আক্ষরিক অর্থেই দ্বিতীয় প্রজন্মে উত্তরণ ঘটলো তৃণমূল কংগ্রেসের। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের আসনে অভিষেক বন্দোপাধ্যায়। কংগ্রেসের পরম্পরা অনুসারী তৃণমূলে দলে পদের চাইতে প্রশাসনিক পদের গুরুত্ব অনেক বেশি। অভিষেক অবশ্য ভোটের আগেই এক সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন মন্ত্রীত্বে নয় সংগঠনেই তাঁর আগ্রহ। তবে অনেক নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে দলের শীর্ষ পদে আসীন হয়েছেন অভিষেক।
প্রায় সাড়ে তিন দশকের প্রবল পরাক্রমশালী বাম জমানার অবসানের পর মাস তিনেকের মাথায় ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে তৃণমূলের সমাবেশ। একুশে জুলাইয়ের বাৎসরিক শহিদ স্মরণ মঞ্চে তৃণমূলের বিজয় সমাবেশ। আনুষ্ঠানিক ভাবে দলের যুব শাখা এই শহিদ দিবসের সভার আহ্বায়ক। ২০১১ সালে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি শুভেন্দু অধিকারী। তুমুল বৃষ্টি বিঘ্নিত ব্রিগেডের সেই জনস্রোত তখন সদ্য বিজয়ের আবেগে টৈটম্বুর। মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল নেত্রী তখনও সভায় আসেননি। কিন্তু তাঁর নির্দেশে যুব সভাপতির হাত থেকে সভা চালানোর মাইক চলে যায় কুনাল ঘোষের হাতে। আনুষ্ঠানিকভাবে কুনাল তখনও তৃণমূলের সদস্য নন। তাঁর পরিচিতি সাংবাদিক হিসেবে। ব্রিগেড মঞ্চে ঘোষক হিসেবে তাঁর অবতরণ হলেও বস্তুত সভা পরিচালনার সবটুকুই ছিল কুনালের হাতে। কিছু পরে মঞ্চে অবতীর্ণ মমতা। জনতা প্রত্যাশিত কারণেই উদ্বেলিত। তাঁদের উদ্দেশ্যে কিছু বলার পর নেত্রী ফের মাইক তুলে দিলেন ঘোষকের হাতে। যুব কংগ্রেসের সেই সভামঞ্চ থেকেই কুনাল নতুন একটি শাখা সংগঠনের নাম ঘোষণা করলেন। তৃণমূল যুবা। যার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। মমতা ও শুভেন্দুর উপস্থিতিতে জনতার সঙ্গে আনুষ্ঠানিক পরিচয় করিয়ে দিলেন কুনাল।
ধর্মতলায় অনশন মঞ্চে কিংবা সিঙ্গুরের ধর্ণায় মমতার পাশে কয়েকবার তাঁকে দেখা গিয়েছে। সেই প্রথম জনসমক্ষে মমতার ভাইয়ের ছেলে অভিষেক। মমতার ভাইপো থেকে তৃণমূল নেতৃত্বে উঠে আসার সলতে পাকানোর সেই সূচনা।
গত ৭ মার্চ ব্রিগেড প্যারেড ময়দানে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্বাচনী সমাবেশ। ঠিক এক দশকের ব্যবধানে সেই সভা থেকে দেশের প্রধানমন্ত্রীর নিশানায় অভিষেক। মমতার পাশাপাশি বিগত বিধানসভা নির্বাচনে গোটা রাজ্যে তৃণমূলের দ্বিতীয় মুখ ছিলেন অভিষেক। শুধু মোদী নন, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপির খুচরো নেতারা পর্যন্ত যেভাবে অভিষেককে তাক করে আক্রমণ শানিয়েছেন তার নজির নেই। এমনকী দল বদলের পর প্রথম জনসভায় শুভেন্দু যেভাবে তাঁর আক্রমণের কেন্দ্রবিন্দু করেছিলেন অভিষেককে তাতেই মালুম হয় এর নেপথ্যে দিল্লির দীনদয়াল ভবনের নির্দিষ্ট অঙ্ক রয়েছে। সদ্য তিরিশের কোঠায় পা দেওয়া অভিষেকই ছিল তাঁদের উদ্বেগের মুখ্য কারণ।
২০১১সালে অভিষেকের যুবার পত্তনকে ঘিরে দলের অন্দরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। আস্ত একটা যুব সংগঠন থাকতে ‘যুবা’ কেন? দলে অভিষেকের অভিভাবকসম অনেকেই আড়ালে ফিসফাস করতেন। অভিষেক অবশ্য সেসব কানে তোলেননি। তাই পথ তেমন মসৃন ছিল না। সাবেক কংগ্রেসি ঘরানা থেকে বেরিয়ে এসে নিজের মতো করে দলের সংগঠনে নিজেকে নিয়োজিত করেছিলেন। পেশাদার প্রশান্ত কিশোরকে নিয়োগ করে দলের সংগঠন ও প্রচারে নতুন বাতাস এনেছিলেন। এসব নিয়ে ঝুঁকি ছিল, ছিল বিতর্ক। কিন্তু নিজের পরিবারের সদস্যকে দলের উত্তরাধিকার সঁপে দিতে সময় নিয়েছিলেন মমতা। দশ বছর আগে সেটা ছিল নেত্রীর ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। আজ নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাফল্যের কারিগর হিসেবে নিজেই সেইসব বিতর্কের অবসান ঘটিয়েছেন অভিষেক স্বয়ং। দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের পদ নিজ যোগ্যতার প্রমান দিয়েই আদায় করে নিয়েছেন তিনি।
একুশের সেই ব্রিগেড সভায় মমতার নেওয়া তিনটে সিদ্ধান্ত,সময়ের কোষ্ঠী পাথরে আজ ভিন্ন মাত্রা পেয়েছে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের সুবাদে শুভেন্দু তখন বাংলার যুব আইকন। দূরদর্শী মমতা পরিবর্তনের সেই তুঙ্গ মুহূর্তেই শুভেন্দুকে জরিপ করে নিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছাতেই সেদিন সভার মাইক চলে গিয়েছিল তৎকালীন ‘বহিরাগত’ কুনালের হাতে। সেই কুনাল আজ দলের পদাধিকারী। যদিও তাঁর এই উত্থান মোটেই ফুল বিছানো পথে হয়নি। রাজ্যসভায় তৃণমূলের প্রতিনিধি হওয়া সত্ত্বেও চিটফান্ড বিতর্কের জেরে রাজ্য পুলিশের হাতে গ্রেফতার ও হেনস্থা হতে হয়েছিল তাঁকে। কিন্তু সেইসব বিতর্কের মোকাবিলা করে বিগত নির্বাচনে প্রায় একক মুখপাত্র হিসেবে দলের ঢাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তিনি। মমতা তাঁকে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদকের পদ দিয়েছেন।
অভিষেকের ওই পদ প্রাপ্তির পর ৯৮সালে জন্ম নেওয়া তৃণমূলের নেতৃত্ব আক্ষরিক অর্থেই দ্বিতীয় প্রজন্মে হস্তান্তর হল। দলের জন্মলগ্নে মুকুল রায় এবং তাঁর বিজেপিতে যাওয়ার পর ওই পদে ছিলেন সুব্রত বক্সী। খাতায় কলমে সর্বভারতীয় হলেও কিছু বিচ্ছিন্ন ব্যতিক্রম বাদ দিলে তৃণমূল বাংলায় সীমাবদ্ধ। ভিনরাজ্যে সংগঠন সম্প্রসারণের বিষয়টি একদা মুকুলের কুক্ষিগত ছিল। ত্রিপুরা,অসম,মনিপুর ,মেঘালয় বিচ্ছিন্নভাবে কিছু সময়ের জন্য সাফল্য পেলেও তা স্থায়ী হয়নি।
এবার মমতার সর্বভারতীয় জনপ্রিয়তায় ভর দিয়ে অভিষেক ভিন রাজ্যে তৃণমূলের সাংগঠনিক সম্প্রসারণে হাত দেবেন। দলের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাঁর নতুন পদ প্রাপ্তির পরেই অভিষেক ট্যুইট করে জানিয়েছেন, দলের দেওয়া দায়িত্ব মতো গোটা দেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যাযের বার্তা পৌঁছে দিতে আমি চেষ্টার কোনো ত্রুটি রাখবো না।’ বিজেপি বিরোধী আঞ্চলিক দলগুলির মধ্যে দেশে তৃণমূলের ধারাবাহিক সাফল্য অব্যাহত। সেই সুবাদে ২০২৪ সালে দিল্লির মসনদ দখলে অবিজেপি শক্তিগুলির স্বাভাবিক পছন্দ মমতা। দেশের বিরোধী রাজনীতির সেই চাহিদা পূরণের পরিপূরক হিসেবে রাজ্যের বাইরে তৃণমূলের সম্প্রসারণ বড় চ্যালেঞ্জ অভিষেকের সামনে।
দ্বিতীয় প্রজন্মের উত্তরণ
Follow Us :