কতজন মারা গেছেন সেদিনের দুর্ঘটনায়? হ্যাঁ, আমি মহাকুম্ভের কথা বলছি। কতজন মারা গেছেন? ক’টা জায়গাতে ওই পদপিষ্ট হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল? দু’ দু’বার বড়সড় আগুন লাগার ঘটনা ঘটে গেল কেন? কেন তার পরেও ভিভিআইপির আনাগোনা কমছে না? এসব প্রশ্নের প্রথমটা আপাতত খুব জরুরি। ঠিক এই মুহূর্ত পর্যন্ত কেবল আমাদের রাজ্যের চারজনের মৃত্যুর খবর এসেছে আর আটজনের মতো মানুষজনের খবর পাওয়া যাচ্ছে না। যাঁরা মারা গেছেন তাঁদের দু’ জনের লাশ এসেছে যার পোস্টমর্টেম করানো হয়নি, অস্বাভাবিক মৃত্যুর পরে যা ছিল বাধ্যতামূলক। যাঁরা ফিরেছেন তাঁদের কাছ থেকে এক নরকের বর্ণনা পাওয়া যাচ্ছে, সব মিলিয়ে এক চূড়ান্ত অরাজকতা। এবং এখন যা জানা যাচ্ছে তাতে সবথেকে বড় সমস্যাই ছিল ভাষার। যে শুদ্ধ হিন্দিতে ঘোষণা চলছিল তা তো হিন্দিভাষীদের কাছেও দুর্বোধ্য, বাঙালি, রাজস্থানি, গুজরাটি, ছত্তিশগড়িয়া, অহোম, তেলুগু, ওড়িয়া ভাষীদের কাছে বোধের ঊর্ধ্বে। কে কোন দিকে যাবে বোঝাও যাচ্ছিল না, রাস্তা দেখানোর লোক নেই, মৌনি অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে ছিল শুধু আর্ত চিৎকার। আমি বলছি না, যাঁরা গেছিলেন, ফিরেছেন প্রাণে বেঁচে তাঁদের একজনের মুখেই শুনলাম, এই মহাকুম্ভে সব ব্যবস্থাই ছিল ভিভিআইপিদের জন্য, হু হু করে তাঁদের গাড়ি ঢুকেছে, তাঁদের জন্য রাস্তায় স্যালুট মারা পুলিশ আমলা, লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষকে সাহায্য করার কেউ ছিল না। কিন্তু আমার প্রশ্ন হল, এই বিরাট দুর্ঘটনার পরে আমাদের এই বাংলার চোখে আঙুল দাদারা, সংবাদমাধ্যমের দালালেরা, নামাবলি গায়ে জড়িয়ে মাইনে এবং ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করে ফেলা চিল্লানোসরাসের দল কোথায়? কোথায় সেই রাত দখলের প্রতিবাদীরা? কোথায় মহম্মদ সেলিম শুভেন্দু অধিকারী? সেটাই আজ বিষয় আজকে। মহাকুম্ভ, বোবা শুভেন্দু, বোবা মিডিয়া, বোবা রাত দখলের বিপ্লবীরা।
আসুন দুটো জায়গা থেকে বিষয়টা বিচার করা যাক। এক হল হ্যাঁ, এটা তো দুর্ঘটনা, কিন্তু সেই দুর্ঘটনা কি এড়ানো যেত? সেই দুর্ঘটনা সামলানোর মতো ব্যবস্থাও কি ছিল? আর দু’ নম্বর প্রশ্ন হল এত বড় ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে এই ক’দিন আগে শেষ না দেখে রাস্তা ছাড়ব না বলা বিপ্লবীরা, এ রাজ্যের এক হাসপাতালে একজন ডাক্তারের ধর্ষণ আর খুনের জন্য মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ যিনি চেয়েছিলেন, যাঁরা চেয়েছিলেন সেই শুভেন্দু অধিকারী বা মহম্মদ সেলিম কোথায়? কোথায় রাষ্ট্রীয় প্রসাদে গায়ে গতরে বেড়ে ওঠা সংবাদমাধ্যমের সেই অ্যাঙ্করেরা?
আরও পড়ুন: Aajke | এবারে মোদিজি-যোগীজির পদত্যাগ চাইবেন না শুভেন্দুবাবু?
সারা দেশ থেকে এই মহাকুম্ভে মানুষ আসবেন সেটা জানতেন না ওই যোগী-মোদি? আলবাত জানতেন, এমনকী কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্নাটক, অন্ধ্র, তেলঙ্গানা, মহারাষ্ট্রের সবকটা ভার্নাকুলার খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন তো ছিল মালয়ালম, কন্নড়, তামিল, তেলুগু, মারাঠি বা অন্য ভাষায়। তাদেরকে ডাকার সময়ে তাদের ভাষাতে তো ছিল, কিন্তু তাঁরা গিয়ে পৌঁছানোর পরে? না, সেখানে কেবল হিন্দি ভাষা। প্রতিটা আলাদা প্রবেশপথের ম্যাপ ছিল না সর্বত্র, মানুষ মাঝরাতে উঠে স্নানের জন্য রওনা দেবেন জানা ছিল, কিন্তু ছিল না পর্যাপ্ত আলো। ছিল না রাস্তায় সেই পরিমাণ স্বেচ্ছাসেবক যাঁরা পথ দেখাবেন। আর দুর্ঘটনা ঘটার পরে সবটাই ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল ভগবানের হাতে, ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্টের ছিটেফোঁটাও সেদিন ছিল না। এখন মৃতদেহ বা মৃতের সংখ্যা লুকনো হচ্ছে, কেবল এই বাংলাতেই এখন মৃত ৪, নিখোঁজ ৮, তাহলে বাকি রাজ্যের অবস্থা কী? কিন্তু এ নিয়ে আমাদের বিস্কুট খেয়ে ল্যাজ নাড়ানো অ্যাঙ্করেরা কোথায়? কোথায় সেই সূত্র থেকে খবর বার করে প্রতিদিন লাগাতার মিথ্যে বলে যাওয়া মোদি সাম্রাজ্যের লালিত পালিত সাংবাদিকের দল? কোথায় সেই তাঁরা যাঁরা রাত পাহারাদারিতে নেমেছিলেন? মাথায় ব্যান্ডানা বেঁধে দেশটা তোমার বাপের নাকি গান গাইছিলেন আজ তাঁরা কোথায়? এ দেশটা কি ওনাদের মাটি আর জল দেয়নি? নাকি তখন প্রতিদিনের উপস্থিতির জন্য কড়কড়ে নোটের জোগান ছিল যা আজ নেই? কোথায় আমাদের টাচ মি নট খোকাবাবু? মমতার পদত্যাগ চাওয়া কাঁথির খোকা কই গেলেন? বোবায় ধরেছে? যান মহাকুম্ভে, নিখোঁজদের খোঁজ নিন, সেখানে তো আপনাদের যোগীর সরকার। কেবল নির্বাচনের আগে বিষ ছড়ানোর জন্য আনবেন? কত্ত আইনে প্রশ্ন সেদিন এই শুভেন্দু অধিকারীর মুখে, হম্বি তম্বি দেখে মনে হচ্ছিল ননী পালকিওলা, তো আজ কোন আইন মেনে পোস্টমর্টেম না করেই দেহ ফিরিয়ে দিয়েছেন একটা হাতে লেখা চোতা ধরিয়ে? মেদিনীপুরে বিপ্লবীরা জন্মেছিলেন, পেডি, ডগলাস, বার্জকে খুন করেছিল তারা, কিন্তু সেই ওখানেই তো অনেক দেশদ্রোহী ক্লীবের জন্মও হয়েছিল, মেদিনীপুরে জন্মালেই সে মানুষ হবে এমন তো নয়? তো আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কেবল সরকারি গাফিলতি, তাদের অব্যবস্থার ফলে মারা গেলেন এত মানুষ, অথচ মহাকুম্ভের এই এতবড় দুর্ঘটনার পরে চুপ করে বসে আছেন শুভেন্দু অধিকারী, বা সেই বিশাল প্রতিবাদীর দল যাঁরা ক’দিন আগেই একজনের ধর্ষণ আর মৃত্যুর পরে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছিলেন। কী বলতে ইচ্ছে করছে? শুনুন তাঁরা কী বলেছেন।
মাত্র ক’দিন আগে যে ভয়েজ অফ প্রোটেস্ট আমরা দেখেছিলাম, রাত দখলের যে অভিযান মহানগর দেখেছিল, ড্রোন উড়িয়ে মশাল জ্বেলে ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিকে দিয়ে যে বিপ্লব সংগঠিত করার প্রচেষ্টা আমরা দেখেছি, ছাত্রসমাজের নাম করে ধেড়েদের নবান্ন অভিযান আমরা দেখেছি, তাদের কাছে এই ঘটনা কেন কোনও ঘটনাই নয়? কেন তাদের প্রতিবাদের সব আগুন নিভে যায় যখন রাষ্ট্রের ক্ষমতায় বসে থাকা প্রধানমন্ত্রী শাসকদলের বিরুদ্ধে কথা বলতে হয়? সেই বীরসা সুদীপ্তা বিদীপ্তা সৃজিৎ স্বস্তিকা মায় চূর্ণি কৌশিক গাঙ্গুলি কোন কারণে বোবা হয়ে বসে আছেন? জাতীয় পুরস্কার খোওয়া যাওয়ার ভয়ে? কেন শুভেন্দু অধিকারীর মুখে কোনও কথা নেই? অপরাধীর ছবি চোখের সামনে ভাসলেই জেলে পুরে দেবে সেই ভয়ে? বাংলার মানুষের পুজো বন্ধ করার চক্রান্ত হয়েছে, উৎসবের আনন্দ কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত হয়েছে, আজ সেই চক্রান্তকারীদের চিহ্নিত করার পালা। তাদের জিজ্ঞেস করতেই হবে, কত টাকা, কত খেতাব, কত সুবিধে পেলে তবে এমন বোবার অভিনয় করা যায়? জেলে যাওয়ার কতটা ভয় থাকলে মেদিনীপুরের পেপার টাইগার কাঁথির খোকাবাবু এখন বালিতে মুখ গুঁজে উটপাখির মতো কিছুই না দেখার ভান করছেন? আসুন আমরা রাস্তায় নামি, আমরাই গলা তুলে বলি, উই ওয়ান্ট জাস্টিস।