আপনার বাড়ি আপনার পরিচয়? আপনি নন!
এটা হয় নাকি?
ব্যক্তি মানুষের কোনও দাম নেই! ভাবুন একবার।
আমরা কোথায় চলেছি।
মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে একাধিক জনসভায় চড়া সুরে বলতে শুনেছি। দস্তুরমতো বেশ ঘৃণিত উচ্চারণ। সেটা ছিল এক সিমেন্ট কোম্পানির বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন— আপনার বাড়িই আপনার পরিচয়। যা নিয়ে তীব্র আপত্তি ঝরে পড়ত বুদ্ধবাবুর গলায়। কনজিউমারিজম ঋদ্ধ সামাজিক মূল্যবোধ বদলের লক্ষ্যে এমন বিজ্ঞাপন সম্পর্কে তাঁর তীব্র আপত্তি প্রকট হত জনসভার মঞ্চে।
একই সময়ে রাজ্যে কর্মসংস্থান গড়ে তুলতে কর্পোরেট লগ্নি বিনা গত্যন্তর নেই, সেটাও বিশ্বাস করতেন, কথায় কথায় বিশ্বায়নের কট্টর সমালোচক মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ উদ্ধৃত করা এই মার্কসবাদী জননেতা।
একই সঙ্গে তিনি টাটা মোটরস-এর সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষরের পরে মিডিয়ার সামনে বলতে পারেন, আজ আমার জীবনের সবথেকে বড় ঐতিহাসিক দিন। একজন কমিউনিস্ট দলীয় সদস্যপদ প্রাপ্তির দিনটাকেই তাঁর জীবনে সবার উপরে ঠাঁই দিয়ে থাকেন। বাম মহলে বুদ্ধবাবুর সেই মন্তব্য নিয়ে এমন সমালোচনায় হয়েছিল।
কিন্ত এই আপাত স্ববিরোধিতার সঙ্গে তাঁর কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ জড়িয়ে ছিল না। নিজের সামাজিক ও রাজনৈতিক বোধবুদ্ধি দিয়ে তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, কৃষি নির্ভরতা ছেড়ে বিকল্প জীবিকার বন্দোবস্ত না করতে পারলে রাজ্যের সমূহ বিপদ।
প্রায়ই জনসভা বা হল সভাতে বলতেন, যুবসমাজ কাজ চায়। কৃষির উপর থেকে চাপ কমাতেই হবে। না হলে উপায় নেই। তাই পুঁজির প্রয়োজন। সঙ্গী শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেনকে নিয়ে তাই রাজ্যে পরিকাঠামো বাড়ানোর উপর জোর দিয়েছিলেন। বৃহৎ লগ্নি টানার অন্যতম পূর্ব শর্ত পরিকাঠামো উন্নয়ন।
আরও পড়ুন: বাঙালি নেটিজেনদের ভোটে জয় নিয়েই বিদায় বুদ্ধদেবের
তবে, সেই পুঁজি নিয়ে অতি সক্রিয়তা পরিণামে বুদ্ধবাবুর শুধু গদিচ্যুতি ঘটেনি, তাঁর দল সিপিএমকে রাজ্যে নির্বাচনী সাফল্যের নিরিখে শূন্য করে দিয়েছে। তবুও একথা আজ বলতেই হবে, বুদ্ধদেবের আপাত স্ববিরোধী অবস্থান সত্ত্বেও তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে বিশেষ সংশয় ছিল না। অতি বামপন্থীদের তরফে তো বটেই, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় থেকেই আজকের শাসক তৃণমূলও বুদ্ধদেবকে টাটার দালাল বলতে দু’বার ভাবেনি।
বুদ্ধদেব কারও হাতে তামাক খাননি। রাজ্যে শিল্পায়ন ছাড়া কর্মসংস্থানের জগৎ অন্ধকার, এই উপলব্ধি থেকে তার সিঙ্গুরে টাটা থেকে নন্দীগ্রামে ইন্দোনেশিয়ার সালাম গোষ্ঠীকে দিয়ে কেমিক্যাল হাব নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এবং তা করতে গিয়ে নিজের দলের সংগঠনকেও উপেক্ষা করেছিলেন। অত্যধিক আমলা নির্ভরতা দেখা দিয়েছিল।
সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ বিতর্কের জেরে তৎকালীন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু কৃষক সভাকে এড়িয়ে যাওয়া নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন। রাজ্যে শিল্পায়নের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে নয়, তার প্রয়োগ পদ্ধতি নিয়েই প্রশ্ন উঠেছিল। জন প্রতিবাদ থেকে প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল। শাসক হিসেবে তা সামাল দিতে ব্যর্থ হয়েছিলেন পদে পদে।
কিন্তু শিল্পপতিদের দালালির উদ্দেশ্যে তিনি দল ও প্রশাসনকে ব্যবহার করেছেন এমন কথা আজ তাঁর প্রতিপক্ষ রাজনীতিকরা বিশ্বাস করে না। কিন্তু সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের প্রশ্নে প্রশাসক হিসেবে তাঁর ভ্রান্ত পদক্ষেপকে কেন্দ্র করে যে বিতর্ক তৈরি হয়েছিল, তা আমৃত্যু বহন করতে হয়েছিল তাঁকে।
আসলে ক্ষমতার শীর্ষে থেকেও ব্যক্তিগত জীবনচর্চায় নিজেকে যে উচ্চমার্গে পৌঁছতে পেরেছিলেন, প্রশাসনিক স্তরে তা অধরাই রয়ে গেল। রাজ্যের আর্থ সামাজিক হল ফেরাতে বঙ্গবাসীর মনে আস্থা অর্জন করতে না পারার যন্ত্রণা থেকে একটা অভিমানও কি দানা বেঁধেছিল?