সংবাদমাধ্যমে আজকাল ব্রেকিং নিউজের ছড়াছড়ি, অপেক্ষা সেই দিনের যেদিন সাতসকালে উঠে শুনবেন সেই বিরাট ব্রেকিং নিউজটা যাতে বলা হবে আজ সূর্য পূর্ব দিকেই উঠেছে, এবং আমরাই সেই খবরটা আপনাদের প্রথম জানালাম। এই ব্রেকিং নিউজের পরেই যা নিয়ে আমাদের সংবাদমাধ্যমে বেজায় শোরগোল ওঠে তা হল ‘বিস্ফোরক বক্তব্য’। কথায় কথায় আমাদের সংবাদমাধ্যমের অ্যাঙ্কর বা সাংবাদিকেরা বিস্ফোরক বক্তব্য খুঁজে পান। যেমনটা মাত্র গতকাল তাঁরা পেয়েছেন। সোমেন মিত্রের মূর্তি উদ্বোধনের সভায় গিয়ে বিস্ফোরক প্রদীপ ভট্টাচার্য। তো সেই বিস্ফোরণটা কী? মমতাকে বহিষ্কারের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে, বিস্ফোরক প্রদীপ। খবরের কাগজ খুলুন, বিভিন্ন চ্যানেলে এই বিস্ফোরণের খবর পাবেন, এক্কেবারে এই ভাষায়। তো কোথায়? ঠিক কোনখানে বিস্ফোরণ? মানে নতুনটা কী? কোন নতুন তথ্য দিলেন প্রদীপ ভট্টাচার্য? সেই ১৯৯৭-এ বহিষ্কারের আগে এ রাজ্যে কংগ্রেসের ভোট শতাংশ ৩০/৩২/৩৫-এর মধ্যে ঘোরাঘুরি করত, তারপর থেকে প্রতিটা নির্বাচনে কমেছে, এবং কমতে কমতে চার বছর আগে বিধানসভাতে শূন্য। এদিকে রিপ ভ্যান উইঙ্কল প্রদীপ ভট্টাচার্য হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখলেন কংগ্রেস খাদে পড়ে আছে, কী কাণ্ড। অতএব প্রথম সুযোগেই জানালেন, মমতাকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত ছিল দিল্লির, তা নাকি এমনকী সোমেন মিত্রের উপরেও চাপিয়ে দেওয়া হয়েছিল, আসল ভিলেন নাকি সীতারাম কেশরী আর সেই বহিষ্কারের পর থেকেই যে কংগ্রেস এই বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে দুধুভাতু হয়ে গেছে, সেটাও তিনি বুঝেছেন। তো ওই ‘বিস্ফোরক বক্তব্য’ নিয়ে চায় পে চর্চা শুরু কাজেই সেটাই আমাদের বিষয় আজকে মমতাকে নিয়ে প্রদীপ ভট্টাচার্য যা বলেছেন তা উনি বিশ্বাস করেন তো?
সেই ১৯৯৭, মমতার বহিষ্কার আর ১ জানুয়ারিতে দলের প্রতিষ্ঠা যদিও তার আগেই মধ্য ডিসেম্বরেই নির্বাচন কমিশনের কাছে নতুন দলের কেবন আবেদন নয়, পেয়ে গেছে দলের নির্বাচনী প্রতীক চিহ্ন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিজের আঁকা ঘাসফুল। আর সেই ১৯৯৮তেই লোকসভা নির্বাচনে ৭টা আসন তৃণমূলের, ভোট ২৪.৪ শতাংশ। ওদিকে কংগ্রেসের? একটা আসন, সেটাও কংগ্রেসের না বলে গনিখানের আসন বলাই ঠিক হবে, আর ভোট? ১৫.২ শতাংশ।
আরও পড়ুন: Aajke | একা মমতা, যেন রিং মাস্টার, ঝাঁকানি দিলেন নেতা মন্ত্রী আমলাদের
এরপরে ২০০১-এর বিধানসভা নির্বাচন। তৃণমূল ৩০.৬৬ শতাংশ ভোট আর ৬০টা আসন, কংগ্রেস ৭.৯৮ শতাংশ ভোট আর ২৬টা আসন। ২০০৬, মমতা সেবার এনডিএ-তে, সব আসনে না লড়েও ২৬.৬৪ শতাংশ ভোট আর আসন কমে ৩০, কংগ্রেস ১৪.৭১ শতাংশ, আসন কমে ২১। সেবার সংখ্যালঘু ভোট খুব স্বাভাবিকভাবেই মুখ ফিরিয়েছিল মমতার দিক থেকে। ২০১১, মমতা ভুল শুধরেই ক্ষমতায়, সঙ্গে কংগ্রেস। এরপর থেকে কংগ্রেস ধারাবাহিকভাবে কমতে কমতে ২০২১-এ ২.৯৩ শতাংশ ভোটে এসে ঠেকেছে আর আসন শূন্য। এই ধারাবাহিক পতনের সূত্রপাত সব্বার জানা ছিল, কেবল জানতেন না প্রদীপ ভট্টাচার্য আর আমাদের সংবাদমাধ্যম, তাই তিনি এতদিন পরে জানালেন এবং আমাদের সংবাদমাধ্যম কাছাখোলা হয়ে উদ্বাহু নৃত্য করতে শুরু করে দিল। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল এই সবার জানা তথ্যটাতে প্রদীপবাবু বিশ্বাস করেন তো? এই বাংলায় কংগ্রেসের উল্টোদিকে ছিল বামেরা, আজ নয় সেই স্বাধীনতার পর থেকেই, সেই বামেদের সঙ্গে এক গোপন যোগাযোগ ভেঙেই মমতার বেরিয়ে আসা, ইন ফ্যাক্ট মমতা বেরিয়ে আসেননি। তিনি ওই বাম কংগ্রেস বোঝাপড়া চক্রের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে বাংলার মানুষের সামনে নিজেকে বিকল্প হিসেবে দাঁড় করাতে চেয়েছিলেন, ওনাকে বহিষ্কার করা হলে সেই খবর সারা বাংলায় ছড়াবেন আর তিনিই বাম বিরোধী মানুষের সমর্থন পাবেন, সেটা বুঝেই তিনি যা করার করছিলেন, মানে সিপিএমকে লাগাতার আক্রমণ করা, কংগ্রসের মধ্যের বোঝাপড়া চক্রকে আক্রমণ করা, কংগ্রেস কেবল ফাঁদে পা দিয়েছে মাত্র। স্বাধীনতার আগে সুভাষচন্দ্র বসু যা করেছিলেন, ঠিক সেটাই অনুকরণ করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সারা ভারতে কংগ্রেস ভেঙে এক সফল রাজনৈতিক অস্তিত্ব কেবল এই দুজনেরই আছে। আর কংগ্রেসের দিল্লি নেতৃত্ব বা হাইকমান্ড এই দু’ জায়গাতেই চূড়ান্ত ভুল খেলেছেন, গান্ধীজির নিজের প্রতিনিধি পট্টভি সীতারামাইয়া হেরেছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর কাছে, আর মমতা ব্যানার্জি কংগ্রেসের জমির দখল নিয়ে কংগ্রেসকে এ রাজ্যে ভিখিরির অবস্থায় দাঁড় করিয়েছেন। এখন কংগ্রেসের যে কয়েকজন নেতা রাজনীতিটা করতে চান তাঁরা প্রত্যেকেই জানেন যে তৃণমূলের সঙ্গে জোট হলে তবুও ৯/১০/১১টা আসন পেলেও পেতে পারেন, জোট না হলে ১টা জুটবে কি না সন্দেহ আছে। কাজেই নির্বাচন আসার বছরখানেক আগে থেকেই এই জ্ঞানচক্ষুর উন্মোচন ঘটছে, ঘটবে। কংগ্রেস নেতৃত্বে থাকা আপাতত বচাখুচা নেতারা মমতার প্রতি অন্যায় থেকে মমতার জনদরদি মনের খোঁজ পেতে শুরু করে দেবেন, প্রদীপবাবুর বক্তব্য ছিল তার শুরুয়াত মাত্র। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, সেই ১৯৯৮ থেকে কংগ্রেসের ভোট, আসন এ রাজ্যে ক্রমশ কমছে, ২০২১ তা শূন্যে এসে দাঁড়িয়েছে, অথচ তারও প্রায় চার বছর পরে কংগ্রেস নেতা প্রদীপ ভট্টাচার্য হঠাৎ মমতার বহিষ্কারের ফলে কংগ্রেসের আজ এই দশা, সেটা বুঝতে পেরেছেন, সত্যিই বুঝেছেন নাকি এসব বলার পেছনে অন্য কারণ আছে? শুনুন মানুষজন কী বলছেন।
এমনিতে প্রদীপবাবুর নাম ছিল হেরো প্রদীপ, রাজনৈতিক মহলে ওনার এই নাম সব্বার জানা। ৭২-এ বর্ধমানে কীভাবে বিনয় চৌধুরিকে হারিয়েছিলেন সেটা কমবেশি সবাই জানেন। তারপর থেকে লাগাতার হার। সেই রাহুদশা কাটতে ২৪ বছর লেগেছিল। ১৯৯৬-তে হাজার পাঁচেক ভোটে জিতে লোকসভায় গিয়েছিলেন, এরপরে রাজ্যসভায় দুটো টার্ম, কার্টেসি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই তিনি আজ হঠাৎ যখন এই সত্য আবিষ্কার করেন, তখন স্বাভাবিক প্রশ্ন ওঠে হঠাৎ তাঁর এই ব্রেন স্টর্মিং কেন? তারপরেই মনে পড়ে মাত্র বছরখানেক পরেই এই রাজ্যে নির্বাচন আছে, কাজেই এখন থেকে অনেকের অনেক কথাই মনে পড়বে, অনেকে অনেক সারসত্য বুঝতে পারবেন, প্রদীপ ভট্টাচার্য সেই হঠাৎ বোধোদয়ের শুরুয়াতি খেলোয়াড় মাত্র।