১৯৯৮-এর ১ জানুয়ারি এই বাংলায় জন্ম নিয়েছিল তৃণমূল দল, এখন তার নাম অল ইন্ডিয়া তৃণমূল পার্টি। ১৯৯৭-এর ২৬ শে ডিসেম্বার উড়িষ্যায় জন্ম নিয়েছিল বিজু জনতা দল। দুটো আলাদা প্রেক্ষিতে, দুটো আলাদা রাজনৈতিক অবস্থান থেকে। ২৫ বছর পার করল দুটো দলই, আসুন দেখা যাক দুই দলের ইতিহাস। গতকালই বলেছিলাম আরএসএস–বিজেপি ৯০-এর দশকের শুরু থেকেই আঞ্চলিক দলগুলোকে সাহায্য দিয়ে, ব্যবহার করে কংগ্রেস বা কমিউনিস্টদের শেষ করার এক নীল নকশা এঁকেছিল। তার প্রথম কারণ হল, দেশজুড়ে বিজেপি বাড়ার আগেই আঞ্চলিক দল গড়ে উঠছিল। এক ধরনের আইডেন্টিটি পলিটিক্স, যা আগে তামিলনাড়ুতে ছিলই, তা ওই ৮০-র শেষ, ৯০ থেকে দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ল। মূলত কংগ্রেস নেতৃত্বের হাইকমান্ডের ব্যর্থতায়, কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সহি বিপ্লবীয়ানা বজায় রেখে শুদ্ধতা বজায় রেখে, অথচ সংসদীয় রাজনীতির মধ্যেই বিচরণ করার মধ্যে যে কন্ট্রাডিকশন, যে দ্বন্দ্ব ছিল, তার ফলেই রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দল আর নেতা মাথাচাড়া দিয়ে রাজ্য রাজনীতির দখল নিতে এল। জাতিসত্তার আন্দোলন, ভাষা, সংস্কৃতির আন্দোলন, কমিউনিস্টদেরই তো করার কথা, কিন্তু তার দায় নিলেন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে আসা নেতা, জনতা দল ভেঙে বেরিয়ে আসা নেতারা। অন্ধ্র, কাশ্মীর, বিহার, ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গ, এমনকী উত্তরপ্রদেশেও। জনতা দল ভাঙল, জেডিইউ, সমতা দল তৈরি হল, পরে লালুর রাষ্ট্রীয় জনতা দল, উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী দলের মুলায়ম সিং যাদব, বহুজন সমাজ পার্টির কাঁসিড়ামের পর হাল ধরলেন মায়াবতী। অন্ধ্রে তেলুগু দেশমের ভার নিলেন চন্দ্রবাবু নাইডু, শ্বশুর এন টি রামা রাওকে সরিয়ে। কাশ্মীরে ফারুক আবদুল্লা, ওমর আবদুল্লা তো ছিলেনই, কংগ্রেস থেকে জনতা, তারপর পিডিপি তৈরি করলেন মুফতি মহম্মদ সইদ। ওড়িশাতে বিজেডি আর বাংলায় তৃণমূল। দুটো জিনিস খেয়াল করার মতো, বেশিরভাগটাই কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে যাওয়া নেতারা এই আঞ্চলিক দলের হাল ধরলেন, তার মূল কারণ কংগ্রেস হাইকমান্ডের দিল্লিকেন্দ্রিক রাজনীতি, আর দু’ নম্বর বিষয়টাও মাথায় রাখুন, একমাত্র লালুপ্রসাদ যাদব, কিছুটা হলেও মুলায়ম সিং যাদব ছাড়া প্রত্যেকের সঙ্গে বিজেপি নেতাদের গভীর সম্পর্ক। সেই সময়ে প্রমোদ মহাজন, সুষমা স্বরাজের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দারুণ সখ্য ছিল, অটল বিহারী বাজপেয়ী ওঁর বাড়িতে এসে ওঁর মায়ের সঙ্গে দেখা করেছেন, রাজনাথ সিংয়ের মতো নেতা মমতার ধরনা মঞ্চে এসেছেন। বিজেপি নেতৃত্ব খুব ভাল করেই জানতেন বাম সরকার, সিপিএম সরকারকে একচুল সরানোর ক্ষমতা তপন শিকদার, রাহুল সিনহাদের নেই, অথচ মমতাকে তাঁরা বিজেডির নবীনবাবুর মতো ভরসাও করতে পারতেন না, তার প্রধান কারণ আমাদের বাংলার জন বিন্যাসে। ওড়িশায় মুসলিম সংখ্যালঘুদের সংখ্যা ২.১৭ শতাংশ, খ্রিস্টান জনসংখ্যা ২.৭৭ শতাংশ, কাজেই বিজেপির ধারণা হয়েছিল ওড়িশার হিন্দু জনসংখ্যার বেশিরভাগটাই তাঁরা পেয়ে যাবেন। কিন্তু আমাদের বাংলাতে মুসলমান জনসংখ্যা ২৭.০১ শতাংশ, এই জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ বাম, এবং এক ভাল অংশ তৃণমূলের দিকে ছিল, নন্দীগ্রাম, সিঙ্গুরের আন্দোলনের সময়েই বাংলার এই গরিব মুসলমানের সমর্থন তৃণমূলের দিকেই ছিল। এই সংখ্যালঘু ভোটের বিরাট ঘাটতির ফলেই বামফ্রন্ট হেরে যায়, বা এখনও তারা জমি ফিরে পাচ্ছে না। বিজেপি এটা টের পেয়েছিল, নির্বাচনী পাটিগণিতের কথা মাথায় রেখে সংখ্যালঘু ভোট কাছছাড়া করবেন না মমতা, বিজেপির সঙ্গে ন্যূনতম সখ্য, কোনও রকম বোঝাপড়া রাজনৈতিক আত্মহত্যা হবে, এটা বুঝেছিলেন, বোঝেন মমতা। কাজেই স্টান্স বদলাতে পারে, কেন্দ্র সরকারের সঙ্গে প্রকল্প, অনুদান ইত্যাদির জন্য কিছু বোঝাপড়ায় হয়তো যাচ্ছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা তৃণমূল, কিন্তু প্রতিটা পদক্ষেপের পরেই গলা চড়িয়ে বিজেপি, তাদের আদর্শ ইত্যাদির বিরোধিতায় নিজেদের অবস্থানের কথা জানান দিচ্ছে তৃণমূল দল, যে দায় নবীন পট্টনায়কের ছিল না। নবীন পট্টনায়কের লড়াই ছিল কংগ্রেসের সঙ্গে, মমতা লড়েছেন এক সংগঠিত ক্যাডার বেসড পার্টির সঙ্গে, ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে লড়ে গেছেন, আজ বস্তি তো কাল রেল রোকো তো পরশু রাস্তায়, তারপরের দিন ধর্মতলা। রুপোর চামচ মুখে দেওয়া নবীনবাবুকে এটা করতে হয়নি, করতে হলে তিনি রাজনীতি হয়তো করতেনই না। কোনও মাথা ফাটার ব্যাপার নেই, ২১ জুলাইয়ের গুলি খাওয়া নেই, মিছিল, অনশন ধরনা নেই। বাবা মারা গেলেন, পাকা মাথাদের সমর্থনে আস্কা থেকে জিতেই কেন্দ্রে মন্ত্রী, ক’মাস পরে বিজেপির সঙ্গে হাত মিলিয়ে মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু তারপরে একটা মিল তো আছেই, তৃণমূল দল সিপিএমকে সরিয়ে বিলকুল সিপিএমেরর মতো হার্ড কোর ক্যাডার বেসড দল তৈরি করার দিকে মন দিয়েছে, নিজেদের পত্রিকা বার করেছে, দলে শুদ্ধিকরণেরও একটা ড্রাইভ দেখা যাচ্ছে। নবীনবাবুও একইভাবে দলকে ক্যাডার বেসড করে তুলেছেন, খবর হয় না তাই, নাহলে জানা যেত, ওড়িশায় বিজেডি না হলে কিছুই হয় না, ওখানে দুর্নীতিরও এক সাংগঠনিক চেহারা আছে, তা ধরে রেখেছে বিজেডি। সাংবাদিক কেনা হয়েছে, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধে দিয়ে, যাঁদের কাজ হল দুর্নীতি ধরা পড়লেই একজন বলির ছাগলকে চিহ্নিত করা, নবীনবাবু সেই ছাগলকে বলি দিলেই ধন্য ধন্য রব ওঠে। কিছুদিন আগে পর্যন্তও জয় পান্ডার ‘ও’ টিভি, ওড়িয়া টিভি বিজেডির খবরই করত, জয় পান্ডাকে দল থেকে তাড়ানোর পরে ‘ও’ টিভি সরকারের তীব্র সমালোচনা করতে থাকে, কিছুদিনের মধ্যে লোকাল কেবল থেকে চ্যানেল উধাও হয়ে যায়, তারপর সাংবাদিকদের হুমকি, শেষে গ্রেফতার পর্যন্তও হয়েছে। এখন জয় পান্ডা বিজেপিতেই, কিন্তু ও টিভি তার স্বর নামিয়ে নিয়েছে। কিন্তু সরকারি প্রকল্পের দিক দিয়ে আবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর নবীন পট্টনায়কের দারুণ মিল, সরকারের বিরাট টাকা খরচ হয় মহিলা, শিশু, ছাত্রছাত্রীদের জন্য, বিভিন্ন ওয়েলফেয়ার স্কিম দুই সরকারেরই আছে, এবং সেই সব প্রকল্পের জন্য দুই দল এবং দলের নেতারা অত্যন্ত খুশি। মমতা বিজেপির সখ্যে বেশিদিন থাকতে পারেননি, তার প্রধান কারণ বাংলার সংখ্যালঘু জনবিন্যাস, এই জনবিন্যাস মমতার দিক থেকে সরে বিজেপির দিকে তো যাবে না, তাহলে এর দাবিদার সিপিএম, কিন্তু সেও তো কোনভাবেই পুরোটা পাবে না, আর না পেলে সরকারেও আসবে না, কাজেই আপাতত বিজেপির বিরুদ্ধে বাংলার সংখ্যালঘু ভোট মমতার ভরসা, নবীন পট্টনায়কের নয়। যে নকশা তৈরি হয়েছিল মধ্য আশিতে, আশির শেষ থেকে কাজ শুরু হয়েছিল, এবং ফুলে ফেঁপে উঠেছিল ৯০-এ, সেই আঞ্চলিক দলগুলো দিয়ে কংগ্রেস হারাও, কমিউনিস্ট হারাও, তারপর আঞ্চলিক দলগুলোর ক্ষমতা দখল করে একছত্র রাজত্ব করবে আরএসএস–বিজেপি, সেটা হল না কেন? হিন্দু ধর্মের ব্রাকেটে সবাইকে রাখলেও, হিন্দুত্ব গেলাতে পারছে না বিজেপি-আরএসএস। ধরুন ওড়িশা, বিরাট হিন্দু জনসংখ্যা, কিন্তু তারা জগন্নাথভক্ত, বৈদিক ব্রাহ্মণ্যবাদ এমনকী রামলালার মন্দিরও তাদের টানে না। ধরুন পশ্চিমবাংলা, ২৭ শতাংশের বেশি সংখ্যালঘু মানুষের ভোটকে উপেক্ষা করে নির্বাচনে জেতা অসম্ভব, তেলঙ্গানার আইডেন্টিটি পলিটিক্স-এর সঙ্গে হিন্দি হিন্দু হিন্দুস্থানকে মেলাতে পারছে না বিজেপি। একইভাবে অন্ধ্রে তেলুগু বিড্ডা হয় জগন রেড্ডি নয় চন্দ্রবাবু নাইডু, বিহারে নীতীশ কুমার বা তেজস্বী যাদব যে বিহারিয়ানার কথা বলছেন তার সঙ্গে তাল মেলাতে পারবেন না বিজেপির কোনও নেতা। সেই কারণে বিহারে বিজেপির বড় মুখ নেই, নীতীশের ছায়া উঠে যাবার পরে সুশীল মোদি একজন সাধারণ নেতা মাত্র। সব মিলিয়ে এই আঞ্চলিক দলের যে নীল নকশা নামিয়েছিল আরএসএস–বিজেপি তা একটা সময় পর্যন্ত কংগ্রেসকে হারিয়েছে, কমিউনিস্টদেরও হারিয়েছে, কিন্তু তারপর তারা নিজেদের আইডেন্টিটি পলিটিক্স-এ নেমে গেছে, চার লাইন শুদ্ধ ওড়িয়া না বলতে পারা নবীন পট্টনায়ক ওড়িশার মানুষদের কাছে এক কাল্ট, এক মিথ। বাংলায় মমতা এক বাঙালি পাশের বাড়ির মহিলা, যিনি লড়ছেন বিজেপির বিরুদ্ধে, এক অবিসংবাদিত নেতার বিরুদ্ধে যিনি চোলাই চোলাই বাজবে জয়ের ভেড়ি বলে, দিদিকে হারানোর ডাক দেন। তামিলনাড়ুতে বিজেপির চেষ্টা সফল হবার আগে উত্তর ভারতেই তাদের দলের সংকট শুরু হয়ে যাবে। সব মিলিয়ে আঞ্চলিক দলকে লড়িয়ে দেবার তত্ত্ব মাঠে মারা গেছে। তাই দুটো দল, একই রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আঁচে বেড়ে ওঠার পরেও তারা বিজেপির স্বপ্ন অনুযায়ী উবে যাওয়া তো দূরস্থান, উল্টে সরব হচ্ছে বিজেপি বিরোধিতায়। স্ট্রাইক রেটের দিকে চোখ রাখুন, কংগ্রেসের মুখোমুখি বিজেপি দারুণ খেলছে, কিন্তু আঞ্চলিক দলের কাছে হেরে ভূত। ওই তত্ত্বে সবচেয়ে বড় ভুল ছিল, আঞ্চলিকতার বৈচিত্রে হাওয়া দেওয়া, আমাদের দেশের ফেডারেল স্ট্রাকচারটা আরও বেশি করে উঠে এসেছে, ভাষা, সংস্কৃতি, খাদ্য, পোশাকের বৈচিত্রকে অস্বীকার করে আরএসএস–বিজেপির এক জাতি, এক নেতা, এক ভাষার থিওরির ঠিক উলটো দিকে দাঁড়িয়ে আছে আঞ্চলিক দলের অভ্যুত্থান। ২৫টা বছর পরেও তাই দুই বিপরীত মেরুর দুটো আঞ্চলিক দল, বিজেপির সঙ্গে লড়াই করে জিতছে।
Html code here! Replace this with any non empty text and that's it.