আমও গেছে, ছালাটাও যেতে বসেছে। হ্যাঁ, শুভেন্দু অধিকারীর আপাতত অবস্থা নিয়ে কথা বলতে গেলেই প্রথমে এই কথাটাই মাথায় আসবে। গুষ্টিসুদ্ধ প্রত্যেকের হয় মন্ত্রিত্ব ছিল, নয় সাংসদ পদ না হলে মিউনিসিপালিটি, ওদিকে সমবায় সমিতি, হলদিয়াতে রকমারি ব্যবসা। কিন্তু ওই যে বলে না খাচ্ছিল তাঁতি তাঁত বুনে কাল হল এঁড়ে গরু কিনে। এখন সব গেছে। বিজেপির তো দেশজুড়েই ভাঙো জোড়ো, ভাঙো জোড়ো ফরমুলাতেই দল চালানোর এক পদ্ধতি ইতিমধ্যেই আমরা ইতিমধ্যেই জেনে গেছি। ফরমুলাটা খুব পরিষ্কার, প্রথমে বিরোধী সেই দলকে বন্ধুত্বের খবর পাঠাও, তারা না রাজি হলে ধমক, জেল, ইডি, সিবিআই। কিন্তু তাতেও রাজি না হলে দলের উচ্চাকাঙ্ক্ষীদের বাছো, তাদের দিয়ে দল ভাঙো। প্রথম উদাহরণ নীতীশের জেডিইউ বা চন্দ্রবাবু নাইডুর টিডিপি, আর দ্বিতীয় উদাহরণ অজিত পওয়ার, একনাথ শিন্ডে। আর দলকে বিরাটভাবে ভাঙতে পারল না কিন্তু তাকে দলে এনে সেই রাজ্যে বিজেপির মাথা করে তোলার চেষ্টা, এটাও আর এক পদ্ধতি, যে ফরমুলাতে তারা জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়াকে ভেঙে মধ্যপ্রদেশ হাতে রেখেছে, অসমে হেমন্ত বিশ্ব শর্মাকে কংগ্রেস থেকে নিয়ে গিয়ে অসম ধরে রেখেছে, যে ফরমুলাতে মিলিন্দ দেওরা, গৌরব বল্লভ, শেজাদ পুনাওয়ালা, রীতা বহুগুণা, অমরিন্দর সিং বাদল, আর পি এন সিং, জিতিন প্রসাদ ইত্যাদিকে নিয়ে বিজেপির নেতা করেছে। সেই ফরমুলাতেই আমাদের কাঁথির খোকাবাবুকে বিজেপিতে এনে বাংলা দখল করার স্বপ্ন দেখেছিল বিজেপি। কিন্তু আজ সেই স্বপ্নে টন টন গ্যামাক্সিন ছিটিয়েছে তৃণমূল। আপাতত বিজেপিকে ক্ষমতায় আনা তো দূরস্থান, নিজের অস্তিত্ব ধরে রাখাই শুভেন্দু অধিকারীর কাছে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, কাঁথির খোকাবাবুর পায়ের তলার মাটি কেটে নিচ্ছে তৃণমূল।
বিজেপি মুকুল রায়কে জয়েন করিয়েছিল, কিন্তু মুকুল রায় ছিলেন তৃণমূলের মমতার সহচর, মমতার নির্দেশ মেনে চলতেন, মমতা হ্যাঁ বললে হ্যাঁ, মমতা না বললে না। এর বাইরে তেনার কোনও স্বাধীন অস্তিত্ব ছিল না বা আরও বলা ভালো তিনি সেরকম কথা ভাবতেনও না। কিন্তু এই ইডি আর সিবিআই-এর সাঁড়াশি আক্রমণে বিপর্যস্ত মুকুল রায় বিজেপিতে গিয়েছিলেন বটে, তবে বিজেপিও তাঁর কাছ থেকে ভেতরের কথা ইত্যাদি ছাড়া খুব বেশি কিছু আশাও করেনি, কিন্তু শুভেন্দু অধিকারী?
আরও পড়ুন: Aajke | রিমঝিম অপর্ণাদের অরাজনৈতিক সংগঠন, উদ্দেশ্যটা কী?
বিজেপি ভেবেছিল কেল্লাফতে। সঙ্গে কিছু চার আনা, দু’ আনা নেতা বিধায়কও ছিল কিন্তু আসল আলো পড়েছিল শুভেন্দুর গায়ে, ইনি নাকি পাল্টে দেবেন সরকার। স্লোগান উঠলো অব কি বার দোশো পার। কিন্তু শুভেন্দু দলের দিল্লি নেতাদের জানিয়েছিলেন দুশো হবে না, কিন্তু অনায়াসে ১২০-১২৫ হয়ে যাবে। আর তারপরে তিনি বিভিন্ন হোটেলে আলোচনাতে বসেছিলেন কিছু তৃণমূল নেতাদের সঙ্গে যাঁদের আশ্বাস ছিল ১২০-১২৫ হলে তাঁরা ৪০-৫০ জন একসঙ্গে বিজেপি জয়েন করবেন, কাজেই ভোটের পরে সরকার বিজেপির। দিল্লি সেই স্বপ্নে মশগুল ছিল। ভোট শেষে একরাশ স্বপ্নভঙ্গ। এরপরেও তাঁরা ভরসা রাখলেন ওই কাঁথির খোকাবাবুটির ওপরে, ২০২৪-এ ১৮ থেকে কমসম করে ২৯-৩০টা আসন আর তারপরেই আবার সেই সরকার পড়ে যাওয়ার গল্প। শুভেন্দু সেই গল্পের মধ্যমণি। রেজাল্টের পরে মুখ পুড়ল। আর তারপর থেকে ধারাবাহিকভাবে ওই কাঁথি, পূর্ব আর পশ্চিম মেদিনীপুর থেকে ধসের খবর। রোজ হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে নির্বাচিত পঞ্চায়েত, দলের নেতারা তৃণমূলে যাচ্ছেন এমনকী অমন প্রেস্টিজিয়াস কাঁথি সমবায়, যে নির্বাচনের জন্য কেন্দ্রীয় বাহিনি আনা হল, সেখানেও গোহারান হার, তার আগে আরজি কর ইস্যুতে দাঁতও ফোটাতে পারেনি বিজেপি। সবমিলিয়ে একটা সময়ে তো অ্যানুয়াল পরীক্ষার ফলাফল বেরিয়ে যায়, এখানেও তাই হয়েছে, বিজেপি নেতারা বুঝতে পেরেছেন অপাত্রে ঘি ঢালা হয়েছে। বড়জোর একটা কি দুটো এমপি আর সাত-দশটা বিধায়ক জিতিয়ে আনতে পারে এমন এক নেতাকে ওনারা মাথায় তুলে নাচছিলেন, সেটা এখন ওনাদের কাছে সাফ হয়ে গেছে। অন্যধারে দলের মধ্যে কোণঠাসা শুভেন্দুর বাম আর ডানপাশে পায়ের তলার মাটি কাটছে তৃণমূল। আর সেই কাজ আপনা আপনিই গতি পাবে দিঘার জগন্নাথ দেব মন্দির উদ্বোধন হওয়ার পরে। ২০২৬-এ আপাতত শুভেন্দুর একমাত্র লক্ষ্য তাঁর নিজের আসনটাকে ধরে রাখা যা এখনই ভোট হলে অনায়াসে হারবেন তিনি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে এই মুহূর্তে নির্বাচন হলে শুভেন্দু অধিকারী ওনার নন্দীগ্রাম আসন থেকে জিতে আসতে পারবেন? ওই আসনে আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী হলে কে জিতবে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আসলে কায়া আর ছায়ার মধ্যে একটা তফাৎ তো থাকেই, এ রাজ্যে ভালো মন্দ মাঝারি যাই হোক না কেন, সিপিএম বিজেপির বিরোধিতা করে তৃণমূলকে এই অবস্থাতে নিয়ে এসেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বাকি প্রত্যেকে ওনার আলোয় আলোকিত, বাকি প্রত্যেকেই ওনার সহযোগী। ওনার বৃত্তের মধ্যে কাছাকাছি বা বাইরে একজনও নেই যাঁর পক্ষে এক স্বাধীন ক্ষমতা নিয়ে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে তোলার ন্যূনতম ক্ষমতাও আছে। কাজেই বৃদ্ধ শরদ পওয়ারের বদলে অজিত পওয়ার বা কেবল বালাসাহেব ঠাকরের পুত্রের বদলে শিবসৈনিক একনাথ শিন্ডের উঠে আসার সঙ্গে শুভেন্দু অধিকারীর তুলনা বেমানান। ওনার পায়ের তলার মাটি খসে যাচ্ছে, ওনার পপাত চ, মমার চ হয়ে আছাড় খেয়ে পড়াটা এখন সময়ের অপেক্ষা।