তা করেন। কেজরিওয়াল এঁদের চেয়ে খানিক ভিন্ন, আদর্শ নেই? না তেমনও নয়, তাঁর মাথায় এক আজগুবি আদর্শ ভরা আছে, যা তিনি বহু আগে তাঁর হার্পার কলিন্স থেকে প্রকাশিত বই স্বরাজে লিখেছেন। সে এক প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর থেকে ধার নেওয়া আদর্শ, যখন বেশ কিছু রাজ্য চলত রাজ্যের মান্যিগন্যিদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে, ষোড়শ জনপদের ইতিহাসে সেসব কথা আছে। তিনি তাঁর ওই বইয়ের গোড়াতে আমাদের দেশের বর্তমান কাঠামো যে পচে গেছে, তা যে কংগ্রেসের দুর্নীতি আর অপশাসনের ফলে এক অধঃপতিত গণতন্ত্রে পরিণত হয়েছে সেসব লিখেছেন তারপরে সেই মানুষের সরাসরি প্রত্যক্ষ্য পরিচালনায় রাষ্ট্র চালানো হবে ইত্যাদি এক কল্পকাহিনির কথা লিখেছেন, খানিক বিশ্বাসও করেছেন, খানিক চেষ্টাও করেছেন, এবং শেষমেশ সেই কংগ্রেসের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে গত লোকসভাতে নির্বাচন লড়েছেন। দিল্লিতে সেই মানুষের কথা শুনেই আমরা আমাদের এমএলএ প্রার্থী বাছব গোছের বাওয়াল কবেই বন্ধ করেছেন। এবং শেষমেশ এক বিরাট হার।
আমরা আমাদের আলোচনাতে আগেই বলেছিলাম যে লোকসভাতে যে ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছিল তার বেশিরভাগই আবার কেজরিওয়ালের দিকে ফিরে আসবে, এবং সেটাই ছিল আমাদের দিল্লি লোকসভার অ্যাসেসমেন্ট-এর প্রথম ভিত্তি। যা মাথাতে রেখে আমরা বলেছিলাম কেজরিওয়াল ৪৫টা আসন পাবে, কংগ্রেস গোটা ১/২, বাকি ২৩/২৪টা বিজেপি। কিন্তু হয়েছে কী? এর আগে আপ এবং কংগ্রেস এক সঙ্গে লড়েছিল লোকসভার ভোট, তাদের মিলিত ভোট ছিল ৪৩%। বিজেপির ভোট ছিল ৫৪.৩৫%। এবারে ভোটের পার্সেন্টেজ কত? বিজেপি পেয়েছে ৪৫.৫৬% ভোট। মানে প্রায় ৯% ভোট বিজেপির কাছ থেকে সরেছে, যা ২০২০-র বিধানসভাতে সরেছিল ১২%-এর মতো আর পুরোটাই গিয়েছিল আম আদমি দলের দিকে, আপ জিতেছিল ৬২টা আসন। এবারে ৯ % ভোট বিজেপির কমেছে, আপ পেয়েছে ৪৩.৫৭% ভোট কংগ্রেস পেয়েছে ৬.৩৪% ভোট। কেবল ভোট জুড়ে দিলেই হত ৫০%-এর মতো ভোট, বিজেপির ৪৫.৫৬% ভোটের চেয়ে সাড়ে চার শতাংশ বেশি এবং তার ফলে বিজেপি ১৮/১৯ টার বেশি আসন কোনওভাবেই পেত না। কিন্তু তা হয়নি। বিজেপি ৪৮ টা আসন পেয়ে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু কেউ যদি এই অঙ্কের হিসেবটাকেই মানে জোট হল না তাই আপ হেরে গেল এরকম বলেন, মানে এটাকেই একমাত্র কারণ হিসেবে তুলে ধরেন তাহলে বলব বিষয়টা অত সোজা নয়। মানে রাজনীতি অমন সরল গণিতের হিসেব মেনে চলে না। জোট হলেই বিজেপি হারবে, জোট না হলেই জিতবে এমন নয়, আবার জোট হয়নি সেটা যে বিজেপিকে বিরাটভাবে সাহায্য করেছে, সেটাও সঠিক। আসুন অঙ্কের বাইরের রাজনীতিটাকে দেখা যাক। আবার এক ধরনের আলোচনাতে বলা হচ্ছে যে ৭০/৮০ কোটি টাকা দিয়ে শিশমহল বানিয়ে হেরে গেলেন কেজরিওয়াল, এদেশের ফকির প্রধানমন্ত্রী হাজার কোটি টাকার প্লেন কেনেন, দু’ লাখের পেন ব্যবহার করেন, এক লাখের রোদচশমা, সেখানে এই খরচের কথা শুনে সব ভোট চলে যাবে এমনটা ভাবার কোনও কারণ নেই।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | দিল্লির হার, বিরোধীদের সংকট
এই ফলাফল আমাদের কাছে যে সত্যিগুলো তুলে ধরল সেগুলো নিয়ে আলোচনাটাও খুব জরুরি। প্রথমটা হল বিজেপির সঙ্গে লড়তে হলে পুরোদস্তুর লড়তে হবে, যে রাজ্যে যে দল বিজেপির মূল বিরোধী তাকে বিজেপির আইডিওলজি, বিজেপি আরএসএস-এর আদর্শের বিরুদ্ধে লড়তে হবে, মাঝামাঝি অবস্থান নিলেই তা ব্যুমেরাং হবেই। আর একটু খোলসা করা যাক। আপনাদের মনে আছে কেজরিওয়াল বলেছিলেন দিল্লির সরকার স্কুলে স্কুলে গিয়ে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের খুঁজে বের করবে, ইন ফ্যাক্ট টার্গেট হয়ে দাঁড়াচ্ছিলেন বাঙালি মুসলমানেরা। ভাবা যায়? উনি যা বলছিলেন, এখানে শুভেন্দু অধিকারী দিলীপ ঘোষ তো সেই কথাই বলেন। কাজেই দিল্লির সংখ্যালঘু মানুষজন, যাঁরা এর আগে দু’ দু’বার তাদের ভোট উজাড় করে দিয়েছিলেন আপ-এর ভোট বাক্সে, তারা এবারে হয় ভোট দিতেই এলেন না, না হলে কংগ্রেসকে ভোট দিলেন, ওই যে দু’ শতাংশের বেশি ভোটবৃদ্ধি তার সম্পূর্ণ কৃতিত্ব কেজরিওয়াল সাহেবের। দিল্লিতে দাঙ্গা হচ্ছে, গ্রেফতার হচ্ছেন উমর খালিদ, মিরন হায়দার, আসিফ ইকবাল তনহা, শিফা উর রহমান, নাতাশা নারওয়াল, দেভাঙ্গনা কালিতা, শরজিল ইমাম আরও অনেকে। কেজরিওয়াল একটাও কথা বলেছেন? শাহিনবাগে ওই ঠান্ডায় মানুষজন সিএএ-র বিরুদ্ধে ধর্নায় বসে আছেন, কেজরিওয়াল গেছেন? জেএনইউতে এবিভিপির গুন্ডারা গিয়ে ভাঙচুর করল, মেরে মাথা ফাটিয়ে দিল, কেজরিওয়াল গেছেন? যাননি। বুলডোজার ভাঙতে গেছে বাড়িঘর, সামনে দাঁড়িয়েছেন সিপিএম নেত্রী বৃন্দা কারাত, কেজরিওয়াল গেছেন? যাননি। আসলে রাজনীতিবিহীন এক রাজনীতি আমদানি করার চেষ্টা তিনি করছিলেন, যা দিয়ে আর যাই হোক বিজেপি আরএসএসকে আটকানো অসম্ভব। তিনি যা বলার চেষ্টা করছিলেন তা হল তিনি ডান বা বাম কোনওটাই নন, তিনি দুর্নীতি বিরোধী, বিকাশ উন্নয়নের এক বিকল্প রাজনীতির কথা বলে আসর মাত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সমস্যা হল সেই জায়গাগুলোতে বিজেপি তাঁর রাজনীতিকে ফালাফালা করে দিয়েছে। আবগারি ঘোটালা সত্যিই উনি করেছেন কি না তা অবান্তর, তিনি কত টাকা চুরি করেছেন তাও অবান্তর কারণ বিজেপির হাতে ইডি আছে, আছে সিবিআই তারা তার ব্যবহার করে অ্যাট লিস্ট প্রাথমিকভাবে জেলে পুরে বিভিন্ন চার্জ এনে গোদি মিডিয়াতে তার ফলাও প্রচার করে ওই দুর্নীতি বিরোধী আলখাল্লাটা ছিঁড়ে ফর্দাফাই করে দিয়েছে।
রইল বাকি বিকাশ, সেখানেও এক পর্যায়ে গিয়ে রাজ্য সরকারগুলোকে বুঝতেই হবে সামগ্রিক বিকাশ সম্ভব নয়, ইউনিয়ন গভর্নমেন্ট প্রতিটি পর্যায়ে আটকাবে, প্রতিটি পর্যায়ে নানান অছিলায় ওই বিকাশ আর উন্নয়নের বেলুন ফুটো করার কাজটা লাগাতার চালিয়ে যাবে। আর দিল্লির বিকাশ নিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সমস্যা ওখানকার কেবল জুগগি ঝুপড়ির বিকাশ তাঁর হাতে নেই, ওই জুগগি ঝুপড়ির যে আইনিকরণ তাই তো আছে ইউনিয়ন গভর্নমেন্টের হাতে। ওদিকে দিল্লির মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত সমাজের লোকজন অরবিন্দ কেজরিওয়ালের সঙ্গে ছিল কেবলমাত্র ওই বিকল্প রাজনীতি, ওই ডান নই বাম নই, বিকাশ উন্নয়ন আর দুর্নীতিমুক্ত রাজনীতির শর্তে, যা কেজরিওয়াল রক্ষা করতেই পারেননি। আবার সারা দেশের বিজেপি বিরোধী লড়াইয়ে ইন্ডিয়া জোটে থেকে কংগ্রেসকে সঙ্গে নিয়েও তাঁর রাজনীতি করা সম্ভব নয় কারণ তাঁর উত্থানই তো কংগ্রেস বিরোধী রাজনীতির মধ্য দিয়ে, দিল্লিতে কংগ্রেসকে সরিয়ে, পঞ্জাবে কংগ্রেসকে সরিয়েই তাঁর উত্থান। সবমিলিয়ে তিনি ছিলেন এক ক্যাচ টোয়েন্টিটু সিচুয়েশনে, জোট হলে বড়জোর এবারের গদিটা বেঁচে যেত, কিন্তু তাঁর রাজনীতি নিয়ে টিকে থাকা প্রায় অসম্ভব। জোট তো হয়নি মমতার সঙ্গেও, তৃণমূলও তো একলাই লড়েছিল, লড়ে যাচ্ছে, সে কীভাবে হারাচ্ছে বিজেপিকে? এক্কেবারে মুখোমুখি লড়াই, এক ইঞ্চি জায়গা ছেড়ে লড়ছেন না মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এক ইঞ্চিও নয়। মোদিজি রামমন্দিরে রামের প্রাণ প্রতিষ্ঠা করতে গেলেন, কেজরিওয়াল তো জানিয়েই দিলেন রামলালার দর্শন করতে তিনিও যাবেন, প্রবীণ মানুষজনদের বিনা টিকিটে অযোধ্যা ভ্রমণের কথাও বললেন, অখিলেশ যাদব কয়েকজনকে নিয়ে ক’দিন পরেই অযোধ্যা ঘুরে এলেন, সরযূতে ডুব দিলেন। মমতা কলকাতায় সর্বধর্ম পদযাত্রায় নামলেন, নিজে সামনে, পাশে সংখ্যালঘু ধর্মের নেতারা, হিন্দু পুরোহিতেরা। বিকল্প লড়াই। ৩৭০ ধারা, কেজরিওয়াল সমর্থন করলেন, মমতা বিরুদ্ধে। আবার অন্যদিকে পুজো উদ্বোধনে আছেন, কার্নিভালে আছেন, জগন্নাথ মন্দির তৈরি হচ্ছে। ডিএ দিচ্ছেন না কিন্তু লক্ষ্মীর ভাণ্ডারের পয়সা বাড়িয়েই যাচ্ছেন, স্বাস্থ্যসাথীর কভারেজ বাড়ছে। মানে টার্গেট গরিব, নিম্নবিত্ত, গ্রামের মানুষ, মুসলমান সংখ্যালঘু মানুষ, তার সঙ্গে বাংলা বাংলার মেয়েকে চায়, এক বাঙালি আইডেন্টিটি ছেড়ে দেননি, গর্গ চট্টোপাধ্যায় এত করেও ওই হাজার খানেকের বেশি ভিড় টানতে পারেন না বা যাই বলেন তা কোথাও না কোথাও গিলে ফেলে উগরে দেয় সেই মমতারই রাজনীতি। কেজরিওয়াল নিজের জন্য তো বাড়ি করেননি, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর বাড়ির জন্য ৭০/৮০ কোটি টাকা খরচ তো করেছিলেন, এক বিশাল মহল তো বানানো হয়েছিল, উনিই তো মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন, কতটা জরুরি ছিল সেটা? মমতা এখনও সেই কালীঘাটের বাড়িতেই আছেন। ওনার ভাইয়েরা জমি দখল করেছেন? ওনার ভাইদের ওই চত্বরে সবক’টা বাড়ি আছে? সেই ভাইদের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কতদিন দেখা যায়? তৃণমূলের রাজনীতিতে সেই ভাইরা কোথায়? পারসেপশন ব্যাটলে মমতা এক ডজন গোল দিয়ে দেবেন, এখনও তাঁর পায়ে হাওয়াই চটি আর পরনে সাদা শাড়ি। এইখানে মমতা সফল।
যতদিন ৩২/৩৩% শতাংশ সংখ্যালঘু, গ্রামীণ গরিব মানুষ, শহরে বস্তির মানুষ আর বিজেপি বিরোধী মধ্যবিত্ত উচ্চবিত্ত শিক্ষিত মানুষজনের সমর্থন মমতার দিকে থাকবে ততদিন মমতাকে ক্ষমতা থেকে সরানো যাবে না। তিনি ডিএ-র একটা কিস্তিও যদি আর না দেন তাহলেও এই ভোট ব্যাঙ্কে খুব একটা চিড় ধরবে না, কিন্তু উন্নয়নের নামে বুলডোজার চালানো, হঠাৎ নরম হিন্দুত্ব নিয়ে কাতর হলে এই ভোট ব্যাঙ্কে ফাটল ধরবে। এখানে ওই মুর্শিদাবাদ বা মালদার পকেট অঞ্চলে সংখ্যালঘু ভোটের খানিকটা তো কংগ্রেসের হাতে আছে, মমতা জানেন, জানেন বলেই ট্র্যাক টু খোলা, এত কথা বলার পরেও এ রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের বড় অংশই চান সিপিএম নয় আগামী নির্বাচনে মমতার সঙ্গে জোট বাঁধতে, সময় এলে মিলিয়ে নেবেন, সে জোট হয়েও যাবে। মমতা জানেন ৫% ভোটও বিরাট কাজ করবে। যা কেজরিওয়াল বোঝেননি, তাঁর রাজনীতিবিহীন দর্শন, উন্নয়ন বিকাশের দর্শন যে অচল তা আজ হাতেনাতে প্রমাণিত। বিজেপির কাছে ব্রহ্মাস্ত্র আছে, তারা ২০% এগিয়েই খেলছে, তাদের কাছে নির্ভরযোগ্য ২০% কমিটেড হিন্দু ভোট আছে, এর উপর তাদের দরকার উন্নয়ন বিকাশের শর্তে কিছু সমর্থন, বিশ্বগুরু ইত্যাদি বাওয়ালের ভিত্তিতে কিছু সমর্থন, বাকিটা বিরোধী দলের বিরুদ্ধে লাগাতার দুর্নীতি আর চুরির অভিযোগ এনে ইডি সিবিআইকে দিয়ে তাদের জেলে পুরে আর গোদি মিডিয়াকে দিয়ে তার প্রচার চালিয়ে যে ভোট আসবে তাই তাদের ক্ষমতায় নিয়ে আসার জন্য যথেষ্ট। যেখানে তা সম্ভব নয় সেখানে বিরোধী দলকে ভাঙো, তাদের মধ্য থেকে একনাথ শিন্ডেকে বের করো, কেল্লা ফতে। কাজেই কেবল জোট হল না বলে নয়, এক সার্বিক ভুল লক্ষ্যবিহীন রাজনীতি নিয়ে পথ চলতে শুরু করেছিলেন কেজরিওয়াল, তাঁর ভাঙনের শুরুয়াতটা হল, এখন সম্ভবত এক্কেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়াটা সময়ের অপেক্ষা। যদি না তিনি তাঁর রাজনীতিকে আমূল শুধরে নিয়ে বিজেপি বিরোধী রাজনীতিতে সর্বভারতীয় জোটে নামেন তাহলে আর মাস ছয়ের মধ্যে দলটা ইতিহাস হয়ে যাবে। সে দলের খানিক চলে যাবে কংগ্রেসের কাছে, খানিক যাবে বিজেপির দিকে, কে কতটা পায়, সেটাই এখন দেখার।