বিষ্ণুপুর : শান্তির দেশে চলে গেলেন শান্তিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। তাঁর প্রয়াণে এক অপূরণীয় ক্ষতি হল বিষ্ণুপুরের সঙ্গীতের।
সঙ্গীতের আবহে বেড়ে উঠেছিলেন তিনি। সাত সুরের সাধনা শুরু করেছিলেন সেই ছোট্ট বেলা থেকেই। পরবর্তীকালে সুর, তাল লয় হয়ে উঠেছিল তাঁর ঘর সংসার। বার্ধ্যকের যন্ত্রনায় সঙ্গীত থেকে তিনি পিছু হটেননি। বিভিন্ন যন্ত্র সঙ্গীতকে আঁকড়ে রেখেই জীবনের শেষ দিন পর্য্যন্ত তিনি সপ্তসুরের সাধনায় মেতে ছিলেন। তাঁর সঙ্গীতের শিক্ষায় শিক্ষালাভ করেছেন বহু ছাত্রছাত্রী। তিনি শান্তি রঞ্জন চট্টোপাধায়। বৃহস্পতিবার রাতে নিজের বিষ্ণুপুরের বাড়িতে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর মৃত্যুতে শোকের ছায়া নেমেছে শিল্পী মহলে। বিষ্ণুপুরের সঙ্গীতের এক অপূরণীয় ক্ষতি বলে মনে করছেন বিষ্ণুপুরের আপামোর জনগণ।
আরও পড়ুন : সৌমিত্রর শেষ আবৃত্তির রেকর্ড
শান্তি রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়। বিষ্ণুপুর শহরের কলেজ রোডের বাসিন্দা। জন্ম ১৯৩২ সালে তৎকালীন অবিভক্ত বাংলার বরিশালে । ছোট বয়সে দুই দিদির সঙ্গে বাবা হরিকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছে সঙ্গীতে হাতেখড়ি। বরিশালের বি এম কলেজ থেকে স্নাতক পাশ করার পরই শুরু হয় দেশ জুড়ে অশান্তি। প্রাণে বাঁচতে দেশ ভাগের ক্ষত বুকে চেপে মায়ের হাত ধরে জাহাজে চেপে রওনা দেন এদেশে। প্রথমে কলকাতা , তারপর বিষ্ণুপুর শহরে আসা। রুজি রুটির টানে প্রথমে ট্রাক চালক হিসাবে কাজ শুরু করেন। তারপর কয়েক বছর বেসরকারি কাজ করার পর মেলে সরকারি কাজ। কাজের পাশাপাশি ছোট বেলা থেকেই সুরের প্রতিি ভালোবাসার টানে নিজেকে সঙ্গীতের সঙ্গে জড়িয়ে রেখেছিলেন তিনি। কর্মজীবনের সঙ্গে সুরের ভালবাসার টানেই একদিন হাজির হয়েছিলেন বিষ্ণুপুর রামশরণ সঙ্গীত মহাবিদ্যালয়য়ে। নিজের কাজের ফাঁকে তিনি সেখানে বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশ্ববন্দিত শিল্পী গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সুরেন্দ্র নাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে যন্ত্র ও কণ্ঠ সঙ্গীতের তালিম নেন। রবীন্দ্র সঙ্গীত থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত, অসাধারণ কণ্ঠ ছিল তাঁর।
আরও পড়ুন : নতুন পর্বে ‘তানসেনের তানপুরা’
কণ্ঠ সঙ্গীতের সঙ্গে ১৮ রকমের বাদ্যযন্ত্র বাজাতে পারতেন নিখুঁত ভাবে। বেহালা, গীটার, মাউথ অর্গান, বাশি, এমনই নানান যন্ত্র বাজাতে পারতেন সাবলীল ভাবে। তবে মাউথঅর্গান ও বাশির প্রতি আলাদা টান ছিল তাঁর। প্রখ্যাত সঙ্গীত শিল্পী সলিল চৌধুরীর দলে বাশি বাজানোর ডাক পান একাধিক বার। নিজের বাড়িতেই কন্ঠ সঙ্গীত থেকে বিভিন্ন যন্ত্র সঙ্গীতের ছাত্র ছাত্রীদের তালিম দিতেন তিনি। এই শিল্পীর হাত ধরে অনেক শিল্পী আজ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। কণ্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীত ছাড়াও লিখেছেন রবীন্দ্রসঙ্গীতের স্বরলিপি বই। সঙ্গীত নগরী বিষ্ণুপুরের কলেজ রোডের রাস্তা পেরিয়ে গেলেই শোনা যেত শান্তি রঞ্জন বাবুর নিখুঁত হাতে বাজানো বিভিন্ন যন্ত্র সঙ্গীতের সুর মুর্ছনা। শোনা যেত ছাত্রছাত্রীদের তালিম দেওয়ার কোরাসের সুর। বয়সের ভারে শক্তি হারালেও সঙ্গীতের আবহে ভেসে থাকার চেষ্টা করতেন তিনি। বেশ কয়েকমাস ধরে বার্ধক্য জনিত রোগে ভুগছিলেন তিনি। শুক্রবার বিকেল ৫ টা নাগাদ শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তাঁর বয়স হয়েছিল ৮৯ বছর। শান্তি রঞ্জন বাবুর মৃত্যু বিষ্ণুপুরের সঙ্গীতের এক অপূরণীয় ক্ষতি বলেই মনে করছেন বিষ্ণুপুরবাসী। আগে শান্তি বাবুর বাড়ির পাশ দিয়ে পেরিয়ে গেলে যে কন্ঠ ও যন্ত্র সঙ্গীতের সুর বাজতো, তা আর শোনা যাবে না। সেই সুর শোনা না গেলেও শান্তি রঞ্জন চট্টোপাধ্যায়ের স্মৃতি বিষ্ণুপুরের মাটিতে অমর হয়ে থাকবে। অমর হয়ে থাকবে তাঁর ছাত্রছাত্রীদের হাত ধরে।