ইরান-ইজরায়েল সংঘাত আর ভারতের বিদেশনীতি নিয়ে কিছু বলতে গেলে আগে এই ইরান-ইজরায়েল সংঘাত, লড়াই, যুদ্ধ যাই বলুন তার ইতিহাসটাকে খানিক জানতেই হবে। একসময়কার মিত্র থেকে আজকের কট্টর শত্রু, ইরান ও ইজরায়েলের সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে জটিল আর সবচেয়ে খতরনাক, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের, বিভিন্ন রকমের সংঘাতের মধ্যে অন্যতম। নতুন তো কিছু নয়, কয়েক দশক ধরে চলছিল এই ছায়া যুদ্ধ, যা এখন এক সরাসরি সামরিক সংঘাত বা যুদ্ধের চেহারা নিয়েছে, এবং সেটা পুরো অঞ্চলের এমনকী পৃথিবীর স্থিতিশীলতাকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। ইতিমধ্যেই রাশিয়ার এক সেনাকর্তা বলেছেন, আমরা তৃতীয় বিশেযুদ্ধের দিকে এগোচ্ছি। এই পরিস্থিতিতে, ভারতের মতো একটা দেশের ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ? এমনিতেই তো আমরা আপাতত গাঁয়ে না মানলেও আপনি মোড়লের মতোই চলছি, তবুও এতবড় একটা দেশের কিছু গুরুত্ব তো থাকবেই। ভারত ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনের সমর্থক ছিল, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির শাসনামলে, ইজরায়েলের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ক শক্তিশালী হয়েছে, এটা আরব দুনিয়ার চোখ এড়িয়েছে, এমন তো নয়।
প্রথমে আসুন ইতিহাসের পাতা উল্টে দেখা যাক। দেখা যাক কীভাবে ইরান-ইজরায়েল সংঘাত তৈরি হল, কীভাবে মিত্রতা থেকে প্রকাশ্য যুদ্ধ হয়ে দাঁড়াল অবশ্যম্ভাবী। আজকের পরিস্থিতি দেখে কল্পনা করা কঠিন, কিন্তু ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের আগে ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে একটি কৌশলগত মিত্রতা, ট্যাকটিকাল ফ্রেন্ডশিপ ছিল। এই সম্পর্কের ভিত্তি ছিল ‘পেরিফেরি ডকট্রিন’ (Periphery Doctrine) বা প্রান্তীয় মতবাদ। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল আরব দেশগুলোর প্রভাব মোকাবিলা করার জন্য অ-আরব রাষ্ট্রগুলোর, যেমন ইরান, তুরস্ক এবং ইথিওপিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে ইজরায়েলের জোট গঠন করা। প্রথমত সহযোগিতার ক্ষেত্র ছিল তেল সরবরাহ। ইরান ছিল ইজরায়েলের তেলের অন্যতম প্রধান উৎস। আর ছিল গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদান। হ্যাঁ, ইরানের কুখ্যাত গোয়েন্দা সংস্থা সাভাক (SAVAK) এবং ইজরায়েলের মোসাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছিল। তারা একে অপরের শত্রু, বিশেষ করে মিশর ও সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে তথ্য বিনিময় করত। যখন ইজরায়েল মিশরের বিরুদ্ধে লড়ছে, গোয়েন্দা তথ্য জোগাচ্ছে ইরান। এবং ছিল সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা, ইজরায়েল ইরানকে সামরিক প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ করত। কিন্তু এই সম্পর্ক সরল ছিল না। শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলভি ফিলিস্তিনিদের দিকেও খানিক ঝুঁকে ছিলেন, আবার আরব বিশ্বের সঙ্গেও সুসম্পর্ক বজায় রাখার চেষ্টা করতেন। তাই ইরান কখনও ইজরায়েলে পূর্ণাঙ্গ দূতাবাস খোলেনি। মানে প্রকাশ্যে দহরম মহরম ছিল না, কিন্তু বেশ ভালো সম্পর্ক ছিল।
সব শেষ হল ১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের সময়েই। যা ছিল ইরানের এক আদর্শগত বিরাট পরিবর্তন, এক প্যারাডাইম শিফট। হ্যাঁ, আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খামেইনির নেতৃত্বে ১৯৭৯ সালের বিপ্লব সবকিছু বদলে দেয়। শাহের পতন হয় এবং ইরান একটি ইসলামি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। নতুন সরকারের কাছে ইজরায়েল ছিল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি ঘাঁটি এবং ‘ছোট শয়তান’ Little Satan। খামেইনির শাসনের মূল ভিত্তিই ছিল জায়নবাদ-বিরোধিতা এবং ফিলিস্তিনিদের মুক্তি। ওই ১৯৭৯ থেকেই ইজরায়েলকে একটা অবৈধ রাষ্ট্র হিসেবে দেখা শুরু হয় এবং ইরান নিজেকে ফিলিস্তিনিদের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে। আর তারই ভিত্তিতে গত কয়েক দশকব্যাপী ‘ছায়া যুদ্ধ’ Shadow War চলেছে। সেই বিপ্লবের পর থেকে প্রায় চার দশক ধরে ইরান ও ইজরায়েল সরাসরি যুদ্ধে যায়নি কিন্তু সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালেও একে অন্যের বিরুদ্ধে এক গোপন যুদ্ধ লাগাতার চালিয়ে গেছে। এই ছায়া যুদ্ধে বিভিন্ন কৌশল ব্যবহার করা হয়েছে। আর তার এক প্রমাণ হল ইজরায়েলের সাইবার হামলা। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হল স্টাক্সনেট Stuxnet ভাইরাস। ২০১০ সালে এই কম্পিউটার ভাইরাস ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলিতে হামলা করে এবং সেন্ট্রিফিউজগুলিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। অবশ্য অনেকেরই ধারণা, এটা ছিল একটি মার্কিন-ইজরায়েলি যৌথ অভিযান। মানে সেই সময় থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইজরায়েল, এমনকী পশ্চিম দুনিয়া ইরানকে এক পারমাণবিক শক্তি হিসেবে দেখতে চায়নি, আটকাতে চেয়েছে। আজও কিন্তু সেই লড়াইটাই চলছে। ট্রাম্প সাহেব সোজা বলে দিয়েছেন, পরমাণু অস্ত্র ইত্যাদি ছাড়লেই সব যুদ্ধ থেমে যাবে।
এদিকে ইজরায়েলের কাছে প্রচুর পরমাণু অস্ত্র আছে। ওই সময় থেকে আজ অবধি ইরানের বেশ কয়েকজন শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়েছে। ইরান এর জন্য সরাসরি মোসাদকে দায়ী করে। ওই সময় থেকেই দুই দেশই একে অপরের বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়েছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরান প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদকে সমর্থন করে এবং সেখানে নিজের সামরিক উপস্থিতি বাড়ায়। ইজরায়েল নিয়মিতভাবে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ইরানের সামরিক ঘাঁটি এবং অস্ত্র চালানে বিমান হামলা চালিয়ে আসছে। সেই লড়াই এখন সামনাসামনি, সরাসরি। দীর্ঘ কয়েক দশকের ছায়া যুদ্ধের পর, ২০২৫ সালের শুরুতে এই সংঘাত সরাসরি সামরিক রূপ নিল। দামেস্কে ইরানের কনস্যুলেটে ইজরায়েলি বিমান হামলায় একজন শীর্ষ ইরানি জেনারেল নিহত হওয়ার পর, ইরান সরাসরি ইজরায়েলের ভূখণ্ডে শত শত ড্রোন ও মিসাইল দেগে দেয়। যদিও ইজরায়েল ও তার মিত্ররা বেশিরভাগ হামলা প্রতিহত করতে পেরেছে, তবুও এটাই ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা যা সংঘাতের নতুন রাস্তা খুলে দেয় আর তারপর থেকে যুদ্ধ বেড়েই চলেছে। ইজরায়েল যেমন আমেরিকার সুপারি নিয়েই মধ্যপ্রাচ্যে লড়ছে, তেমনিই ইরানেরও এক প্রক্সির জাল আছে। সেগুলো হল প্রতিবেশী দেশ ও অ-রাষ্ট্রীয় শক্তি। ইরান সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে তার প্রভাব বিস্তার করতে এবং ইজরায়েলকে চাপে রাখতে বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ব্যবহার করে, যাকে ইজরায়েল, পশ্চিমি দুনিয়া ‘প্রতিরোধের অক্ষ’ (Axis of Resistance) নামে ডাকে। সে তালিকার প্রথমেই আছে হিজবুল্লাহ (লেবানন), এটা হল ইরানের সবচেয়ে শক্তিশালী আর সবচেয়ে সফল প্রক্সি। ১৯৮০-এর দশকে প্রতিষ্ঠিত এই শিয়া গোষ্ঠী আদতে লেবাননের রাজনীতি ও সামরিক ক্ষেত্রে এক প্রভাবশালী শক্তি। হিজবুল্লাহর কাছে হাজার হাজার রকেট রয়েছে যা ইজরায়েলের যে কোনও স্থানে আঘাত হানতে পারে, হানছেও।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | পরপর দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে, লজ্জায় মুখ বন্ধ শুভেন্দু-সুকান্তের
এরপরে আছে ফিলিস্তিন সংগঠনগুলো, (হামাস ও ইসলামিক জিহাদ): যদিও হামাস এক সুন্নি সংগঠন, ইরান আদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও ইজরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য হামাস আর ইসলামিক জিহাদকে অর্থ, অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে সহায়তা করে। আজ নয়, শুরু থেকেই। শেষে আছে ভয়ঙ্কর হুথি, এরা ইয়েমেনের। ইয়েমেনের এই বিদ্রোহী গোষ্ঠীর নেতা সৈন্যরা লোহিত সাগরে ইজরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক আছে এমন বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা চালিয়ে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে বিঘ্ন ঘটিয়েছে এবং সংঘাতের এক নতুন ফ্রন্ট খুলে দিয়েছে। এই হল মোটামুটি এই সংঘাতের ইতিহাস। এবারে আসুন ভারত এই সংঘাতে ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে সেটা বোঝার চেষ্টা করি। শুরুতেই এটা বলে নেওয়া দরকার যে ভারত গত কিছু বছর ধরে এক কৌশলগত পুনর্বিন্যাসের কথা ভেবেছে আর সেই মতো চলেছে, যার সঙ্গে আগের ভারতের বিদেশনীতির কোনও সূত্র নেই। স্বাধীনতার পর থেকে ফিলিস্তিনের প্রতি নীতিগত সমর্থন ছিল, মানে ১৯৪৭-১৯৯২, এ নিয়ে কোনও কথাই ওঠেনি। প্রথম বিচ্যুতি বা পুনর্বিন্যাস কিন্তু কংগ্রেস আমলেই হয়েছে, হ্যাঁ ওই নরসিমহা রাওয়ের সময়ে। আসলে ওই তাঁর সময় থেকেই কংগ্রেসের যাবতীয় কোর ভ্যালু, নেহরুভিয়ান অর্থনীতি থেকে শুরু করে বিদেশনীতি, সব কিছুই অত্যন্ত গুছিয়ে বদলে দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর থেকে ভারতের বিদেশনীতির একটি মূল ভিত্তি ছিল উপনিবেশবাদ-বিরোধিতা। এই নীতির ভিত্তিতেই ভারত ফিলিস্তিনিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে সমর্থন করে এবং ১৯৪৭ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জের ফিলিস্তিন বিভাজনের পরিকল্পনার বিরোধিতা করে। ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়েছিল ভারত, কিন্তু দূরত্বও বজায় রেখেছিল।
ভারত ১৯৫০ সালে ইজরায়েলকে স্বীকৃতি দিলেও, পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করেনি। এর অবশ্য কিছু প্র্যাকটিকাল রিজনও ছিল, প্রথমটা হল আরব দুনিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক: ভারত তার তেলের চাহিদা এবং বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনসংখ্যার কথা মাথায় রেখে আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে চায়নি। ছিল আমাদের দেশের জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলন। জোট-নিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতা হিসেবে ভারত ফিলিস্তিনিদের প্রতি তার সমর্থন বজায় রেখেছিল। এবং ছিল কাশ্মীর প্রসঙ্গ, ভারতের একটা আশঙ্কা তো ছিলই যে ইজরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ালে আরব দেশগুলো কাশ্মীর ইস্যুতে পাকিস্তানকে সমর্থন করতে পারে। তবে পর্দার আড়ালে কিছু গোপন সহযোগিতা ছিল। ১৯৬২ (চীন), ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ (পাকিস্তান) সালের যুদ্ধে ইজরায়েল ভারতকে গোপনে সামরিক সহায়তা দিয়েছিল, এটা আজ কারও অজানা নয়। এরপরে, মানে ঠান্ডা যুদ্ধের পরে, ঐ নরসিমহা রাও এর সময়ে হঠাৎ এক বাস্তবতার দিকে ঝোঁকের কথা বলা শুরু হয়। ওই ১৯৯২ সালে ভারত ইজরায়েলের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে। এর পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল, যেমন— সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন, ভারতের অর্থনৈতিক উদারীকরণ এবং মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি প্রক্রিয়ার সূচনা। এই সময় থেকে উভয় দেশের মধ্যে সম্পর্ক ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। আর সেই ধারাকে একদম কাছা খুলে সামনে নিয়ে এলেন আমাদের মোদিজি। মোদি যুগ হল আদতে ‘ডি-হাইফেনেশন’ আর ইজরায়েলকে কৌশলগত আলিঙ্গন, যা ক্রমশ বেড়েই চলেছে।
মোদিজির অধীনে ভারতের মধ্যপ্রাচ্য নীতিতে এক বড় পরিবর্তন এল, যা ‘ডি-হাইফেনেশন’ (De-hyphenation) বা পৃথকীকরণ নীতি নামে পরিচিত। এই ডি-হাইফেনেশন নীতি কী? এর মূল অর্থ হল, ভারত তার ইজরায়েল এবং ফিলিস্তিনের সঙ্গে সম্পর্ককে একে অপরের থেকে আলাদা করে দেখবে। অর্থাৎ, ফিলিস্তিনের প্রতি ভারতের ঐতিহাসিক সমর্থন ইজরায়েলের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারিত্বের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে না। আর এই নীতির জন্যই ভারত ও ইজরায়েলের মধ্যে সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ইজরায়েল এখন ভারতের শীর্ষ অস্ত্র সরবরাহকারীদের মধ্যে অন্যতম। দু’ দেশ যৌথভাবে মিসাইল সিস্টেম, ড্রোন এবং নানান সামরিক প্রযুক্তি তৈরি করছে। ইসরায়েলের জল সংরক্ষণ এবং কৃষি প্রযুক্তি ভারতের জন্য অত্যন্ত সহায়ক প্রমাণিত হয়েছে। মোদিই প্রথম ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী যিনি ইজরায়েল সফর করেন। এর মাধ্যমে তিনি সম্পর্কটাকে এক সরাসরি জায়গাতে এনে দাঁড় করিয়েছেন। আর সেটাই এখন ভারতের ভারসাম্য রক্ষার কঠিন প্রয়াস হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ লাগাতার সাপের মুখে চুমু আর ব্যাঙয়ের মুখে চুমু খেয়ে যাওয়াটা কঠিন। ইজরায়েলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ানোর পাশাপাশি ভারত ইরানের সঙ্গেও তার সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ইরানের চাবাহার বন্দর ভারতের জন্য মধ্য এশিয়ায় প্রবেশের একটি কৌশলগত পথ। এখন এই ইরান ও ইজরায়েলের মধ্যে সরাসরি সংঘাত শুরু হওয়ার পরে ভারতের এই ভারসাম্য রক্ষার নীতি পরীক্ষার মুখে পড়ে গেছে। ভারতের অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল রাখি।
খেয়াল করে দেখুন ভারত দু’ পক্ষকে সংযম দেখানোর আর আলোচনার মাধ্যমে উত্তেজনা কমানোর কথা বলে যাচ্ছে। সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার (SCO) বৈঠকে যখন ইজরায়েলের হামলার নিন্দা জানিয়ে একটি যৌথ বিবৃতি দেওয়ার প্রস্তাব আসে, তখন ভারত সেই আলোচনা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নেয়। ভারত একদিকে যেমন ইরানের সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট করতে চায়নি, তেমনই তার কৌশলগত অংশীদার ইজরায়েলের নিন্দাও করতে রাজি হয়নি। চেয়েচিন্তে নেমন্তন্ন নিয়ে মোদিজি গেলেন তো জি-সেভেন বৈঠকে, সেখানে ইজরায়েল, ইরান নিয়ে কোন পক্ষে তিনি থাকবেন? রাষ্ট্রসংঘেও এক দোনোমোনো অবস্থান। ইরান-ইজরায়েল সংঘাত আদর্শ, ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা এবং পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার এক জটিল মিশ্রণ, যা প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে আরও অস্থিতিশীল আর সেই জটিল আবহে ভারতের এই টলমল বিদেশনীতি আগামী দিনে এক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবেই, আর ঠিক যে বাস্তব কারণে ভারত এই ইজরায়েল ঘেঁষা নীতিতে ছিল না, সেই বাস্তব কারণগুলো আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে। আদর্শভিত্তিক অবস্থান থেকে সরে এসে ভারত এখন ‘ভারত প্রথম’ (India First) নীতি অনুসরণ করছে, যেখানে নাকি জাতীয় স্বার্থই সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাবে। ডি-হাইফেনেশন নীতির মাধ্যমে ভারত সফলভাবে ইজরায়েলের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছে, এবং একই সঙ্গে ফিলিস্তিনের প্রতি তার ঐতিহ্যগত সমর্থন ও ইরানের সঙ্গে তার কৌশলগত সম্পর্কও বজায় রেখেছে। এটা যুদ্ধের আগে পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরে কিন্তু দু’ শিবিরই কিন্তু বুঝে নিচ্ছে কে সঙ্গে? কে বিরুদ্ধে? নির্জোট থাকা এক ব্যাপার আর দোদুল্যমান থাকা আর এক ব্যাপার। মোদিজির বিদেশনীতি আগামী দিনে ভারতকে সারা বিশ্বের থেকে কতটা বিচ্ছিন্ন করবে তা দেখার জন্য আমাদের অসহায় হয়ে বসে থাকতে হবে।