সে তখন নতুন করে দার্জিলিংয়ে গোর্খাদের আন্দোলন, গুরুং আত্মগোপনে, সেই সময়ের কথা। এক আইপিএস কর্তাকে পাঠানো হয়েছে অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য, এমনিতেই সেই পুলিশকর্তা পিটিয়ে ঠান্ডা করার কাজে নাম কামিয়েছিলেন, তো তিনি স্ত্রী-কন্যাকে রেখেই দার্জিলিং রওনা দিলেন। সেখানে গিয়েই একটা খবর পেলেন গুরুং আছে অমুক আস্তানায়, বেরিয়ে পড়লেন, এক জায়গাতে এসে গাড়ি আর যাবে না, এবার পাকদণ্ডী বেয়ে হেঁটে উঠতে হবে, টিম ভাগ করে ছোট একটা টিম নিয়ে তিনি হাঁটা দিলেন, তখন বিকেল। মিনিট ২০ চলার পরে হঠাৎই তিনি খেয়াল করলেন কেউ নেই, পিছনে কেউ নেই, তাঁর টিমের কাউকে দেখা যাচ্ছে না, এদিকে তাঁর হাতে সার্ভিস রিভালবার ছাড়া কিছুই নেই, তিনি চুপ করে দাঁড়িয়ে পড়লেন, তাঁর ভাষায়, সেই সময়ে কেউ অ্যাটাক করলে জানি না কী হত। মিনিট পাঁচেক পরে তাঁর টিমের লোকজনরা আসতে শুরু করল, তাঁরা হাঁপাচ্ছে। হ্যাঁ, এটাই সেই ফিটনেস প্রসঙ্গ, যা এক নজরেই আপনি দেখতে পাবেন আমাদের আইপিএস অফিসারদের মধ্যে, খুব কম ব্যতিক্রম আছে। কিন্তু উল্টোদিকে তাঁদের ফোর্সের চেহারাটা ঠিক উল্টো, থানার বড়বাবুদের দেখলে কুমড়োপটাশের কথা আগে মনে পড়ে, দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা সিপাহি থেকে মেজো সেজো ন’ বাবুদের চেহারাও আলাদা কিছু নয়। অথচ এঁরাই তো অগ্রণী বাহিনী। গল্প আছে, বড়বাবু চোরের পেছনে ছুটতে ছুটতে বলছেন, যা কষ্ট দিচ্ছিস, ধরলে সব সুদে আসলে আদায় করে নেব। মানে বক্তব্য খুব পরিষ্কার, অত ছোটাস না। আজ সেই গল্প, সেটাই বিষয় আজকে, রোগা পুলিশ, মোটা পুলিশ।
গল্পের শুরুটা বনগাঁয়ের শেয়াল রাজাকে নিয়ে নয়, বনগাঁয়ের এসপিকে নিয়ে, দীনেশ কুমার। তাঁর নজরে এল তাঁর বাহিনীর স্থুল চেহারা, ওজন পাল্লায় চড়লে ওজন পাল্লা ভেঙে যাবে এমন সব চেহারার বিশাল ভুঁড়িওলা কনস্টেবল, সেপাই, পুলিশ। তো তিনি ঘটা করে তাঁদের একটা করে যোগব্যায়াম করার ম্যাট আর স্মার্টওয়াচ দিলেন, মিশন ওজন কমাও শুরু হল। আর কে না জানে ওই হাঁটা আর ব্যায়ামে শরীরের ফিটনেস বাড়ে বটে, কিন্তু ওজন তো কমে না, ওজন কমানোর স্রেফ একটাই উপায়, ক্যালরি ইনটেক মাইনাস ক্যালোরি বার্ন। শরীর সাধারণভাবে কত ক্যালোরি জ্বালাচ্ছে, আর আপনি কতটা ঠুঁসছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | প্রসূতি মৃত্যু, গাফিলতি কার? ডাক্তারবাবুরা কতখানি দায়ী?
ধরুন আপনার শরীরের রোজ লাগে ১৪০০ ক্যালোরি, আর আপনি খাচ্ছেন ২০০০ ক্যালোরি, তাহলে ওই ৬০০ ক্যালোরি আপনার শরীরের বিভিন্ন অংশে জমা হবে, চর্বি হয়ে ঝুলতে থাকবে। রোজ জমা হবে। কিন্তু আপনি যদি ১০০০ বা ১১০০ ক্যালরি খান, তাহলে আপনার শরীর ওই জমে থাকা ফ্যাটগুলোকেই জ্বালাবে, কাজে লাগাবে, আপনার চর্বি কমবে, আপনার ওজন কমবে, বেলি ফ্যাট কমবে, মোদ্দা বাংলায় ভুঁড়ি কমবে। এইভাবেই বুঝিয়েছিলেন তাঁর বাহিনীর ওই স্ফীতোদরদের, ভুঁড়িওলা সেপাইদের। এবং মজার কথা হল তাঁরা চিনি, ফাস্টফুডের দিকে তাকাননি, ভাত রুটির পরিমাণ কমিয়েছেন এবং শেষমেশ ফল ফলেছে, দুজনকে অন্তত সংবাদমাধ্যমের সামনে দাঁড় করানো গেছে যাঁরা ১০-১২ কেজি ওজন একমাসেই কমাতে পেরেছেন। এক বিরাট অ্যাচিভমেন্ট। ৯৪ কেজির রমেন দাস কমিয়েছেন ১২ কেজি চর্বি, এখন তিনি ৮২ কেজির পুলিশ, আর মিঠুন ঘোষ কমিয়েছেন ১০ কিলো, তিনি ৮১ থেকে ৭১। কিন্তু কহামি মে টুইস্ট হ্যায়, টুইস্টটা হলো এসপি দীনেশ কুমার এই যোগব্যায়ামের ম্যাট আর স্মার্টওয়াচ দিয়েছিলেন ১৫০ জন পুলিশকে, তাঁদের সামনে রোগা হওয়ার উপযোগিতা নিয়ে বিশদ ব্যাখ্যাও করেছিলেন, শুনেছেন মাত্র ২ জন। আপনি বলতেই পারেন, মানে প্রশ্ন করতেই পারেন যে বাকিরা শোনেননি কী করে জানলেন? বনগাঁ জেলা পুলিশের ফেসবুক পেজটা খুলুন, এই দুজন, মানে এই রমেন বাবু আর মিঠুন বাবু ছাড়া অন্য কারও উল্লেখ নেই। যদিও আমার আপনার মতো কেরানিগিরি বা শিক্ষক বা সাংবাদিক বা ব্যাঙ্ককর্মী তো এঁরা নন, এনাদের চাকরির শর্তই হল নিজেকে ফিট রাখতে হবে। বিশাল ভুঁড়ি নিয়ে থলথলে চেহারায় আর যাই হওয়া যাক পুলিশ হওয়া যায় না, পুলিশের ভুঁড়ি নিয়ে জনস্বার্থ মামলাও হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। যে পেশার যে শর্ত তা তো সবাইকেই মানতে হবে, এক আইপিএস অফিসার উদ্যোগ নিয়েছেন, দুজন সেই উদ্যোগে সাড়া দিয়ে নিজেদের ফিট করে তোলার চেষ্টা করে অনেকটা ফলও পেয়েছেন, কিন্তু বাকিরা? ওই এসপি সাহেব তো ছ’মাস পরেই আবার অন্য কোথাও অন্য কোনওখানে, কাজেই যোগব্যায়াম ম্যাটে বসে তাস খেলা হোক আর নোয়াপাতি ভুঁড়ি নিয়ে চাকরি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, চোখ মেললেই বিশাল ভুঁড়িওলা, থলথলে চেহারার, প্রচণ্ড হাঁসফাস করা পুলিশ সিপাহি আমরা দেখি, পুলিশের চাকরির শর্ত কি এক সুঠাম চেহারা, এক স্লিম ফিট বডি হওয়া উচিত নয়? রাজ্য সরকার কি পুলিশ বাহিনীর প্রত্যেকের ক্ষেত্রে এই শর্ত আবশ্যিক করে দিতে পারে না? স্লিম, ফিট পুলিশ বাহিনী কি আরও অনেক দক্ষ হয়ে উঠবে না? আপনারা কী বলেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সুপারিনটেনডেন্ট অফ পুলিশ নিজে উপস্থিত হয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন বাহিনীকে ফিট হয়ে ওঠার, ১৫০ জনকে যোগব্যায়ামের ম্যাট আর স্মার্ট ওয়াচও দিচ্ছেন, তাঁর নির্দেশ পালন করছেন মাত্র দু’জন, এর থেকে লজ্জার খবর কি আর কিছু হতে পারে? এই মুহূর্তে ওই দুজন পুলিশ যাঁরা তাঁদের চেষ্টায় খানিক ফিট হয়ে উঠতে পেরেছেন তাঁদের পুরস্কৃত করা উচিত, আর বাকিদের কেবল তিরস্কার নয়, ফাইন করা উচিত, এক নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ওজন কমিয়ে নিজেকে ফিট না করে তুলতে পারলে চাকরি কেড়ে নেওয়া উচিত। অঙ্কের মাস্টারমশাই অঙ্ক পারবেন না, গানের মাস্টারমশাইয়ের গলায় সুর নেই, ডাক্তারবাবু পালস দেখতে জানেন না, ইঞ্জিনিয়ার সাহেব সেন্টিমিটার আর ফিট-এর তফাৎ বোঝেন না, এরকম হলে কেউ মেনে নেবেন? তাহলে আমাদের সুরক্ষা শান্তি বজায় রাখার জন্য ওই থলথলে বিশাল ভুঁড়িওলা পুলিশকেইবা আমরা মেনে নেব কেন?