একবারও মনে করবেন না যে আমি শুভেন্দু অধিকারীকে কার্তিকের সঙ্গে তুলনা করেছি। তুলনা করাই যাবে না কারণ কার্তিক ঠাকুর একটা নয়, দু’ দুটো বিয়ে করেছেন, দেবসেনা আর বালি তাঁর দুই স্ত্রীর নাম, একজন ইন্দ্রের কন্যা অন্যজন নাম্বিরাজের কন্যা। আর বিকাশ ভট্টাচার্যের সঙ্গে তুলনা করার কোনও প্রশ্নই নেই কারণ যে রাজনীতিই বিকাশ ভট্টাচার্য করুন না কেন তিনি দলবদলু নন। তাহলে এক ব্র্যাকেটে তিনজনের নাম এল কেন? আসলে চুরি নিয়ে কথা হচ্ছিল, চুরি আর চোরের তো অভাব নেই, সেই আবহে চুরির আলোচনা খুব স্বাভাবিক। তো বিকাশ ভট্টাচার্য সেই আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, চোরেদের দেবতা কার্তিক। ব্যস, সদ্য কাকে কী যেন বেশি খায়, সদ্য বিজেপি হলে হিন্দুত্ব নিয়ে তেমনই সেনসেটিভ হওয়াটাই স্বাভাবিক। হেমন্ত বিশ্বশর্মা থেকে শুভেন্দু অধিকারী তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তিনি ফোঁস করে উঠলেন, হিন্দু দেবদেবী নিয়ে ছেলেখেলা? আমাদের দেবতা কার্তিককে চোরেদের দেবতা বলে ঠাট্টা করা? হিন্দুত্বের অপমান, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, অতএব বিজেপিকে ভোট দিন, বচ্চে লোগ তালি বাজাও। আমি বলিনি, যিনি বলেছেন তাঁর কথার দায় নিচ্ছি না তবে তিনি একসময় এই শুভেন্দু অধিকারীর খুব ঘনিষ্ট ছিলেন তাঁর বাড়িতে নাকি পাত পেড়ে এই শুভেন্দু অধিকারী তাঁর এখনকার গুরুদেবদের ভাষায় নিষিদ্ধ মাংস খেয়েই ছাড় দেননি, দু’ বাটি সঙ্গে করে নিয়েও গেছেন। তবে শোনা কথায় কান দেবেন না আর তাছাড়া ওনার তৃণমূল তো পূর্বজন্ম, সে সময়ে তিনি এই আরএসএস-বিজেপি নিয়ে তো কত কথাই বলেছেন, সেসব পূর্বজন্মের কথা, সে জন্মের বাপ-মাকে দেখলে চেনারও কথা নয়, উনিও চেনেন না, উলটে চোখা চোখা গালিগালাজও করেন। সে যাই হোক আজকাল তিনি একনিষ্ঠ হিন্দু, তাই তিনি নিজেকে প্রমাণ করার জন্যেই ফোঁস করেছেন, বলেছেন বিকাশ ভট্টাচার্য হিন্দু দেবদেবীকে অপমান করেছেন, আর সেই জন্যেই এটাই বিষয় আজকে কার্তিক ঠাকুর, শুভেন্দু অধিকারী এবং বিকাশ ভট্টাচার্য।
এমনিতে খুব একটা সুযোগ নেই, না হলে শুভেন্দু অধিকারীকে ডেকে ক্লাস নিতাম, বোঝাতাম যে হিন্দু ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি নিয়ে কথা বলার আগে কিছু পড়াশুনো তো করতেই হবে, যা তিনি করেননি, করার কথাও নয়, মমতার অনুগ্রহে নেতা হয়েছেন, মন্ত্রী হয়েছেন, গুষ্টিসুদ্ধু প্রত্যেকের নেতা মন্ত্রী এমপি এমএলএ হওয়ার সুযোগ হয়েছে, তার জন্য তো হিন্দু শাস্ত্র পড়তে হয়নি, ইন ফ্যাক্ট কিছুই পড়তে হয়নি। আর পড়াশুনো না করে হিন্দু ধর্ম আর শাস্ত্র নিয়ে কথা বলাটা অন্যায়।
আরও পড়ুন: Aajke | কাজ করতে বলায় ডাক্তারবাবুরা চটে যাচ্ছেন কেন?
এবারে আসি বিকাশবাবুর কথায়। উনি বলেছেন কার্তিক চোরেদের দেবতা, ঠিক বলেছেন, উনি হাইকোর্ট পাড়ার মানুষ তায় সিপিএম সর্বোপরি একদা চোরপোরেশন নামে খ্যাত কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন, চোর এবং চুরি সম্পর্কে তাঁর সম্যক জ্ঞান থাকাটা তো স্বাভাবিক। এবারে আসুন সত্যি করেই জেনে নিই এই চোরের দেবতা কে? তেমন কেউ আদৌ আছেন কি না। প্রাচীন শাস্ত্রে বারো রকমের চুরির কথা বলা হয়েছে। আবার এমনও নয় যে কেবল হিন্দু ধর্মেই তা বলা হয়েছে, পাশ্চাত্য ধারণা অনুসারে চোরের দেবতা হলেন বুধ নক্ষত্র। শেক্সপিয়রের ‘দ্য উইন্টার্স টেল’ নাটকের অটোলাইকাস বুধ নক্ষত্রে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। মহাকাব্য ওডিসিতে অটোলাইকাসকে চোরেদের শিরোমণি বলা হয়েছে৷ হিন্দু চৌর্যশাস্ত্র ‘ষণ্মুখকল্পম’ অনুসারে চোরেদের দেবতা হলেন দেবসেনাপতি কার্তিক। তাকে তস্করাধিপতি বলা হয়। ‘ষণ্মুখকল্পম’-এ চুরিবিদ্যার বিস্তারিত বিবরণ আছে। বিবরণ মানে, সে এক গুরুমুখী বিদ্যা তাও বলা আছে, অন্তত পাঁচজনের নাম পাওয়া যাচ্ছে যাঁরা এই পাঠ পড়াতেন, কনকশক্তি, লম্বভূষকনন্দ, শকলিভাব, লম্বোকভূষণ আর মঙ্গল। এই পাঁচজনের মধ্যে ভাসের রচনা মৃচ্ছকটিকে কনকশক্তির নাম পাওয়া যাচ্ছে। ওই মৃচ্ছকটিকে আবার আরও দুজন তস্করাচার্যের নাম পাওয়া যাবে, ভাস্করনন্দি আর যোগাচার্য। চোর শার্বিলক এদেঁর বন্দনা করেই চুরি করতে ঢুকছেন। কৌটিল্যের অর্থশাত্রেও চৌর্যশাস্ত্রের উল্লেখ আছে। আর সেই প্রত্যেক জায়গাতেই কার্তিকই হলেন চোরেদের রাজা। তাঁকে বন্দনা করা হচ্ছে এই মন্ত্রে, ‘ওঁ বন্দেহহং মহাত্মানাং ময়ূরোপরি সংস্থিতম/ বিশ্বেশং শত্রুহন্তারং দ্বাদশাস্ত্রৈশ্চ শোভিতম/ তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভং নানালঙ্কারভূষিতম/ ষণ্মুখং পুত্রদায়কং তস্করাধিপতিং সুরম’। হ্যাঁ কার্তিক হলেন হিন্দু ধর্মের সেই তস্করাধিপতি। শুভেন্দু অধিকারি এত পড়াশুনে করে কথা বলবেন সেটা আমি কেন কেউই আশা করে না, তবুও এই কথাগুলো বলা কেন? বললাম আসলে এটা বোঝাতে যে এই আরএসএস বিজেপি হিন্দু ধর্মের কথা বলে, হিন্দুত্ব নিয়ে গর্ব করে, এরা হিন্দু ধর্মের কিছুই জানে না, এরা জানে কেবল হিন্দু মুসলমানে লড়িয়ে দেওয়ার কায়দাটা, এদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের সামান্যতম সম্পর্কও নেই। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম ধর্ম, উপনিষদ, ধর্ম শাস্ত্র নিয়ে ক’ অক্ষর গোমাংস শুভেন্দু আসলে হিন্দু ধর্ম নিয়ে কিছুই না জেনে কেবল হিন্দু মুসলমানকে লড়িয়ে দেওয়ার কায়দাটাই জানেন, সেটাই তিনি করে চলেছেন। আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
যদি শুনে থাকেন শুভেন্দুবাবু তাহলে এবারে যখন দিল্লিতে আপনার অধুনা অভিভাবকদের সঙ্গে দেখা করতে যাবেন তখন একটা কার্তিক ঠাকুরের মূর্তি নিয়ে যাবেন, দিল্লির কেন্দ্রীয় অফিসে রাখবেন, আর সঙ্গে কাগজে লিখে নিয়ে যাবেন এই মন্ত্রটি, চোরেরা এই মন্ত্র দিয়েই চোরেদের দেবতাকে পুজো করে, ‘ওঁ বন্দেহহং মহাত্মানাং ময়ূরোপরি সংস্থিতম/ বিশ্বেশং শত্রুহন্তারং দ্বাদশাস্ত্রৈশ্চ শোভিতম/ তপ্তকাঞ্চনবর্ণাভং নানালঙ্কারভূষিতম/ ষণ্মুখং পুত্রদায়কং তস্করাধিপতিং সুরম’। দেখবেন কাজকর্ম ভালো এগোবে, আপনার অভিভাবকেরা খুশিই হবেন।