যেমনটা রোজ করে থাকি, একটা বিষয়ের অবতারণা আর সেই বিষয়কে নিয়ে অন্তত দুটো ভিন্ন মতামতকে এনে হাজির করা, যাতে করে আপনারা আপনার মতটাকে শানিয়ে নিতেই পারেন আবার আপনার বিরুদ্ধ মতটাকেও শুনে নিতে পারেন। আজ বিষয়, আনন্দ আর বিষণ্ণতার এই শহরে।
এক অদ্ভুত শহর এই কলকাতা, ফুটবল ম্যাচ জিতে ঢাউস শিল্ড নিয়ে ফিরছে যে ছেলেরা ছোট হাতি চেপে, কী উল্লাস, কী উল্লাস। তার পাশ দিয়েই খই ছড়াতে ছড়াতে চলে যায় আর একদল যুবক, ওদিকে ধুঁকতে থাকা সাতপুরুষের ময়রা ভুবনের ছানার জিলিপিতে মাছি ঘুরছে, উল্টো ফুটেই গুপ্তা সুইটসে কচুরি দিতে কেন দেরি তাই নিয়েই কথা কাটাকাটি। হ্যাঁ, এই শহরেই চোখ রাখলে পেয়ে যাবেন এক হলুদ বা কমলা ল্যাম্বর্গিনি, পাশ দিয়ে এখনও অনায়াসে সবজি নিয়ে ভ্যান রিকশা বা টানা রিকশায় ফেরেন কর্তাটি বাজার সেরে। বালিগঞ্জ প্লেসের চওড়া রাস্তার ধারে এখন পলাশ নয়, কিন্তু শিমূল বা মাদারের পাপড়ি আর ছিদাম মুদি লেনে আলোই ঢোকে না, ফুল ফুটবে কেন? এক অসম্ভব আনন্দ, ঔদাসীন্যের মধ্য দিয়ে কলিকাতা চলিয়াছে নড়িতে নড়িতে। বহিরাঙ্গ হু হু করে পাল্টাচ্ছে, কিন্তু স্ববিরোধিতা ঘোচার নামই নেই। এ শহরের এক প্রান্তে সারি সারি বাঙাল বাড়ি, এক প্রান্ত দেখলে মনেই হয় না বাংলার কোনও রাস্তাঘাট, সে রাস্তায় নামলে মুখ থেকে অনায়াসে হিন্দি বেরিয়ে আসে, বারা বাই দো কিধর মিলেগা? ঠিকানা শুধোই, জবাবও আসে, তনিক সামনে যাও, ফির ডাঁয়া। সেই শহরে এখন রাতের বেলা কত্ত আলো, সে সব সময় গেছে যখন পাড়ার পর পাড়া চিৎকার করে উঠত, জ্যোতি গেল, জ্যোতি এল, দোকানে দোকানে জেন সেট আর বেকারদের মোমবাতির ব্যবসাকে এক্কেবারে বাপি বাড়ি যা বলে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে চারিদিকে আলোর রোশনাই। এ শহরে মেঘের সঙ্গে কথা বলা যায় এমন বাড়িও উঠেছে, রাতের সেই আখাম্বা বাতিঘরগুলো এখন দিকনির্দেশ করে, ফ্লাইওভারে চড়লে মনে হয় যেন এক প্রৌঢ়া বিশ্ব সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নাম লেখাতে বসেছে, সে কী সাজের বাহার। গড়িয়াহাটার মোড় থেকে শ্যামবাজারের পাঁচমাথার মোড় পর্যন্ত পশরা আগের চেয়ে অনেক বেশি উজ্জ্বল আর বেড়েই চলেছে খাদ্যরসিকদের নতুন নতুন ঠেক, ভিয়েতনাম থেকে করাচি গোস্ত, বললেই পেয়ে যাবেন, মোগলাই, চাইনিজের সঙ্গে কোরিয়ান, জাপানিজ, থাই, ফ্রেঞ্চ,বিহারি, চেট্টিনাড় এক ফুড ফেস্টিভ্যাল টোয়েন্টি ফোর ইনটু সেভেন।
আরও পড়ুন: অদিতির সঙ্গে সাদা কালো | ভোটার লিস্টে ভটভটি
সেই শহর কলকাতার বিষণ্ণতা চোখে পড়ে? এক শিশুসন্তানকে খুন করে তার অসহায় বাবা তাকে বুকে বেঁধে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলে পড়ে, শিশুটির মাও একই পথ বেছে নেয়। কেন? পেশায় অটোচালক জানিয়েছে সে তার শিশুর জটিল রোগের খরচের ভার বহন করতে পারছিল না।
এ কোন অসহায়তা? এ কোন বিষণ্ণতা? কেন আমরা জানতেই পারলাম না আমাদের সহ নাগরিক কতটা অসহায়? কেন কত দেনার দায়ে দুই ভাই তাঁদের স্ত্রীদের হত্যা করে, এক নাবালিকা কন্যাকে হত্যা করে নিজেরাও আত্মহননের পথ বেছে নিতে চায়? কত টাকা দেনা? তাদের সেই প্রকাণ্ড বাড়ির চেয়েও বেশি? কেউ কি তা জানত? আত্মীয়, স্বজন, বন্ধু, প্রতিবেশী কেউ টেরই পেল না, সেই পরিবারের উপর ঝড় বয়ে যাচ্ছে? কোন গোপন চাহিদা মেতাতে নিজের আত্মীয়কে খুন করে তাকে স্যুটকেসে পুরে মা মেয়ে চলে আসে লাশ ফেলে দিতে, এই শহরে? এসব তো জানা গেছে, এই শহরের নানান মর্গে কত শত বেওয়ারিশ লাশ, সেগুলোর তো কিনারাই হবে না কোনও দিন। এই শহরেই বৃদ্ধার লাশ পচে, পাঁচ দিন পরে টের পায় প্রতিবেশীরা, তার দরজার সামনে পাঁচ দিনের দুধের প্যাকেট, খবরের কাগজ, সেই প্রবীণা টয়লেটে উপুড় হয়ে পড়ে আছেন, ওদিকে তাঁর রত্নসন্তান ডেনমার্কে, মাসে বেতন তিন কোটি টাকা। এই শহরেই মৃত দিদির সঙ্গে ১৮ দিন কাটিয়ে দিয়েছেন, কেউ বুঝতেই পারেনি সেই ভাই-বোনের নিবিড় ভালোবাসার এই অদ্ভুত পরিণাম, কতটা ব্যথা জমেছিল সেই ভাইয়ের বুকে? আমরা টেরই পেলাম না? এ এক অদ্ভুত সময়, আমাদের প্রতিদিনের জীবন মরণপণ টিকে থাকার লড়াই, আরও আরও উঁচুতে যাওয়ার লড়াই তো চলতেই থাকবে, বাঙালির মহানায়ক সেই বীজমন্ত্র দিয়ে গেছেন আমাদের কানে, আই উইল গো টু দ্য টপ টু দ্য টপ, টু দ্য টপ। ব্যস আমরা যে যার মতো সেই সাপলুডোর খেলায় মেতে গেছি, এদিকে আমার প্রতিবেশী তার সন্তানের চিকিৎসার কথা ভেবে ঝুলে পড়ছে সিলিং ফ্যানে, আমার পড়শি অনায়াসে তার কন্যাসন্তান তার স্ত্রীকে খুন করে ফেলছেন পরিকল্পনা করেই, আমরা কিছুই টের পাই না। এখন এমনি করেই যায় যদি দিন, তাহলে তো ভাবতাম না, কিন্তু কোনওদিন কি সেই অন্ধকার সময়ে আমাকেও ঘিরে ধরবে না সেই বিষণ্ণতা? আমারও কি একগাছা দড়ি হাতে হেঁটে যেতে ইচ্ছে করবে না? সেদিন তো আমার পাশে কেউ থাকবে না, কারণ আমিও তো আমরাও তো কারও পাশে থাকিনি, আমি তখন ছিলেম মগন গহন ঘুমের ঘোরে যখন বৃষ্টি নামল, থুড়ি যখন বিষণ্ণতা আমাকে গ্রাস করে নিল।