Saturday, July 5, 2025
HomeScrollFourth Pillar | বিহারে নিশ্চিত হারবে বিজেপি, তাই ভোট লুঠ করতে নেমেছে
Fourth Pillar

Fourth Pillar | বিহারে নিশ্চিত হারবে বিজেপি, তাই ভোট লুঠ করতে নেমেছে

বিহারে সবথেকে চর্চার বিষয়, ভোটার তালিকা সংশোধন

Follow Us :

বিহারে নীতীশ কুমারের হাল এতটাই খাস্তা যে বিজেপিও ভরসা রাখতে পারছে না। অনেকে তো বলছে যে নীতীশ কুমার বয়সজনিত কিছু রোগে আক্রান্ত, কখন কী করছেন, তা নিজেও জানেন না। এদিকে নীতীশ কুমারও স্পষ্ট বুঝে গেছেন যে তাঁর দিন ঘনিয়ে এসেছে, কিন্তু তিনি এই বৃত্ত থেকে বের হবেন, সেই সামর্থ্য কবেই হারিয়েছেন। মাথার উপর খড়্গের মতো ঝুলছে একদা বন্ধু রামবিলাস পাসোয়ানের পুত্র চিরাগ পাসোয়ান, ওনার অর্জুনের চোখ দেখছে কেবল মুখ্যমন্ত্রীর কুর্সিকে। এদিকে বিজেপি জানে জেডিইউ, মানে নীতীশ কুমারের দল হারলে বিরাট বিপদ, তাই তারাও কোনও চান্স নিতে চায় না, ভোটের আগেই ভোট লুটের ব্যবস্থা সেরে ফেলেছে। আর তাই আজ বিহারে সবথেকে চর্চার বিষয়, বিহারে ভোটার তালিকা সংশোধন। আপনি ভোটার না নাগরিক? এই প্ল্যান অনেকে ভেবে চিনতে করা হয়েছে, এ এমন এক অস্ত্র যা বিহারে কাজ করলে এই বাংলাতে কামাল করে দিতে পারে, তাই বিহারে এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হওয়ার আগেই বাংলা থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, হাঁক ছেড়েছেন, ওসব নাক ঘুরিয়ে এনআরসি চলবে না।

২০২৫ সালের জুলাই মাসে বিহারে হঠাৎ করে নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করল, ভোটার তালিকা নতুন করে সংশোধন হবে। শুনতে খুব স্বাভাবিক মনে হলেও, এর নিয়ম এত জটিল যে বিহারের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গরিব, দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু, অভিবাসী শ্রমিক, এমনকী শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাও আতঙ্কে পড়ে গেছেন— ভোটটা দিতে পারবেন তো? কী চাইছে নির্বাচন কমিশন? কমিশনের নিয়ম বলছে— যদি কারও নাম ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় না থাকে, তাহলে তাকে প্রমাণ করতে হবে সে ভারতীয় নাগরিক। প্রমাণ করতে হলে কী কী দিতে হবে? জন্মসনদ, বাবা-মায়ের নাগরিকত্বের প্রমাণ, বাবা-মায়ের সঙ্গে সম্পর্কের প্রমাণ— মানে এক কথায় নাগরিকত্ব প্রমাণের পুরো হিসেব। আর এ সবই করতে হবে মাত্র এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে! ২০০৩ সালের পর ভোটার তালিকায় যাদের নাম উঠেছে, বিশেষ করে যাদের জন্ম ১৯৮৭ থেকে ২০০৭-এর মধ্যে, তাদের জন্য এই নিয়ম বাধ্যতামূলক। সমস্যা হচ্ছে, বিহার সেই সময় বার্থ রেজিস্ট্রেশনে, জন্মনিবন্ধনে দেশের মধ্যে অন্যতম পিছিয়ে থাকা রাজ্য ছিল। সরকারি হিসাবেই দেখা গেছে— ২০০০ সালে বিহারে জন্মের রেজিস্ট্রেশন হয়েছিল মাত্র ৩.৭ শতাংশ, আর ২০০৭-এ সেটা ছিল মাত্র ২৫ শতাংশ। এতেই বোঝা যায়, লাখ লাখ মানুষ জন্মসনদ দিতে পারবে না।

হ্যাঁ, এইখানেই বিজেপির আসল খেলাটার শুরু। কংগ্রেস সাংসদ অভিষেক মনু সিংভি প্রশ্ন তুলেছেন, ২০০৩ সালের পর থেকে যে সব নির্বাচন হয়েছে সেগুলো কি সবই ভুল বা ত্রুটিপূর্ণ ছিল? তিনি সাংবাদিকদের বলেছেন, “ আমরা কমিশনকে বলেছি— শেষবার ভোটার তালিকা পুরোপুরি সংশোধন হয়েছিল ২০০৩ সালে। তারপর তো বিহারে চার-পাঁচটা নির্বাচন হয়ে গেছে। তাহলে কি সবগুলোই ভুলভাল ছিল? এখন জুলাই মাসে মাত্র এক- দু’মাস সময় নিয়ে আপনারা আবার নতুন করে এত বড় রাজ্যে, যেখানে প্রায় ৮ কোটি ভোটার আছে তালিকা সংশোধন করতে চাইছেন!” কাজেই রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হয়েছে। এই ঘটনার পরই উঠেপড়ে মাঠে নেমেছে বিরোধী দলগুলো। কংগ্রেস, আরজেডি, সিপিআই(এম), সিপিআই(এমএল), ডিএমকে-সহ ১০টি INDIA জোটের দল নির্বাচন কমিশনের অফিসে গিয়ে সরাসরি অভিযোগ তোলে— এইভাবে নিয়ম বদলে অন্তত ২–৩ কোটি মানুষ ভোটাধিকার হারাতে পারেন। তাদের বক্তব্য খুব পরিষ্কার: ১) এত কম সময়ে এই কাজ সম্ভব নয়। ২) গরিব মানুষের পক্ষে এত নথি জোগাড় করা সম্ভব নয়। ৩) বিহারের ২০ শতাংশ মানুষ ভিনরাজ্যে কাজ করতে যান— তাঁরা কীভাবে প্রমাণ করবেন কোথায় থাকেন? ৪) বাবা-মায়ের জন্মসনদ আনা, বিশেষ করে আদিবাসী বা দলিত পরিবারে, এক কথায় অসম্ভব। ৫) ভোট মানে গণতন্ত্র, আর ভোট থেকে কাউকে বাদ দেওয়া মানে সংবিধানের মৌলিক কাঠামোতে হাত দেওয়া। RJD সাংসদ মনোজ ঝা বলেছেন, “আমরা এমন মানুষের কথা বলছি, যাদের নিজের কাগজপত্র রাখার মতো স্যুটকেসও নেই। আপনি তাঁদের বলছেন বাবা-মায়ের জন্মসনদ আনতে! এটা কেমন ন্যায্যতা?” লজ্জার কথা, স্বাধীনতার অমৃতকাল পার হয়েছে, তবুও একজন এমপি-র মুখেই শুনতে হচ্ছে যে বহু মানুষের একটা স্যুটকেসও নেই, যেখানে তাঁরা তাঁদের প্রয়োজনীয় নথিপত্র রাখতে পারবেন।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | নিরুদ্দেশ কেজরিওয়াল

সে যাই হোক, সেটাই তো বাস্তব। CPI(ML)-এর দীপঙ্কর ভট্টাচার্য বলেন, “এই তো এক ধরনের ভোটবন্দি! অনেকেই বলছেন, এটা আবার ‘নোটবন্দির’ মতো আচমকা, মানুষকে দিশেহারা করে দেবে।” এমন নয় যে বিহারের ক্ষমতাসীন জোটের সবাই খুশি, কারণ তারাঁও বুঝতে পারছেন না যে এই ফতোয়া মানুষ কীভাবে নেবে? কাজেই এনডিএর অবস্থান দ্বিধায় ভরা। বিজেপি ও তার শরিক দলগুলো যেমন জেডিইউ, এলজেপি ইত্যাদি প্রকাশ্যে বলছে— কমিশনের কাজ ঠিক আছে। কিন্তু দলগুলোর ভেতরে চিন্তা স্পষ্ট: এত কম সময়ে এত বড় কাজ করতে গিয়ে অনেক সত্যিকারের ভোটারই বাদ পড়ে যাবেন না তো? নাম বলতে রাজি নন জেডিইউ-এর এমন এক নেতা বলেন, “সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হবে অত্যন্ত পিছিয়ে থাকা জাতিগুলোর। এরা না উচ্চবর্ণ, না দলিত, আবার রাজনৈতিক প্রভাবও কম। ফলে নথি জোগাড় করতে না পারলে ভোট থেকেই বাদ পড়তে পারে।” বিজেপিরও কিছু নেতার ভয়— ভোটারের নাম বাদ যাওয়ার ফলে রাজনৈতিক চাপ আসবে। যদিও তারা এটাও বলছে— ভুয়ো ভোটার আর অনুপ্রবেশকারীদের তালিকা থেকে ছেঁটে ফেলতে এই ব্যবস্থা দরকার। জেডিইউ মুখপাত্র রাজীব প্রসাদ আবার আগ বাড়িয়েই বলেছেন, “আমরা তো এখনই ৫ কোটি ভোটারকে বাইরে রেখেছি— তাঁদের কিছু লাগবে না। বাকিরা কাগজ দিক। সব জাতিগোষ্ঠীই এখন কোনও না কোনও জাতি বা বাসস্থানের প্রমাণপত্র পায়।” সেই ৫ কোটি কারা? কোন হিসেবে এই সংখ্যা জেনে ফেললেন তিনি? না সেসব নিয়ে একটা কথাও বলেননি। কিন্তু প্রশ্ন তো থেকেই যায় নাগরিকত্ব প্রমাণ এত সহজ? এই প্রশ্নটাই সবচেয়ে বড় কারণ ভারতে আজও নাগরিকত্ব প্রমাণ করার জন্য কোনও একক সনদ নেই। আইন অনুযায়ী— ১৯৮৭ সালের আগে জন্ম হলে শুধু জন্মস্থান প্রমাণ করলেই চলে। হ্যাঁ, সেই নথির ভিত্তিতেই নরেন্দ্র মোদি ভারতের নাগরিক। ১৯৮৭-র পর জন্ম হলে লাগবে নিজের জন্মসনদ, বাবা-মায়ের নাগরিকত্বের প্রমাণ আর তাঁদের সঙ্গে সম্পর্কের নথি।

অথচ, বাস্তব বলছে— এসব কাগজ পেতে গেলে জীবন থামিয়ে কোর্ট-কাছারি করতে হয়। অনেক গ্রামীণ পরিবারে সন্তানের জন্ম হয় বাড়িতে— রেজিস্ট্রি নেই। অনেকে নাম রাখে পরের পুজোয়— জন্মসনদে নাম থাকে না। অনেক নারী বা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পরিবার ত্যাগ করে বাঁচে, তাদের কাগজে বাবা-মায়ের নামই নেই। আইনি দৃষ্টিতে, আধার, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড, এইসবকেও নাগরিকত্বের প্রমাণ ধরা হয় না। তাই একটা মানুষের সারা জীবন ধরে বানানো কাগজপত্র হয়তো কাজে আসবে না। বোঝার চেষ্টা করুন, এরফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত কারা? এই প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বিপদে পড়ছেন— ১) গরিব ও অশিক্ষিত মানুষ, ২) দলিত, আদিবাসী ও অত্যন্ত পিছিয়ে পড়া জাতিগোষ্ঠী, ৩) অভিবাসী শ্রমিক, যাঁরা অন্য রাজ্যে কাজ করেন, ৪) নারী ও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ, যাদের কোনও কাগজেই পিতৃপরিচয় থাকে না।

আইনজীবী ও গবেষকদের মতে, নাগরিকত্বের বোঝা আজ সাধারণ মানুষের কাঁধে এমনভাবে চাপানো হয়েছে, যা এক ধরনের ‘রাজনৈতিক পরীক্ষা’। এবং যাঁরা এই পরীক্ষার প্রশ্ন পড়তেই জানেন না, তাঁদের কীভাবে উত্তীর্ণ হবেন? শেষ কথা হল গণতন্ত্রে ভোট শুধুই একটা অধিকার না, এটা পরিচয়ের স্বীকৃতি। কে এই দেশে নাগরিক, কে নয়, সেটা ঠিক করার ভার যখন সরকার জনগণের ঘাড়ে ফেলে দেয়, তখন সেটা আর গণতন্ত্র থাকে না, তখন গণতন্ত্র এক নিছক প্রহসন হয়ে দাঁড়ায়। বিহারে যা হচ্ছে, তা কেবলমাত্র একটা রাজ্যের সমস্যা নয়। কারণ এরপরেই এটা লাগু করার চেষ্টা হবে বাংলায়। কারণ এটা গোটা ভারতীয় নাগরিকত্বের জটিল বাস্তবতা তুলে ধরছে। যেখানে প্রমাণ দিতে না পারলেই আপনি দেশের নাগরিক নন, ভোটার তো দূরের কথা। এমনটা চলতে থাকলে একদিন হয়তো রাষ্ট্র আমাদের সবাইকেই বলবে— তুমি কে? আগে প্রমাণ দাও। তারপরই কথা বলব। তারপর তুমি নাগরিক, তারপর তুমি ভোট দিতে পারবে।

RELATED ARTICLES

Most Popular


Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39