রাজনীতিতে দলমত নির্বিশেষে কিছু মানুষ থাকেন যাঁদের কালারফুল বলা হয়। সাংবাদিকরা জানেন সে সব মানুষজনের নাম, একটা ফোন করলেই মরা খবরের দিনে, তেমন কিছুই নেই এমন দিনেও হেডলাইন দিয়ে দিতে পারেন এনারাই। সব দলেই এমন সব লোকজন আছেন। দলে আছেন দলের জন্ম থেকে, মন্ত্রিসভাতে ছিলেন তাও প্রায় ২৫-৩০ বছর, কিন্তু সেই রেজ্জাক মোল্লা বললেন হেলে ধরতে পারে না কেউটে ধরতে গেছে। হ্যাঁ, এক সময়ের সহকর্মী বুদ্ধ ভট্টাচার্যকে, ব্যস, হেডলাইন। এই কথা কিন্তু তিনি গত ২০-২৫ বছরে একবারও বলেননি। উনি মুখ খুললেই খবর হত। এরকমই ছিলেন সুব্রত মুখোপাধ্যায়, আছেন দিলীপ ঘোষ বা কেষ্ট মোড়ল। কিন্তু এই এনাদের এক চিপ ভার্সান, এনাদের এক সস্তার মডেল হলেন মদন মিত্র, বাংলার রাজনীতিতে এক ভাঁড়ের ভূমিকাতে বেশ কিছুদিন ধরেই আছেন, কিছু একটা বলেন, হই চই হয়, তারপরে তিনি সেই কথা হয় ফেরত নেন না হলে ক্ষমা চেয়ে নেন। আজ নয়, বহুকাল ধরেই এটাই মদন সিনড্রোম, এখন দল বা বিরোধী দলেরও উত্তেজনা জাগে না ওনার এইসব চাঞ্চল্যকর বক্তব্যে, খবর আর হেডলাইন হয় না, কিন্তু খবর তো হয়, আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দের মতোই ওনার এই কথা বলাতেই আনন্দ। আর সেটাই বিষয় আজকে, মদন কেন বলেন? কেন ক্ষমা চান?
অথচ মদন মিত্র পড়াশুনো জানা আশুতোষ কলেজের ছাত্র, বনেদি ফ্যামিলির ছেলে। তৃণমূলের বহু বিধায়ক একটার বেশি দুটো রবীন্দ্রসঙ্গীত পুরোটা বলতে পারবেন না, যেটা পারবেন সেটা জাতীয় সঙ্গীত বলেই পারবেন। মদন মিত্র কিন্তু খান ৫০ রবীন্দ্রসঙ্গীত না দেখেই খানিক গেয়েও দিতে পারবেন, বেশ কিছু কবিতাও। কেবল তাই নয়, ভালো চাকরি করেছেন আবার তারই সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ কলকাতায় বাম জমানাতেও হেক্কড়ি করেই দাপটের সাথে রাজনীতি করেছেন দুটো খুঁটিকে ধরে। এক ওনার ট্যাক্সি ইউনিয়ন, ডাক দিলেই মদন থামিয়ে দিতে পারে কলকাতাকে, দুই ওনার পিজি হাসপাতাল। আম আদমি থেকে সাংবাদিক থেকে দলের নেতা কর্মী, কে নয়? পি জি হাসপাতালে দরকারে মদন আছে। এমনকী এক বাম নেতাকেও ফোন করে অনুরোধ করতে শুনেছি নিজের কানে। অনেকেই জানেন না বা মনেই নেই যে এই মদন মিত্রই কিন্তু বাম জমানার অবসানের প্রথম সিগন্যাল, তিনিই ২০০৮-এ দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিষ্ণুপুর উপনির্বাচনে জিতে গেলেন। সেই জয় সিপিএমকেও চমকে দিয়েছিল, সাংবাদিকদের কাছে খবর গিয়েছিল, জমানা বদলাচ্ছে।
আরও পড়ুন: Aajke | মহাকুম্ভ, সাফাই কর্মী, শ্রীযুক্ত নরেন্দ্র মোদি এবং তাঁর মিথ্যে কথা
সেই হেন মদন মিত্র তাঁর খেই হারালেন, অথচ তিনি সেই প্রথম মমতা মন্ত্রিসভার পরিবহণ মন্ত্রী, তার আগে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক। ২০১১-তে কামারহাটি থেকে জিতে আসা মদন মিত্র ক্যাবিনেট মিনিস্টার, দলের অন্যতম নেতা। খেই হারালেন ২০১৫-তে সারদা মামলাতে গ্রেফতার হওয়ার পরে, এক দীর্ঘ অবহেলার জেল জীবনের শেষে অভিমানী মদন খেই হারালেন সব অর্থেই, জেল থেকে লড়ে হারলেন, বেরিয়ে এসে জিতলেন বটে কিন্তু ততদিনে তিনি ৫২ তাসের সেই জোকার, যিনি আছেন, কাজেও লাগেন, কিন্তু শেষমেশ জোকার। কখনও গান গাইছেন, ভিডিও আপলোড করছেন, সিনেমাতে অভিনয় করছেন, নৌকোতে আমোদ-প্রমোদ এবং অসংলগ্নতা বেড়েই চলল। আবার জিতেছেন কামারহাটিতে, কিন্তু আপাতত কেবল এক বিধায়ক, একদা এক্কেবারে প্রথম সারির তৃণমূল নেতা অভিমানে, অবহেলায় আপাতত খবরের শিরোনামে আসেন উল্টোপাল্টা কথা বলে, আরও বিচ্ছিন্ন হন, আরও হতাশ হন, আরও বিতর্কিত কথা বলে ভেসে ওঠার চেষ্টা চালিয়ে যান। তো এবারে বললেন, তৃণমূলের বিধায়ক হতে গেলে আইপ্যাককে টাকা দিতে হয়। সাংবাদিকরা সব্বাই জানেন মদন মিত্র সেই কয়েকজন তৃণমূল নেতাদের মধ্যে একজন যিনি অক্ষরে অক্ষরে আইপ্যাকের নির্দেশ মেনেই নির্বাচন লড়েছেন। কিন্তু বললেন এই কথা, খেয়াল করুন, দলের ভেতর থেকে খুব বেশি কথাও কেউ বললেন না, কেউ বলার আগেই তিনি নিজেই ভুল স্বীকার করলেন, ক্ষমা চাইলেন। দল এক নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে আদতে এই নেতাকে ইগনোর করছে। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, মদন মিত্র, একসময়ের তৃণমূলের অন্যতম নেতা এখন বড্ড একলা, কখনও দলের বিরুদ্ধে, কখনও দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কথা বলে নিজেকে ভাসিয়ে রাখতে চান, কেন? এটা কি তাঁর হতাশার বহিঃপ্রকাশ? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আজ সত্যিই মদন মিত্র হাসির খোরাক, সত্যিই তাঁর কথায় পাত্তা দেওয়ার প্রয়োজন মনেই করে না এমনকী তাঁর দল। এমনও নয় যে অন্য দলে তাঁর এক পয়সারও কদর আছে। কিন্তু এক দীর্ঘ সময়ে মমতার পাশে যে কয়েকজন নেতাকে দেখা যেত, একটা সময়ে তৃণমূলের উত্থান যে কয়েকজন নেতার হাত ধরেই হয়েছিল তাদের মধ্যে মদন মিত্র অন্যতম। দল, দলের বাইরে তিনিই সেই গৌরী সেন যাঁর কাছে গেলেই ফান্ড জুটে যেত বিভিন্ন কাজে। আজ তিনি ৫২ তাসের জোকার, খানিক নিজের দোষে, খানিক পরিস্থিতির চাপে, বেশ কিছুদিন ওনার শখের তালিকাতে যোগ হয়েছে রোদচশমা, গগলস, রাজনৈতিক মঞ্চের তীব্র আলো সম্ভবত তাঁর সহ্য হচ্ছে না, সম্ভবত তাঁর চোখ ওই আর্ক ল্যাম্পের চোখধাঁধানো আলোর থেকে রেহাই পেতে চায়।