সংসদে দাঁড়িয়ে নতুন ভারতের ইতিহাসের কথা বলছেন, ভিকটিম কার্ড খেলছেন, বিরোধীরা হিন্দুদের অপমান করেছে। আসলে এক নার্ভাস মোদি আরও স্মার্ট হওয়ার, বা বলা ভালো যাতে স্মার্ট দেখায়, তার চেষ্টা করছেন। কিন্তু এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে হাত গুটিয়ে বসে আছেন, বরং উল্টোটা। এবারে পাঠ্য বই থেকে বাবরি মসজিদের নামও তুলে দিল বিজেপি সরকার। তারা পরিকল্পনা করেই বাবরি মসজিদ ভেঙেছিল, এবারে তার ইতিহাসও ভুলিয়ে দিতে চায়। আসলে ইতিহাসের বহু পরতে শাসকের ধর্ম শাসকের সায় পেয়েই প্রবল হয়েছে। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা বৌদ্ধ মুণ্ডিতমস্তক সন্ন্যাসী, সন্ন্যাসিনীদের নেড়া নেড়ি বলত, রাস্তায় দেখলে ঢিল মারত, তাদের মঠ গুঁড়িয়ে দিয়েছে হিন্দু সম্রাট, রাজারা। আবার বৌদ্ধদের হাতে ভাঙা পড়েছে হিন্দু প্রাচীন মন্দির, সে ছিল বৌদ্ধ রাজাদের শাসনকাল। ঠিক তেমনই ইসলামিক শাসনকালে ভাঙা হয়েছে মন্দির, চাপানো হয়েছে জিজিয়া কর, তীর্থ কর, এসব আছে। আবার উল্টো ঘটনাও আছে, না থাকলে তুলসীদাসের রামচরিত মানস জ্বলেপুড়ে ছাই হয়ে যেত বর্ণ হিন্দুদের আক্রমণের হাত থেকে। তুলসীদাস আর রামচরিত মানসের পান্ডুলিপি বাঁচিয়েছিলেন নবাবের সিপাহিরা। এসব ইতিহাসে হয়েছে। ইতিহাসের সেই সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে তার পতনের এটাও অন্যতম কারণ মানে এই ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি, ধর্মকে শাসনের হাতিয়ার করাটা এক অন্যতম কারণ ছিল। এক গণতান্ত্রিক কাঠামোতে আজ থেকে ৩০০-৪০০-৫০০ বছর আগে কী হয়েছিল তার ইতিহাস জানাতে, বোঝাতে, লেখাতে তো কোনও ভুল নেই, কিন্তু সেদিন মন্দির ভাঙা হয়ে থাকলে আজ সেই মসজিদ ভাঙা হবে, সেদিন মসজিদ ভাঙা হয়ে থাকলে আজ সেটা গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে সেটা তো সভ্য সমাজের সভ্য রাষ্ট্রের নিয়ম হতেই পারে না।
কিন্তু এক বর্বর রাজনৈতিক দল এই বিজেপি সকলের চোখের সামনে পরিকল্পনা করে ভেঙেছিল বাবরি মসজিদ। কেন? আমাদের কল্পনার রামচন্দ্র, আমাদের বিশ্বাসের রামচন্দ্র, পুরাণকথার রামচন্দ্রের জন্ম নাকি ওইখানেই হয়েছিল। তাই মসজিদ ভাঙা হল, এবং সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করেই ভাঙা হল। ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ যে ঘটনা ঘটেছিল, তা নিয়ে দুটো মামলা হয়েছিল ওই দিনেই। পরে তার রায় দেওয়া হল, জানা গেল, কেউ দোষী নয়, কারও বিরুদ্ধেই তেমন কোনও প্রমাণ নেই। লাড্ডু বিতরণ হয়েছে, জয় শ্রীরাম ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হয়েছে দিক থেকে দিগন্তরে। এবার এই রায় নিয়ে মন্দির তৈরি হয়েছে, এই রায়ের পরে নিশ্চিত স্লোগান উঠেছেও, ইয়ে তো পহেলি ঝাঁকি হ্যায়, কাশী মথুরা বাকি হ্যায়। আইন নাকি আইনের পথেই চলছে, চলেছে। এবং বাম ডান প্রত্যেক দলের নেতারা বলেছেন আদালতের রায় শিরোধার্য, তাঁরা এই রায়কে বড়জোর দুঃখজনক বলেছেন, তার বেশি কিছু নয়। আর দেশের এক পঞ্চমাংশ মানুষ তাদের গলার স্বর আরও নিচু করেছে, তারা আরও কুঁকড়ে গেছে, তারা আরও বদ্ধ এলাকার মধ্যে ঢুকেছে, ঘেটো তৈরি হচ্ছে, তারা থাকবে বিচ্ছিন্ন হয়ে, তাদের কারও কারও ক্রোধ কাজে লাগবে সন্ত্রাস ছড়ানোর সংগঠনগুলোর। গোটা দেশ অবাক হয়ে দেখবে, যে ঘটনাকে প্রত্যেকে অন্যায় বলছে, আদালত বলছে, আদালত বলেছে এই বাবরি মসজিদ ভাঙাটা বেআইনি ছিল, আদালত একবারের জন্যও বলেনি যে কল্পকথার পুরাণের রামচন্দ্র এখানেই জন্মেছিলেন, একবারও এটাও বলেনি যে তাঁরা নিশ্চিত যে এখানে একটা মন্দির ছিল, যার উপরে মসজিদ তৈরি হয়েছে। বিজেপি নেতারাও ওই মসজিদ ভাঙা নিয়ে কী বলছেন? তাঁরাও কেউ বুক ঠুকে একথা বলেননি যে বেশ করেছি, অটলবিহারী থেকে আদবানি প্রত্যেকেই এই ঘটনায় নাকি ছিলেন বিচলিত ও দুঃখিত। অন্যায় হয়ে গেল, কিন্তু কেউ শাস্তি পেল না, কাউকে দোষী সাব্যস্ত করা গেল না।
একটু পুরনো পাতাগুলো ঝালিয়ে নিই। বাবরের সেনাপতি মির বাঁকি, আনুমানিক ১৫২৮-এ বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিলেন, সে মসজিদ হিন্দু মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছিল কি না, তার কোনও তথ্য ইতিহাসে নেই। তবে এদেশে বহু মন্দির ভাঙা হয়েছে, বৌদ্ধ মঠ বিহার ভাঙা হয়েছে, মসজিদও ভাঙা হয়েছে, তার উপরে তৈরি হয়েছে অন্য ধর্মের উপাসনালয়, বহু বুদ্ধবিহার গুঁড়িয়ে দিয়ে তৈরি হয়েছে মন্দির, মন্দির ভেঙে তৈরি হয়েছে মসজিদ। এসব মধুযুগীয় ব্যাপার, যেখানে আইনের শাসন মানে ছিল রাজার শাসন, তাঁর ধর্মই ছিল রাজধর্ম, তিনিই আইন, তিনিই বিচারক, তিনিই প্রশাসক, তিনিই অভিযোগ শুনতেন, তিনিই বিচার করতেন। বহু অন্যায়ের সৌধের উপরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র ভেঙে গেছে, রাজছত্র নাহি আর, রণডঙ্কা শব্দ নাহি তোলে। তো সেই মসজিদ তৈরি হওয়ার পরে মানুষজন তাকে বাবরি মসজিদ বলে ডাকা শুরু করে, ওই একই চত্বরে এক মন্দিরও ছিল। ৩০০ বছর ধরে হিন্দুরা পুজো করেছেন, মুসলমানরা ইবাদত করেছেন। ১৮২২ সালে ফৈজাবাদ আদালতে এক মামলা হয়, নির্মোহী আখাড়ার করা সেই মামলাতে জানানো হয় যে এই জায়গা তাদের। ১৮৫৫তে এই দাবিকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়, ১৮৫৯-এ ব্রিটিশরা এক রেলিং করে দুটো উপাসনাস্থলকে আলাদা করে দিল। স্বাধীনতার পরে ২২ ডিসেম্বর ১৯৪৯, রাত ৩টের সময় আযোধ্যার আকাশে বিদ্যুৎ চমকাল। এবং বিদ্যুতের চেয়েও বেশি বেগে খবর পৌঁছে গেল “রামলালা নিজেই অবতীর্ণ হলেন তাঁর জন্মভূমীতে।” বাবরি মসজিদকে ঘিরে সেখানকার হিন্দু সাধুদের যে দাবি ছিল তা হয়ে উঠল আরএসএস হিন্দু মহাসভার দাবি। সেই থেকে শুরু মন্দির ওহি বনায়েঙ্গের আন্দোলন।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ইডি, আদালত, কৌস্তুভ রায়, কেজরিওয়াল আর হেমন্ত সোরেন, মামলা কিন্তু এক (পর্ব – ২)
আসল ঘটনা জানার পর পরের দিনই অযোধ্যা থানার ওসি রামদেও দুবে এফআইআর করলেন যে অভিরাম দাস, রামসকল দাস আর সূদর্শন দাস এবং আরও কয়েকজন মিলে মসজিদে ঢুকে রামালালার মূর্তি বসায়, মসজিদের গায়ে কিছু আঁকিবুকিও কেটে আসে। সেই সময়ে অযোধ্যায় শহর হাকিম গুরু দত্ত সিং, জেলা হাকিম কে কে নায়ার, এস পি কৃপাল সিং এবং বিচারক ঠাকুর বীর সিং এঁরা বৈঠক করেন, রামলালা ভিতরেই থেকে যায়, গ্রেফতার হয় না, দর্শন চলতে থাকে। এই চারজনের প্রত্যক্ষ সাহায্যেই রামলালার মূর্তি থেকে যায়। পরে আদালতের আদেশে দর্শন বন্ধ হয়। এই অযোধ্যারই শহর হাকিম গুরু দত্ত সিং ছিলেন রামভক্ত, বাড়ির নাম দেন রামভবন। এঁর নাতি বিজেপি নেতা শক্তি সিং যিনি গুমনামিকে তাঁর বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন, এবং এখনও প্রেস মিডিয়াকে ডেকে ২৩ জানুয়ারি গুমনামি সমাধি স্থলে ভাষণ দেন, বলেন গুমনামির মতো এক কাপুরুষই নাকি আসলে নেতাজি ছিলেন। আসলে সব গরুরা এক জায়াগাতেই এসে মিলে যায়।
আদালতে মামলা শুরু হল, আর মসজিদে উপাসনা বন্ধ করলেন মুসলমানরা। আদালত এলাকাটাকে বিতর্কিত বা ডিসপিউটেড বলে ঘোষণা করল। ১৯৮০তে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ আন্দোলন শুরু করল, তাদের দাবি ছিল রামলালার পুজো বন্ধ রাখা যাবে না। ৮৬তে জেলা আদালতের এক বিচারক রায় দিলেন যে হিন্দুদের জন্য দরজা খুলে দেওয়া উচিত, এদিকে বিজেপি তখন দুটো প্রচারকে তুঙ্গে নিয়ে গেছে। এক, শাহ বানো মামলা, তাদের অভিযোগ মুসলিমদের তুষ্ট করার জন্যই রাজীব গান্ধী এই রায় খারিজ করলেন। দুই, রামমন্দির, তাদের দাবি, ওই চত্বরে পুজো করতে দিতে হবে। রাজীব গান্ধী এবার হিন্দু তুষ্টিকরণের রাজনীতি করলেন, তিনি মন্দিরের দরজা খুলে দিলেন। এর ফায়দা পেল আরএসএস-বিজেপি। যা ছিল কেবল রামলালা দর্শন, পুজোর, এবার তারা এক ধাপ এগিয়ে মন্দির নির্মাণের স্লোগান তুলল। ৯০-এ আদবানির রথযাত্রা, যে যাত্রায় সঙ্গী ছিলেন আজকের প্রধানমন্ত্রী, যেখান দিয়ে রথ গেল সেখানেই দাঙ্গা, মানুষের সমর্থন বাড়ছে, ভোটের মেরুকরণ হচ্ছে, মুসলমান তুষ্টিকরণের কথা মানুষ বিশ্বাস করছেন, হিন্দু খতরে মে হ্যায়, মানুষ মেনে নিচ্ছেন।
এরপর ১৯৯২, করসেবা, সারাদেশ থেকে ইট নিয়ে গেল, আরএসএস, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, শিবসেনা, বিজেপি, কল্যাণ সিং সরকার আদালতকে জানাল তারা বাবরি মসজিদের সুরক্ষার দায়িত্ব নিচ্ছে, কেউ বিতর্কিত জমিতে ঢুকবে না। তারপর ক্যামেরার সামনে, মানুষের চোখের সামনে সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে বিকেল ৫টার মধ্যে ওই সুবিশাল মসজিদের কাঠামো চুরমার করে দিল উন্মত্ত মানুষের দল, চোখের সামনে তা দেখলেন আদবানি, জোশি, সিঙ্ঘল, উমা ভারতীরা। ৬ ঘণ্টায় ওই বিশাল ইমারত এমনি এমনি ভাঙা সম্ভব নয়, যদি না তার আগাম প্রস্তুতি থাকে, আগাম পরিকল্পনা থাকে, একথা যে কেউ বলবে, সেই সময়কার প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাও একথা বলেছিলেন সাংবাদিক করণ থাপারকে। উনি না বললেও এটা ছিল জলের মতো পরিষ্কার এক তথ্য, যা আজ আদালত নাকচ করে দিল, আদালত জানাল ওটা ছিল ভিড়ের উন্মত্ততা, সবটাই তাৎক্ষণিক ব্যাপার, কাজেই তার জন্য কাউকে দোষী বলা যায় না, তাদের দোষ প্রমাণও করা যায় না। চোখের বদলে চোখ, এটাই যদি রীতি হয়, তাহলে গোটা দুনিয়াটাই একদিন চক্ষুহীন হয়ে যাবে, জাতির পিতা বলেছিলেন, আজ আমরা কোন পথে? ৫০০ বছর আগে কে মন্দির ভেঙেছিল? আজ আমরা তার জবাব চাইছি।
এক মিথোলজিক্যাল, কল্পকথার নায়কের জন্মভূমি নিয়ে দেশের মানুষ ভাগ হয়ে গেছে, ১৭ শতাংশ কুঁকড়ে থাকা, পিছিয়ে পড়া মানুষ নাকি দেশের গরিষ্ঠাংশ মানুষের সামনে সবচেয়ে বড় সমস্যা, কোন পথে চলেছি আমরা? আমদের ঠাকুর বলেছিলেন, অন্ন চাই, প্রাণ চাই, আলো চাই, চাই মুক্ত বায়ু, চাই বল, চাই স্বাস্থ্য, আনন্দ-উজ্জ্বল পরমায়ু। আমরা আজ কী চাইছি? আমাদের সমাজ কী চাইছে? রাষ্ট্র কী চায়? সভ্যতা পিছোলে ধ্বংস হয়, আবার নতুন সভ্যতা গড়ে ওঠে, বহু হাজার পর কোনও সুসভ্য মানুষ হা হা করে হাসবে অযোধ্যা রায়ের পাঠোদ্ধার করে। না মহামান্য বিচারপতি, আপনার রায়ের কোনও সমালোচনা আমি করছি না, করবই বা কী করে? হা হা করে হাসছে তো হাজার বছর পরে জন্ম নেওয়া নতুন সভ্যতার এক মানুষ, তার সহজ প্রশ্ন, তার একটাই প্রশ্ন, এই বিচারের প্রহসনের কি খুব দরকার ছিল? কিন্তু মানুষ সব্বার ঊর্ধ্বে, সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই। অযোধ্যার মানুষ হারিয়ে দিয়েছে বিজেপিকে, কন্যাকুমারিকার মানুষ হারিয়েছে বিজেপিকে, কালীঘাটের মানুষ হারিয়েছে বিজেপিকে। মানুষ ধর্মকে তার ব্যক্তিগত পরিসরেই রাখতে পছন্দ করে, ধর্ম নিয়ে মানুষকে বিভাজন করার পলিসি তো ছিল ইংরেজদের, ফেল করেছে, আজ আরেকবার মানুষ রুখে দাঁড়াল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের বিরুদ্ধে। তাই ভয় পেয়ে এবার ইতিহাস ভোলাতে চায় আরএসএস–বিজেপি। একমুখে সংসদে প্রধানমন্ত্রী বিকাশ আর উন্নয়নের কথা বলছেন, অন্যদিকে ইতিহাস মুছে ফেলতে চাইছেন। ইতিহাস মানুষ লেখে, ইতিহাস মানুষ ভোলে না।