জি টোয়েন্টি শেষ হয়েছে, পুষ্পবৃষ্টি হয়েছে মোদিজির উপর। ওনার জনপ্রিয়তা সামান্য কমলেও যা অবশিষ্ট, তার ধারেকাছেও নেই রাহুল গান্ধী, অন্যদের কথা বাদই দিলাম। তিনি সুবক্তা, সঙ্গে সঙ্গত দেবার জন্য আছেন অমিত শাহ, সঙ্গে আছে দেশের যাবতীয় ভিজিলেন্স এজেন্সি, ইডি, সিবিআই, এনআইএ, ইনকাম ট্যাক্স। বিজেপির অর্থভাণ্ডার ৪৭ সালের পর থেকে কোনও রাজনৈতিক দলের কাছে এক রেকর্ড, কর্পোরেট ডোনেশনের ৮৫ শতাংশ ওনাদের ফান্ডে জমা হচ্ছে। মানে অর্থ, সামর্থ্য, যশ, প্রতিপত্তিতে আকাশ ছুঁয়েছে বিজেপি। কিন্তু বিজেপির সামনে একে একে সমস্যার পাহাড় খাড়া হচ্ছে, সমস্যা বাড়ছে। একেই বলে বৃদ্ধির সমস্যা। ইতিহাস বলছে যে কোনও সাম্রাজ্য তার চূড়ান্ত শিখরে যাবার পরেই তার পতন শুরু হয়। সে বাইজান্টাইন, রোম বা মোগল সাম্রাজ্য, যাই হোক না কেন, তাদের শিখরে উঠেছে, তারপর হুউউউউস করে নেমে গেছে। মসনদ ধরে রাখা যায় না, কিরায়েদার হ্যায়, জাদতি মকান থোড়েই হ্যায়। ঠিক সেইরকমভাবেই বিজেপি কি তার শিখর থেকে নামা শুরু করেছে, পতন শুরু হয়ে গেছে এবার কেবল ধসে পড়াটাই বাকি? আসুন সেই আলোচনায় নামা যাক। মোদিজি ২৪ ইন্টু সেভেন দলের জন্যই করছেন, ভুল হোক ঠিক হোক এক আদর্শের জন্যই লড়ছেন, এতে কি কোনও সন্দেহ আছে? না নেই। কিন্তু তাঁর সঙ্গের মানুষজন? তাঁর দল? তাঁর সংগঠন আর এস এস? দেশের রাজনীতি? সারা বিশ্বের রাজনীতি? সবটা যদি বিরুদ্ধে চলে যায়, তাহলে তিনি একলা কিই বা করবেন। একলা একলা তো হিন্দু রাষ্ট্র তৈরি করা যায় না। মোদিজীর প্রথম সমস্যা হল তাঁর উচ্চতা, দলের মধ্যে যে উচ্চতায় তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন, আজ নয় সেই ২০২৪ এর আগে থেকেই, নির্বাচনী প্রচার করার সময় থেকেই, বা বলা ভাল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচনের আসরে নামার সময় থেকেই তিনি নিজেকে তুলে নিয়ে গেছেন এক বিরাট উচ্চতায়, যার ফলে আজ তাঁর পাশাপাশি নেতাদের বামন বলে মনে হচ্ছে। লোকসভা বাদ দিন, বিধানসভা, উপনির্বাচন, মিউনিসিপালিটি, কর্পোরেশন ভোটের দায়ও এখন মোদিজীর, তিনিই হয়ে উঠেছেন এক সবখোল চাবি, তিনি ক্লান্ত, মানুষও ক্লান্ত। একই ওষুধ সর্বত্র কাজে লাগে না কিন্তু লাগাতে হচ্ছে কারণ উপায় নেই, আর কোনও নেতাই নেই। মোদিজীও নিজের টিম তৈরি করার তালে বাদ দিয়েছেন পুরনো প্রত্যেককে।
ধরুন অটল বিহারী বাজপেয়ীর মন্ত্রিসভায় যে ৫২ জন বিজেপির মন্ত্রী ছিলেন, তাদের মধ্যে মাত্র ৬ জন মোদিজীর ২০১৯ এর মন্ত্রী সভাতে ছিলেন। রাজনাথ সিং, রবিশঙ্কর প্রসাদ, প্রহ্লাদ প্যাটেল, সন্তোষ গঙ্গোয়ার, শ্রীপদ নায়েক, ফাগুন কুলস্তে। এরমধ্যে সন্তোষ গঙ্গোয়ার বা রবিশঙ্কর প্রসাদকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কবেই, শ্রীপদ নায়েক আয়ুস দপ্তরের স্বাধীন ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী ছিলেন, সরিয়ে দেওয়া হয়েছে, এখন তিনি প্রতিমন্ত্রী, গুগল ছাড়া তাঁর দপ্তরের নাম কেউ জানে না। প্রহ্লাদ প্যাটেল আর ফাগুন কুলস্তে কে মধ্য প্রদেশে এম এল এ হিসেবে লড়তে পাঠানো হয়েছে। ২০২৪ এ যদি আমাদের মোদিজী জেতেন, তাহলে ঐ এক রাজনাথ সিং ছাড়া কেউ থাকবে না। তাঁদের বয়স হয়েছে? না তাও নয়, রবিশঙ্কর প্রসাদ ৬৯, বাকিরা কেউ ৬৩, কেউ ৬৪। আমাদের ভারতীয় রাজনীতিতে যা অত্যন্ত স্বাভাবিক। আসলে নরেন্দ্র মোদিজী তাঁর নিজের টিম বানাতে গিয়ে নিজেকে ক্রমশ একলা করেছেন, এটাই তাঁর প্রথম আর প্রধান সমস্যা। এবং ওনার পছন্দের তালিকায় নেই এমন নেতাদের সরিয়ে দেওয়ার এই যে পদ্ধতি তা কেমন করে ব্যাক ফায়ার করে সেটা দেখুন, মধ্য প্রদেশে শিবরাজ সিং চৌহানের চেয়ে জনপ্রিয় আর কোনও মুখ আছে? ধরুন প্রহ্লাদ প্যাটেল, নরেন্দ্র সিং তোমর, ফাগুন কুলস্তে, কৈলাশ বিজয়বর্গী, এঁদেরকে বিধানসভাতে লড়তে পাঠানো হয়েছে, এনারা নিজেদের মূখ্যমন্ত্রী ছাড়া কিছুই ভাবেন না, কিন্তু এনাদের প্রভাব নিজেদের এলাকার বাইরে কতটা? প্রায় নেই বললেই চলে। অন্যদিকে যিনি জনপ্রিয়, সেই শিবরাজ সিং চৌহান চতুর্থ লিস্ট এ জায়গা পেয়েছেন বটে, কিন্তু তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী মুখ যে করা হবে না তা স্পষ্ট। কিন্তু তিনি জনসভায় জনসভায় যাচ্ছেন, মানুষদের জিজ্ঞাসা করছেন, বলুন আমার কাজে আপনারা সন্তুষ্ট কি না, মানুষ বলছেন হ্যাঁ মামাজী, এটাই ওনার ডাকনাম। বলছেন এই সরকার চলবে কি না বলুন, মানুষ বলছেন হ্যাঁ মামাজী। উনি এই চিৎকার দিল্লির কানে দিতে চাইছেন, কিন্তু মোদিজী? ভূপালে ওনার জনসভাতে গিয়ে মানুষকে বললেন, মোদি সরকার কা আনাজ মিল রহা হ্যায়? পি এম হাউস কা পয়সা মিল রহা হ্যায়? মানে রাজ্য সরকারের কাজের ওপর প্রধানমন্ত্রীর ভরসাই নেই, মূখ্যমন্ত্রী তো দুরস্থান।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | হামাস আক্রমণ, ইজরায়েল এবং ভারত
রমণ সিং ছত্তিশগড়ে আসন তো পেয়েছেন, কিন্তু তাঁর অনুগামীরা টিকিট পায় নি, এবং ছত্তিশগড়ে বিজেপির সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা রমণ সিং এবারে বিজেপির মূখ্যমন্ত্রী মুখ নন। রাজস্থানে অবস্থা আরও শোচনীয়, সেখানে বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়ার টিকিট এখনও মেলেনি, উলটে ওনার অনুগামীদের টিকিট কাটা গেছে। বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া বেসুরো, এবং তিনি বেসুরো হওয়া মানে বিজেপির হার। এই চার রাজ্যের নির্বাচনে কেবল রাজস্থানেই বিজেপির জেতার সম্ভাবনা জোরালো কিন্তু পঞ্জাবে অমরিন্দ্র সিং কে সরিয়ে কংগ্রেস যে ভুল করেছিল, রাজস্থানে বিজেপি সম্ভবত সেই ভুলই করতে যাচ্ছে। এই নির্বাচনের আসরে অটল জামানার তিনজন গুরুত্বপূর্ণ নেতাকে অবসরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত পাকা হয়ে গেছে, বসুন্ধরা রাজে সিন্ধিয়া, রমণ সিং, শিবরাজ সিং চৌহান। এক নতুন বিজেপি তৈরি হচ্ছে। দেশে আপাতত ১০ জন বিজেপি দলের মূখ্যমন্ত্রী আছেন, আর সেই দশজনের মধ্যে একমাত্র ওবিসি নেতা হলেন শিবরাজ সিং চৌহান, জাতিভিত্তিক জনগণনা নিয়ে বাজার গরম, এই সময়ে এক ওবিসি নেতাকে পাত্তা না দেবার ফল বিজেপি কে ভুগতে হবেই। এরকমই হয়, পতনের আগের সিদ্ধান্তগুলো পরে দেখলে মনে হয় সুইসাইডাল ডিসিশন, কিন্তু যার পতন সে দেখতে পায় না। হিটলার যদি সোভিয়েতের সঙ্গে অনাক্রমণ চুক্তি না ভেঙে কেবল ইউরোপ দখল করতো, পরে সোভিয়েতের দিকে হাত বাড়াতো, তাহলে ইতিহাস অন্যরকম হতো। এরকম আরও অনেক আছে, আমাদের দেশেই আছে। এবং দেশজুড়ে বিজেপির মধ্যেই ঝগড়া, সর্বত্র, সেই গুজরাট থেকে রাজস্থান, ছত্তিসগড়, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, বাংলা এমন কি উত্তর প্রদেশেও, দলের মধ্যের কোন্দল বাড়ছে, ধরুন উত্তরপ্রদেশের ঘোশি, উপনির্বাচনে প্রার্থী ৫ বারের দলবদলু দারা সিং চৌহান, যোগী ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন, কিন্তু অমিত শাহ আর তাঁর দলবল এই চৌহানকে দাঁড় করালেন, ফল হাতে নাতে, ঝাড়খন্ডে দূর্নীতির দায়ে জে এম এম এর বিধায়কের আসন চলে গেল, উপনির্বাচন হল, সেখানে প্রার্থী ঐ জে এম এম বিধায়কের স্ত্রী, সব্বাই ভেবেছিল এই আসন এবার জে এম এম হারাবে, বিজেপির ভোট ২৯% কমেছে, ১৪% ভোট বেড়েছে জে এম এম এর, বিজেপির রাজ্য সভাপতি বিরোধী গোষ্ঠির লোকজন নাকি এরজন্য দায়ী, এরপর ওখানে দলের মধ্যে মারপিটও হয়েছে।
গুজরাটে ল্যান্ড ডিল নিয়ে স্ক্যাম, আর তাই নিয়ে বিতর্ক, মূখ্যমন্ত্রীর বিরোধী লবি নাকি মূখ্যমন্ত্রীর দপ্তরকে দিয়েই এসব ফাঁস করিয়েছে, মূখ্যমন্ত্রী নিজের সেক্রেটারিকে ট্রান্সফার করে দিলেন। অসমে বিজেপি কিসান মোর্চার সাধারণ সম্পাদক ইন্দ্রানী তবিলদারের আত্মহত্যার পরে তাঁর সঙ্গে আপত্তিকর কিছু ছবি যাতে অন্য বিজেপি নেতারাও আছেন, ফাঁস হল, অডিও রেকর্ডিং ফাঁস হল, জোড়হাটের এক বিজেপি নেতাই নাকি এর পেছনে ছিলেন। টাকা নিয়ে চাকরি না দেবার অভিযোগ উঠলো সেখানে। প্রাক্তন বিজেপি এম এল এ অশোক শর্মা এই সেদিনে ওনার সোশ্যাল মিডিয়াতে লিখেছেন ২০১৫ তে আসা এক নেতা বিজেপির পুরনো নেতাদের অপমান করছে সরিয়ে দিচ্ছে। ২০১৫ তে হিমন্ত বিশ্বশর্মা কংগ্রেস ছেড়ে বিজেপিতে গেছে, এই বাংলার কথা তো সব্বার জানা। সব মিলিয়ে দেশজুড়ে বিজেপির সংগঠনে প্রবলেম অফ গ্রোথ ভারি স্পষ্ট হয়ে দেখা দিচ্ছে। এরসঙ্গে বিজেপির আরেক নতুন সমস্যা মাথা চাড়া দিচ্ছে তা হল এক উগ্র হিন্দুত্ব, মোদিজী জানেন, অমিত শাহ জানেন, মাঝে মধ্যে গান্ধী মূর্তিতে মালা দিতে হবে, মাঝে মধ্যে নেহেরুকে গালি দিতে হবে, মাঝে মধ্যে মুসলমানদের মধ্যে পাশমান্দাদের জন্য চোখের জল বওয়াতে হবে মাঝে মধ্যে তাদের পিটিয়ে মারলে চুপ করে থাকতে হবে। কিন্তু যে বিরাট হিন্দুত্ব বাহিনী তৈরি হয়েছে তারা এই ধৈর্যতে বিশ্বাসী নন, তাঁরা আজই হিন্দু রাষ্ট্র চান, কাজেই বিভিন্ন ঘটনা ঘটছে যা সিভিল সোশিটির মানুষজন, এমনিতে যাঁদের অনেকেই মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় বলেই মনে করেন, তাঁরা ঘাবড়ে যাচ্ছেন। আর আপাতত শেষ সমস্যা হল মিডিয়া, বিকল্প সংবাদ মাধ্যম ছড়িয়ে গেছে সর্বত্র, তাদের সামলানো যাচ্ছে না, কতজন কেই বা জেলে পোরা যাবে, কাজেই খবর বেরিয়ে আসছে, সত্যিটা বেরিয়ে আসছে, টলমল করছে মোদি সাম্রাজ্য, হ্যাঁ উনিও কিরায়েদার, দেশ তো ওনারও বপৌতি সম্পত্তি নয়।