কাঠ খেলে তার পরিণাম সেদিনেই না আসুক পরদিন সকালে তো আসবেই। সেই কবেই বলেছিলাম, ডাক্তারবাবুরা বেড়ে খেলছেন, পরে সামলাতে পারবেন তো? এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন, ভীমরুলের কেক হাত দিয়ে ফেলেছেন। আসলে আমাদের এক পুরনো ইচ্ছে হল অধিকার অধিকার নিয়ে লড়ে যাওয়ার। সেই অধিকারের পিছনে যে কিছু দায়িত্ব থাকে সেটা আমরা প্রায়শই ভুলে যাই। জুনিয়র ডাক্তারদের বিপ্লবী নেতৃত্ব আর তাঁদের পিছনে থাকা জ্যাঠামশাইরা সেদিন দাবিপত্র নিয়ে হাজির হয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছে, সে দাবিতে রেস্ট রুম ছিল, তাঁদের সুরক্ষার জন্য পাহারাদারি ছিল, সিসিটিভি ছিল, আরও কতকিছু। সেদিন ওই দাবি না মিটলে কর্মবিরতির হুমকি দিয়েছিলেন তাঁরা, আর সত্যি করেই কর্মবিরতিতে গিয়েওছিলেন। সে এক আজব কর্মবিরতি, সরকারি হাসপাতাল থেকে মাইনে নেওয়া জুনিয়র ডাক্তারেরা সরকারি হাসপাতালে কর্মবিরতি করলেন, কিন্তু বায়োমেট্রিক অ্যাটেনডেন্সও দিলেন, মানে কর্মবিরতিও হল আবার মাইনেও যাতে ঢুকে পড়ে অ্যাকাউন্টে তারও ব্যবস্থা হল। ওদিকে সেই কর্মবিরতিতে ওনারা হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন তা কি হয়? ওনারা চলে গেলেন বেসরকারি হাসপাতালে, সেখানে কাজকর্ম করে টাকা কামালেন শুধু তাই নয়, সেখানে আসা পেশেন্টদের স্বাস্থ্যসাথীর বিলও পাশ করে দিলেন। মানে সরকারের টাকা খরচ করালেন, যে রোগীরা বিনা পয়সাতে চিকিৎসা পেত, তাঁরা সরকারি হাসপাতালে কর্মবিরতি চলায় বাধ্য হয়েই গেলেন বেসরকারি নার্সিং হোমে, সেখানে চিকিৎসা করালেন, স্বাস্থ্যসাথীর টাকা খরচ হল। কিন্তু এসবের পরেও তাঁদের দাবি পেশ করা তো থামেনি। সরকার প্রায় সব দাবি মেনে নিয়েছে, তার কিছু পূরণ হয়েছে, কিছু বাকি আছে, যার কাজ চলছে বলে সরকার জানিয়েছে। ওদিকে ওনাদের জ্যাঠামশায়েরা আরও এককাঠি সরেস, তেনারা সাদা কাগজে পদত্যাগ করে বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক বলে রাস্তায় নামলেন কিন্তু আসলে পদত্যাগ করেননি, একজনও না। তেনারাও দিব্যি কাজ করছিলেন, হাসপাতালে কম, নার্সিং হোম বা প্রাইভেট চেম্বারে বেশি। এই পর্যন্ত সবটাই ইচ্ছেপূরণের গপ্পো। এইবারে এসেছে নতুন গল্প। সরকার এবারে তাঁদের দাবিপত্র পেশ করেছে, জানিয়ে দিয়েছে গ্রামের হাসপাতালে যেতে হবে সমেত বেশ বড় সড় একটা নির্দেশিকা, ব্যস। ওই যে বললাম, অধিকারের কথা বলাটা আমাদের অভ্যেস, কিন্তু দায়িত্বের কথা মনে করালেই খচে বোম। আর সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কাজ করতে বলায় ডাক্তারবাবুরা চটে যাচ্ছেন কেন?
রাজ্যের স্বাস্থ্য দফতর একগুচ্ছ নির্দেশিকা বার করেছে, তার ১ নম্বর হল, গ্রামে যেতে হবে, মানে সেই নির্দেশিকাতে বলা হয়েছে সিনিয়র রেসিডেন্ট ডাক্তারদের চাকরির শুরুতে তিন বছরের মধ্যে এক বছর নিজের কলেজে আর বাকি দু’ বছর গ্রামীণ হাসপাতালে ডিউটি করা বাধ্যতামূলক, না গেলে তাঁদের ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হবে, ২৩ ডিসেম্বর এই সার্কুলার এসেছে। তাঁরা ৬৫-৭৫ হাজার টাকা ভাতা পেয়ে থাকেন, এবং শুধু নির্দেশিকাই নয়, ৩১ জন এমন ফাঁকিবাজকেও চিহ্নিত করা হয়েছে, তাঁদের ২০ লক্ষ টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার নির্দেশও দেওয়া হয়েছে। এই জিনিস বহু বছর ধরেই চলছে, এবারে সরকার তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিলেন।
আরও পড়ুন: Aajke | নেতাজির পরে একমাত্র মমতা, কংগ্রেসের সফল বিদ্রোহী
এরপরে দিন দুই আগে আবার নির্দেশিকা এসেছে, তাতে বলা হয়েছে একটা নন প্র্যাক্টিসিং অ্যালাউন্স আছে, কেবল সেটা ছেড়ে দিলেই সরকারি ডাক্তারেরা প্রাইভেট প্রাকটিস করতে পারবেন এমন নয়, তাঁদেরকে পারমিশন নিতে হবে। এর সঙ্গেই বলা হয়েছে যে সকাল ৯টা থেকে বিকেল চারটে পর্যন্ত প্র্যাকটিস করা যাবে না, এটাও বলা হয়েছে যে নিজের কর্মস্থলের ২০ কিলোমিটারের বাইরে প্র্যাকটিস করা যাবে না। মানে চাকরি করছেন শিলিগুড়িতে আর কলকাতায় চেম্বার খুলে বসেছেন, তা করা চলবে না। এইসব নির্দেশিকায় খুব রেগে গেছেন অ্যাসোশিয়েশন ফর হেলথ সার্ভিস ডক্টর্স-এর সাধারণ সম্পাদক উৎপল ব্যানার্জি, তিনি বলেছেন যে তাঁদের হাত-পা বেঁধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করা চেষ্টা চালানো হচ্ছে। কোনটা স্যর? চাকরির চুক্তি অনুযায়ী গ্রামে যাওয়ার কথা বলাটা প্রতিহিংসা মনে হচ্ছে? নাকি সরকারি চিকিৎসকদের এক অংশ হাসপাতালে বুড়ি ছোঁওয়া সেরেই চেম্বারে চলে যাচ্ছেন রোগী দেখতে বা শিলিগুড়িতে চাকরি, দু’দিন থেকেই কলকাতার নার্সিং হোমে চিকিৎসা দেওয়ার ব্যাপারটা আটকালেই প্রতিহিংসা বলে মনে হচ্ছে? একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন মানুষ বেজায় খুশি, তাঁরা দিনের পর দিন তাঁদের গ্রামীণ হাসপাতালে ডাক্তার পাননি, তাঁরা মহকুমা হাসপাতালে গিয়ে ডাক্তারের দেখা পাননি, তাঁরা কিন্তু বেজায় খুশি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, সরকারি চাকরি করা ডাক্তারবাবুদের প্রাইভেট প্র্যাকটিসের উপরে সরকার কিছু নির্দেশ জারি করেছেন, যাতে করে সেই সব সরকারি ডাক্তারবাবুরা সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টে পর্যন্ত প্রাইভেট প্র্যাকটিস না করতে পারেন, যেন তাঁরা তাঁদের কর্মস্থলের ২০ কিলোমিটারের বাইরে প্রাইভেট প্র্যাকটিস না করতে পারেন, চুক্তিবদ্ধ ডাক্তারদের দু’ বছরের জন্য গ্রামের হাসপাতালে যেতেই হবে। এইসব নির্দেশ পাওয়ার পরে ডাক্তারবাবুরা বেজায় ক্ষুব্ধ, তাঁরা বলেছেন তাঁদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা মেটাচ্ছেন রাজ্য সরকার। আপনাদের মতামত কী? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
অধিকারের লড়াই লড়ার সময়েই আমাদের প্রত্যেককে মাথায় রাখতে হবে দায়িত্বের কথা। নিজেদের অধিকারের লড়াই কখনও একটা ওয়ান ওয়ে ট্রাফিক তো হতে পারে না, তার উল্টোপিঠেই থাকবে দায়িত্বের কথা। শ্রমজীবী মানুষজন, শিক্ষক, ডাক্তার, প্রফেশনাল মানুষজন কাজ করবেন, আরও বেশি মাইনে, মজুরি চাইবেন, সেটা খুব স্বাভাবিক, কিন্তু তার সঙ্গেই তো তাঁকে তাঁর দায়িত্বের কথাও ভাবতে হবে। মিছিল মিটিং জনসভাতে দিতে হবে দিতে হবে দাবি-দাওয়ার কথা বললাম আর দায়িত্ব এড়িয়ে গিয়ে নিজের পকেট ভরলাম তা তো হয় না। ধন্যবাদ রাজ্য সরকারকে যাঁরা এই দরকারি কাজগুলো করছেন, মানুষ এই সিদ্ধান্তের পাশে থাকবে, দু’ হাত তুলে সমর্থন জানাবে।