জয়জ্যোতি ঘোষ
৭০ দশক মনে পড়ে? দুর্ভিক্ষ-দারিদ্রের যন্ত্রনায় হাহাকার আসমুদ্রহিমাচল। দু-বেলা দু-মুঠো অন্ন জোগাড় করতে ছুটে যাচ্ছে কালঘাম। এই অবস্থায় সাধারণ মানুষ এক নায়কের সন্ধানে বিভোর। যে নায়ক সবাইকে জীবনের জয়গান শোনাবে। শত প্রতিকূলতাকে হারিয়ে পৌঁছে যাবে অভীষ্ট লক্ষ্যে। সেই নায়কের মধ্যেই খুঁজে পাবে জীবনের রোমান্স। বেঁচে থাকার রোমান্স। অসম্ভবকে সম্ভব করার রোমান্স। ‘৭০ দশক’ তিনজন নায়ককে উপহার দেয়। সেলুলয়েডের পর্দায় ‘অ্যাঙ্গরি ইয়ং ম্যান’ অমিতাভ বচ্চন, সবুজ গালিচায় সুনীল গাভাসকর এবং কপিল দেব। এরমধ্যে কপিল দেব মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একনিষ্ঠ প্রতিনিধি। সাধারণ মানুষ আরও বেশি করে যেন ‘হরিয়ানা হ্যারিকেন’-এর মধ্যে নিজেদের খুঁজে পাচ্ছিলেন। ১৯৭৮-এর আগে ভারত সেই অর্থে ফাস্ট বোলার দেখেনি। তবে ৭৮-এর পর থেকে সেই অভাব মিটিয়ে দেন ‘হরিয়ানা হ্যারিকেন’! ১৯৫৯ সালের ৬ জানুয়ারি জন্ম হয় এই ভারত গৌরবের।
কপিল দেবের কেরিয়ারের বিশেষ কিছু মুহূর্ত:
১। ১৯৭৫-এর রঞ্জি ট্রফি
রঞ্জি অভিষেক খুব একটা মনে রাখার মতো ছিল না কপিল দেব নিখাঞ্জের। প্রথম ম্যাচ হরিয়ানা বনাম পঞ্জাব। সেইম্যাচে অনেকগুলি নো-বল করেছিলেন ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার। এই ম্যাচটি হয়েছিল রোহতাকে।
২। প্রথম শতরান-১৯৭৯
১৯৭৯ সালে দিল্লিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে প্রথম শতরান করেন কপিল দেব। টেস্ট ক্রিকেটে এক ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ার আগে এসেছে তাঁর এই শতরান। শতরানের পর তিনি বলেন, ‘এই শতরান আমাকে অনেক শান্তি দিয়েছিল। মানুষ বলতে শুরু করেছিল কপিল ব্যাট করতে জানে। ও ভালো অলরাউন্ডার হতে পারবে।’
৩। টেস্টে ১০০০ রান এবং ১০০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব
১৯৮০ সালে এই কীর্তির অধিকারী হন কপিল দেব। ১০০ উইকেট নেওয়ার পর কপিল বলেছিলেন, ‘১০০ উইকেট নেওয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। ভারতীয় সিমারদের মধ্যে আমিই প্রথম এই মাইলফলক স্পর্শ করেছিলাম। সেইসময় উপমাহেদেশীয় উইকেটে সিমারদের ১০০ উইকেট নেওয়া অবশ্যই মনে রাখার মতো একটা মাইলফলক।’
৪। কপিলের প্রথম ৫ উইকেট- ভারতের মেলবোর্ন জয়
১৯৮১ সালে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফর। মেলবোর্নে ইতিহাস ভারতের। গ্রেগ চ্যাপেলের অস্ট্রেলিয়াকে ৫৯ রানে হারায় সুনীল গাভাসকরের ভারত। নায়ক কপিল দেব এবং গুন্ডাপ্পা বিশ্বনাথ। মেলবোর্ন টেস্টের প্রথমদিন থেকেই থাই মাসলে চোট অনুভব করেন কপিল দেব। টেস্টের শেষদিন সামান্য ছন্দে ফেরেন তিনি। তাতেই কিস্তিমাৎ হরিয়ানা হ্যারিকেনের! প্রথম ৫ ওভার বল করার পর সুনীল গাভাসকর কপিলকে বলেছিলেন বিশ্রাম নিতে। কিন্তু কপিল শোনেননি। পালটা বলেন, ‘সবে ছন্দে ফিরেছি। এখনই থামিও না আমাকে। আমি আরও ওভার করতে চাই।’ শেষে একাই তুলে নেন ৫ উইকেট। টেস্টে তাঁর প্রথম ৫ উইকেট শিকার এটাই। কপিল দেবের বোলিং ফিগার- ১৬.৪-৪-২৮-৫।
৫। ১৯৮৩- কপিলের নেতৃত্বে ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়
কপিল দেবের অধিনায়কত্বে ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়। তাও আবার ক্লাইভ লয়েডের শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে। একমাত্র তিনিই বিশ্বাস করতেন যে অসম্ভবকে সম্ভব করে ক্রিকেট বিশ্বকাপ জেতার ক্ষমতা রাখে ভারত। এই বিশ্বকাপে টনব্রিজ ওয়েলসে জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলের করা ১৭৫ রানের ইনিংস চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। ১৭/৫-এই অবস্থা থেকে কপিলেরে এই মহাকাব্যিক ইনিংস আজীবন ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে থেকে যাবে। এছাড়া বিশ্বকাপ ফাইনালে ২০ গজ দৌড়ে কপিলের নেওয়া ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচটাও স্মৃতিতে চির অটুট। সেই ক্যাচটা না ধরলে ভারত বিশ্বকাপ হারতেও পারতো। তাই কপিলের নেওয়া ভিভের ক্যাচ ভারতের প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম মূল কারণ।
৬। ১৯৮৬ টাইড টেস্ট এবং কপিলের আগ্রাসী ইনিংস
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে টাইড টেস্টে দুরন্ত ইনিংস খেলেন কপিল দেব। ৭ নম্বরে নেমে ১৩৮ বলে ১১৯ রানের ইনিংস খেলেন। মারেন ২১টি বাউন্ডারি। স্ট্রাইক রেট ৮৬.২৩। ফলো অনের মুখে কপিল দেবের এই আগ্রাসী ব্যাটিং সত্যিই প্রশংসনীয়।
৭। ১৯৯০- লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে পরপর চারটি ছয়
১৯৯০ সালে লর্ডসে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ব্যাট হাতে নিজের দাপট দেখান কপিল দেব নিখাঞ্জ। এডি হেমিংসকে পরপর চার বলে চারটি ৬ মেরে নিজের অন্যরূপ দেখান হরিয়ানা হ্যারিকেন। একইসঙ্গে নিজস্ব স্টাইলে বার্তা দেন গোটা ক্রিকেট দুনিয়াকে।
সবশেষে একটা কথা বলেই শেষ করতে চাই- ‘কপিল দা! আপকা জবাব নেহি…জনমদিন বহুত বহুত মুবারক!’