Monday, June 9, 2025
Homeখেলাভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার

ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম সুপারস্টার

Follow Us :

কলকাতা: ১৯০৮ সালের ৩০ এপ্রিল। রাত সাড়ে আটটা। মুজফফরপুরের কুখ্যাত কিংসফোর্ডকে ওড়াতে গিয়ে ভুল করে অন্য একটি গাড়িতে বোমা উড়ে আসে। সেই গাড়িতে ছিলেন কেনেডিকন্যা ও তাঁর মা। ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকীর পরবর্তী জীবন, আমরা জানি। এর কিছু দিন পর ৩১ অগস্ট, সত্যেন্দ্রনাথ বসু ও কানাইলাল দত্ত একেবারে আলিপুর জেলের মধ্যেই হত্যা করেন একদা বন্ধু পরবর্তীতে ব্রিটিশ চর হয়ে যাওয়া নরেন গোঁসাইকে। ৯ নভেম্বর খুন করা হয় নন্দলাল ব্যানার্জিকে। তিনিই সেই সাব-ইন্সপেক্টর যাঁর কারণে প্রফুল্ল চাকী ধরা পড়েছিলেন। বাংলায় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এমন রক্তক্ষয়ী আন্দোলন যখন চলছে, দেশের পশ্চিম অংশে তখন বাল গঙ্গাধর তিলকও তাঁর সংবাদপত্র কেসরী-তে ক্ষুদিরাম ও প্রফুল্লের দুর্জয় সাহসকে কুর্নিশ জানালেন মুক্তকণ্ঠে। তিলকের এমন প্রশংসার ফলে তাঁর জায়গা হল মান্দালয়ের জেলে। বম্বেজুড়ে বন্ধ দোকানপাট, বিধ্বস্ত জনজীবন, রক্তও ঝরল। ওদিকে লন্ডনে তখন শ্যামজি কৃষ্ণভার্মার নেতৃত্বে ইন্ডিয়ান হোম রুল সোসাইটিও তৈরি হয়েছে। কৃষ্ণভার্মা ১৯০৫ সালেই ‘ইন্ডিয়া হাউজ’ও তৈরি করেছিলেন উত্তর লন্ডনে। এটি মূলত দেশ থেকে আসা ছাত্রদের জন্য একটি হস্টেল। অসংখ্য রাজনীতিমনস্ক মানুষেরও এখানে স্থান হত। তিনি ছ’টি ফেলোশিপের ব্যবস্থা করেন। তারই একটি নিয়ে এখানে ঠাঁই হয়েছিল বিনায়ক দামোদর সাভারকারের। সাভরকারের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন মদনলাল ঢিংরা, যিনি টটেনহ্যাম কোর্ট রোডে কার্জন ওয়াইলিকে হত্যা করেন। এর পিছনে যে সাভারকার ও শ্যামজি কৃষ্ণভার্মার ‘মন্ত্রণা’ ছিল, ব্রিটিশরা একপ্রকার নিশ্চিত ছিল।

ভাবছেন ধান ভানতে শিবের গীত গাইছি। মোটেই না, কারণ, ইংরেজরা একের পর এক ঘটনায় তিতিবিরক্ত হয়ে উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠছে গোটা দেশ, দিকে দিকে স্বাধীনতার লড়াই মোচড় দিচ্ছে। ইংরেজ ভারত ছাড়ো, গর্জন উঠছে আসমুদ্র হিমাচল। ক্ষিপ্ত ব্রিটিশরা ভাবছে নেটিভদের মেলামেশা বন্ধ করতে হবে, বন্ধ করতে হবে আরও অনেক কিছুই। বড্ড বাড় বেড়েছে, এবার একটা হেস্তনেস্ত না করলেই নয়! ভাঙনের অমন ক্ষণ যখন অবশ্যম্ভাবী, তখনই ১৯১১ সালে ঘটল এক অদ্ভুত ঘটনা। বেজে গেছে বঙ্গভঙ্গের ঘণ্টা। বাংলায় তখন নিজেদের একত্রিত করে নিচ্ছেন একদল তরুণ ফুটবলার। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সবুজ ঘাসের মাঠে রক্ত ঝরাতে তৈরি করে নিচ্ছে নিজেদের। ঠিক সেই সময়েই ভারতীয় ভূখণ্ডের পশ্চিম প্রান্তে চলছে আরেক প্রস্তুতি। তবে সেখানে হাতিয়ার ক্রিকেট। খেলাকে সামনে রেখেই ঔপনিবেশিক শাসকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো। সারা ভারত থেকে সেরা ক্রিকেটারদের বাছাই করে তৈরি হল প্রথম ‘অল ইন্ডিয়া’ দল। অধিনায়ক পাটিয়ালার রাজা ভুপিন্দর সিং। তবে এই দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য প্রথম আবেদন গিয়েছিল প্রিন্স রণজিৎ সিংয়ের কাছে। তবে তিনি সেই আবেদন ফিরিয়ে দেন। কারণ ভারতের হয়ে খেলে ব্রিটিশ-বন্ধুত্বের গায়ে আঁচড় লাগতে দেওয়ার পক্ষপাতী নন তিনি।

আর্থিকভাবে সাহায্যের হাত বাড়ালেন তৎকালীন সময়ের অন্যতম স্বদেশি ব্যবসায়ী জামশেদজী টাটার দুই পুত্র রতনজি টাটা এবং দোরাবজি টাটা। দল তৈরির পরে দেখা দিল উটকো সমস্যা। রাজার খেলা ক্রিকেট, সেখানে কি না দলে দুই দলিত ক্রিকেটার। একজন তো প্রথম একাদশে। উচ্চবর্গের ক্রিকেটাররা বেঁকে বসলেন তাঁর সঙ্গে খেলতে। দলগঠনের পিছনে থাকা অন্যতম ব্যক্তি, ইউরোপিয়ান ক্রিকেটার জন গ্লেনি গ্রেগ, যিনি জংলী গ্রেগ নামেই পরিচিত, সিদ্ধান্তে অটল। কাজেই অপরিবর্তিত দলই পাড়ি দিল বিদেশে। যে দুই ক্রিকেটারকে নিয়ে বিতর্ক, একজন পালওয়ঙ্কর বালু, অন্যজন তাঁরই ভাই পালওয়ঙ্কর শিবরাম। ব্রিটেনের সেই তিন মাসের ট্যুরে তেমন সাফল্য পায়নি ভারত। ব্রিটেনে গিয়ে বেপাত্তা হয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং অধিনায়ক ভুপিন্দর সিং (Bhupinder Singh) এবং অন্যতম ব্যাটার কেকি মিস্ত্রি। তার সঙ্গে প্রিন্স রঞ্জির (Prince Ranjir) অনুপস্থিতি তো ছিলই। ইংরেজ বোলিংয়ের সামনে সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা। তবে তারপরেও ম্যাচ জেতা খুব একটা সহজ হয়নি ইংরেজদের। তার একমাত্র কারণ পালওয়ঙ্কর বালু। তাঁর বাঁ-বাতি বিষাক্ত স্পিনে নড়ে গিয়েছিল ইংরেজ ব্যাটারদের স্টান্স। পুরো টুর্নামেন্টের সেরা উইকেট শিকারির স্বীকৃতি ছিনিয়ে আনলেন একজন ভারতীয়। শুধুমাত্র ‘জাতি’-র দোহাই দিয়েই যাঁকে দল থেকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গ উঠেছিল একটা সময়।

সেই সফরে ‘অল ইন্ডিয়া’ ২৩টি ম্যাচ খেলে, যার মধ্যে ১৪টি প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পায়। ‘অল ইন্ডিয়া’ জেতে মাত্র দুটিতে, লেস্টারশায়ার ও সমারসেটের বিরুদ্ধে, হারে ১০টি, দুটি ম্যাচ ড্র হয়। ১৯১১ সালের নিরিখে একটি ভারতীয় দলের পক্ষে ক্রিকেটের জন্মভূমিতে গিয়ে দুটি জয় ছিনিয়ে আনাও কম কথা ছিল না। পালওয়ঙ্কর বালু এই দুটি জয়েই বড় ভূমিকা পালন করেন। লেস্টারশায়ারের বিরুদ্ধে ম্যাচে মাত্র ১৮৫ রানের বিনিময়ে ১১টি উইকেট নেন। সমারসেটের বিরুদ্ধে প্রথম ইনিংসে ৪/৪৮ নেওয়ার পর চতুর্থ ইনিংসে যখন ২৬৫ রান তাড়া করে ১ উইকেটে রুদ্ধশ্বাস জয় ছিনিয়ে নেয় ‘অল ইন্ডিয়া’, তখন বালু ৫৫ রানের একটি অমূল্য ইনিংস খেলে জয়ের প্রধান কারিগর পালওয়ঙ্কর শিবরামকে যোগ্য সঙ্গত দিয়ে যান। ১১৩ রানের একটি ঝকঝকে ইনিংস খেলেন বালুর ভাই। গোটা সফরে শুধু প্রথম শ্রেণির ম্যাচগুলিতেই বালু ৭৫টি উইকেট পান। বোলিং গড় ২০.১২। সব মিলিয়ে বালু পান ১১৪টি উইকেট, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে ৮/১০৩ ছিল তাঁর সেরা পারফরম্যান্স। বিভিন্ন কাউন্টি থেকে বালুকে তাঁদের হয়ে খেলার প্রস্তাব দেওয়া হয়, তবে বালু রাজি হননি। বিলেতের মাটিতে এমন পারফরম্যান্স পালওয়ঙ্কর বালুকে দেশের অচ্ছ্যুৎ শ্রেণির মানুষের চোখে এক লোকগাথার নায়কের রূপ দেয়। বালুর কীর্তিকলাপ ভীমরাও রামজি আম্বেদকর নামে জনৈক দলিত তরুণকেও উদ্বুদ্ধ করেছিল।

বৈষম্যের আঁচ বালুর গায়ে লেগেছিল একেবারে শুরুর দিনগুলো থেকেই। চর্মকার পরিবারে বেড়ে ওঠা। ফলে কাজ জুটলেও তা হল মজদুরি। পুনের ক্রিকেট ক্লাবে ঘাস ছাঁটাই, পিচ রোলিং, প্র্যাকটিসের নেট টাঙানো এসবই ছিল তাঁর কাজ। মাইনে মাসে মাত্র ৪ টাকা। তবে অচ্ছুৎ হওয়ায় দূরত্ব বজায় রাখতে হবে ক্রিকেটারদের থেকে। শর্ত ছিল এই একটাই। দোর্দণ্ডপ্রতাপ বলতে যা বোঝায়, সেই সময়ে ভারতের ব্রিটিশ ক্রিকেটার জন গ্লেনি গ্রেগ এক কথায় তেমনই। প্র্যাকটিস শেষেও আরও কিছুটা ঝালিয়ে নিতে চাইতেন গ্রেগ। কিন্তু বোলার কই? মাঠ পরিচর্যার বছর পনেরোর দলিত ছেলেটিকেই ডেকে নিলেন তিনি। হাতে তুলে দিলেন ক্রিকেট বল। কয়েকদিন এভাবেই চলল তাঁর বাড়তি প্র্যাকটিস। আর তারপরেই গ্রেগ টের পেলেন এক অদ্ভুত ক্ষমতার অধিকারী এই কিশোর। তা হল স্পিন। বেশ কয়েকবার অপ্রত্যাশিত ভাবেই আউট হলেন গ্রেগ। নিজেকে তৈরি করার থেকেও সেই ছেলেটিকে খেলার উপযুক্ত করে তুলতে একটা আলাদা খিদে টের পেলেন গ্রেগ। প্রতিবার তাঁকে আউট করতে পারলেই ৫০ পয়সা করে বকশিশ পাবে কিশোর। এমনই শর্ত রাখলেন তিনি। শুরু হল নিজেকে নিঙড়ে দেওয়া। শুরু হল অসম লড়াই। বছর দুয়েকের মধ্যেই পুনের দলে বোলার হিসাবেই লেখা হল পালওয়ঙ্কর বালুর নাম। ভারতের প্রথম দলিত ক্রিকেটার। তবে পদে পদে অপমান বালুর নিত্য সঙ্গী। দলের বাকি ক্রিকেটারদের সঙ্গে রেস্টরুমে যাওয়ার অনুমতি তো দূরের কথা, ম্যাচ চলাকালীনও বালুকে খাবার খেতে হত মাটির থালায়। মাঠের ধারে চড়া রোদের মধ্যে বসেই। যেখানে বাকিদের খাবার আসত পোর্সেলিন কিংবা আভিজাত্যে মোড়া কাঁসার-পিতলের থালায়।

 ১৮৯৬ সালে বালুকে দলে টানল জিমখানা ক্রিকেট দল। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ‘হিন্দু’দের নিয়ে গড়া দল মাঠে নামল। মাঠে নামলেন পালওয়ঙ্কর বালুও। সেই সময় ক্রিকেট বলতে টেস্ট ক্রিকেটই। প্রথম ইনিংসে হিন্দুদের রান ছিল ২৪২। ব্রিটিশরা করল ১৯১ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্রিটিশ লক্ষ্য ছিল ২১২ রানের। তবে পালওয়ঙ্কর বালুর কাছেই থামলেন তাঁরা। মাত্র ১০২ রানে। একা ৫টি উইকেট নিলেন বালু। তৈরি হল এক নতুন ইতিহাস।

ভারতের অন্যতম এই ক্রিকেটার আজ স্মৃতির অতলেই। শুধুই কি ক্রিকেট? ১৯৩০ সালে বৈষম্যের বিরুদ্ধে গান্ধীজি যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তার বহু বহু বছর আগে থেকে সেই লড়াইটাই তো লড়ে এসেছিলেন পালওয়ঙ্কর বালু। শিখিয়েছিলেন, অধিকার ছিনিয়ে নিতে হয়। নিজেকে ‘ভারতীয়’ হিসাবে পরিচয় দিতে লজ্জা পাওয়া প্রিন্স রঞ্জির নামে প্রথম সারির ক্রিকেট টুর্নামেন্ট থাকলেও, ক্রিকেটের ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে গেছে বালুর নাম। দলিত হওয়ার অপমান ছিল তাঁর ক্রিকেটজীবনের নিত্যসঙ্গী। বালুর সমস্ত প্রতিবাদ ছিল ক্রিকেটের ভাষায়। যত মানসিক ভাবে রক্তাক্ত হতেন, ততই সেরাটুকু খেলায় উজাড় করে দিতেন। আজ আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট। টিম ইন্ডিয়ার জন্য কোটি কোটি ভারতবাসীর আবেগ আর সমর্থন সে কথাই প্রমাণ করে। ক্রিকেটার মানেই আজকের দুনিয়ায় গ্ল্যামার আর ঐশ্বর্যের উজ্জ্বল সমন্বয়, অথচ এই ক্রিকেট খেলার সঙ্গে এমন কিছু খেলোয়াড় যুক্ত ছিলেন বা এখনও রয়েছেন, যাঁদের নিজেদের প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতে অনেক লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য করতে হয়েছিল। এই রকমই এক জন দলিত ক্রিকেটার ছিলেন পালওয়ানকর বালু।

বালু-র জন্ম ১৮৭৬ সালে কর্ণাটকের ধারওয়ারে। তাঁর বাবা ছিলেন পরাধীন দেশে সেনাবাহিনীর চাকুরে। তিনি কর্মসূত্রে সপরিবার পুনেয় চলে আসেন। ছোটবেলা থেকেই বালু এবং ওঁর ভাইয়েরা ক্রিকেট খেলতে খুব ভালবাসতেন, কিন্তু নিজেদের ক্রিকেট খেলার সামগ্রী বলতে তেমন কিছু ছিল না। ব্রিটিশদের ফেলে দেওয়া ব্যাট-বল দিয়ে বালুরা খেলতেন। ১৮৯২ সালে বালু পুনেয় ইংরেজদের ক্লাবে মালি হিসেবে নিযুক্ত হন। তখন বালুর বয়স মোটে ১৬। সেই সময়েই জংলী জর্জকে তাঁর স্পিনের ভেলকিতে বোকা বানাতেন বালু। ব্রিটিশ ক্রিকেটাররা অবাক হতেন, গ্রেগ যেখানে অন্য নামীদামি বোলারদের বেধড়ক পিটিয়ে বলের সেলাই খুলে ফেলতেন, সেখানে এক জন প্রশিক্ষণহীন মালির বলে কী করে বার বার আউট হন? শেষ পর্যন্ত ইংরেজ তথা ইউরোপিয়ানরা স্পিন বোলার হিসেবে বালুর আশ্চর্য দক্ষতা মেনে নিতে বাধ্য হলেন। হিন্দুরা তখন ইউরোপীয়দের ক্রিকেটের ময়দানে হারাতে মরিয়া। আর বালুর মতো প্রতিভাধর স্পিনার দলে থাকলে ইউরোপীয়দের হারানোর সম্ভাবনা বাড়বে! কিন্তু হলে হবে কী, বর্ণহিন্দু খেলোয়াড়রা বালুর সঙ্গে এক দলে খেলতেই রাজি নন। বালু তো চামার সম্প্রদায়ের দলিত, অর্থাৎ অস্পৃশ্য, এর সঙ্গে খেললে ব্রাহ্মণ বা অন্য বর্ণহিন্দুদের জাত থাকবে কী করে! নাকউঁচু সমাজ যত মুখ ঘুরিয়ে নেয়, বালু তত উইকেট পুঁতে দিনের পর দিন নিবিড় অনুশীলনে ডুবে যান। নিজের অস্ত্রে শান দিতে দিতে বালু ক্রমশ হয়ে উঠলেন আরও রহস্যময় বোলার। ওঁর বল অনেক ভাল ব্যাটসম্যানই আর ঠিকমতো ধরতে পারেন না। আজকের ক্রিকেট-বিশ্বে অনেকেই তন্নতন্ন করে ভাল ‘মিস্ট্রি স্পিনার’ খোঁজেন, তাঁদের ক’জনই বা জানেন যে, আজ থেকে এগারো দশক আগেই বালুর স্পিন বোলিংয়ে এক অভেদ্য রহস্য লুকিয়ে ছিল! শেষ পর্যন্ত উনি ১৮৯৬ সালে হিন্দুদের দলে পরমানন্দদাস জীবনদাস হিন্দু জিমখানায় খেলার সুযোগ পেলেন। তৎকালীন বম্বেতে ইউরোপিয়ান, পার্সি, হিন্দু এবং মুসলিমদের মোট চারটি দল নিয়ে দেশের সেরা ক্রিকেট প্রতিযোগিতা ‘বম্বে কোয়াড্রাঙ্গুলার’ অনুষ্ঠিত হত। বালুর বলে ইউরোপিয়ান, পার্সি এবং মুসলিমরা বারবার আউট হতে লাগলেন। কঠিন চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসতেন এবং হাল না ছাড়া ছিল ওঁর চরিত্রের বৈশিষ্ট্য। বিপক্ষের ব্যাটসম্যানদের আউট করার ওঁর প্রবল খিদে কোনও অধিনায়কই উপেক্ষা করতে পারতেন না। তাই বল করে উনি নিয়মিত উইকেট তুলতেন। ওঁর দল হিন্দু জিমখানাও ধারাবাহিকভাবে ম্যাচ জিততে লাগল। দলের জয়ের অন্যতম কারিগর হয়ে উঠলেও খেলার মাঠে এবং মাঠের বাইরে অস্পৃশ্যতার যন্ত্রণা বালুকে প্রতিমুহূর্তে কষ্ট দিত। হিন্দু খেলোয়াড়রা অনেক সময় ওঁর দিকে বল পাঠাতে হলে লাথি মেরে এগিয়ে দিতেন। ওই সময়ে অস্পৃশ্যতার বিষ আজকের করোনা ভাইরাসের চেয়েও মারাত্মক। তবুও বালু ছিলেন নিজের লক্ষ্যে অটল। প্র্যাকটিসেজ নিজেকে সব সময় ব্যস্ত রাখতেন আর খেলায় সেরাটা দিতেন। ব্যাটসম্যানদের বোকা বানাতে বালুর ছিল জুড়ি মেলা ভার। সেই সময়ের অন্যতম সেরা ক্রিকেট দল ছিল নাটোরের মহারাজার দল। বালু ওই দলে ১৯০১ সালে জায়গা পেয়ে দুর্দান্ত বল করেছিলেন। নাটোরের মহারাজা এবং বালু এক দলে খেলছেন, এটা ওই সময়ের জাতপাতের জটিল হিসেবকে তীব্র ভাবে আঘাত করেছিল। আবার ১৯১১ সালে পাটিয়ালা মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতায় যে ভারতীয় ক্রিকেট দল প্রথম বারের জন্য ইংল্যান্ড সফরে গিয়েছিল, সেই সফরে অভিজ্ঞতার অভাবে ভারতীয় দল ব্যর্থ হলেও বালু উজ্জ্বল ধ্রুবতারার মতো সেরা পারফর্মার ছিলেন। নিজের দক্ষতা এবং যোগ্যতা প্রশ্নাতীতভাবে প্রমাণ করা সত্ত্বেও ওঁকে হিন্দু দলের অধিনায়কত্বের দায়িত্ব দেওয়া হত না, অথচ ওঁর অভিজ্ঞতার ভাঁড়ার পূর্ণ ছিল। এমনকি একবার পুরোপুরি অন্যায়ভাবে ওঁকে দল থেকে বাদও দেওয়া হয়। এই অন্যায়ের প্রতিবাদে বালুর দুই ভাই বিঠল এবং শিবরাম দল থেকে সরে দাঁড়ান। শেষ পর্যন্ত বালুকে দলের সহ-অধিনায়ক নির্বাচিত করা হয়। তবে ক্রিকেটের ময়দানে বালুর এই লড়াই ব্যর্থ হয়নি। বিংশ শতাব্দীর কুড়ির দশকের গোড়ার দিকেই হিন্দুরা বালুর ভাই বিঠলকে অধিনায়ক হিসেবে বেছে নেন। বালুর অনবদ্য পারফরম্যান্স এবং বিঠলের অসামান্য দক্ষতা হিন্দু কর্তৃপক্ষকে এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য করেছিল। এই সিদ্ধান্ত এই কারণেই ঐতিহাসিক যে, একজন দলিতের অধীনে বর্ণহিন্দু ও ব্রাহ্মণ ক্রিকেটাররা খেলছেন এবং একসঙ্গে মিলেমিশে জয়োৎসব পালন করছেন। জাতপাতে দীর্ণ তৎকালীন ভারতে এই দৃশ্য আদৌ সুলভ ছিল না।

আরও পড়ুন: আবারও কুলদীপ ম্যাজিক! এশিয়া কাপের ফাইনালে ভারত 

১৯১২ সালে শুরু হয় ইউরোপীয়ান, হিন্দু, পার্সী, ও মহামেডান দলগুলির মধ্যে বোম্বের বিখ্যাত কোয়াড্র্যাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট (অর্থাৎ চতুর্মুখী প্রতিযোগিতা)। বালু ও তাঁর তিন ভাই (শিবরাম, বিটঠল, ও গণপত) হিন্দু দলের স্তম্ভ হয়ে ওঠেন। দলের অন্যতম অভিজ্ঞ ও সেরা খেলোয়াড় হিসাবে এই সময় বারবার বালুর নাম প্রস্তাবিত হতে থাকে অধিনায়ক পদের জন্য। কিন্তু অদৃষ্টের লিখনে বালু যে অচ্ছ্যুৎ, নীচু জাত। উচ্চবর্গীয় হিন্দুদের সাথে একসঙ্গে খেলার অধিকার দেওয়া হয়েছে নিম্নবর্গীয় বালুকে, তাই কি যথেষ্ট নয়? বামন হয়ে চাঁদে হাত দিতে চান বালু? সমাজের মাথা যে ব্রাহ্মণরা, সেই ব্রাহ্মণ খেলোয়াড়দের নেতৃত্ব দেবেন ‘চামার’ বালু? তাই কখনো হয়? হিন্দু জিমখানার কর্তারা তাই বিলেতজয়ী বালুর বদলে অধিনায়কত্বের দায়ভার তুলে দেন ব্রাহ্মণসন্তান মুকুন্দরাও পাইয়ের হাতে। ১৯২০ সালে বালুর ভাই গণপত মারা যান। সে বছর অধিনায়ক পাইয়ের অসুস্থতার কারণে সহ-অধিনায়ক বালুর বদলে আরেক ব্রাহ্মণসন্তান দিনকর বলবন্ত দেওধরকে (যাঁর নামে আজকের দেওধর ট্রফি) অধিনায়ক ঘোষণা করে হিন্দু জিমখানা। এবং দেওধর অধিনায়কত্ব পেয়েই মহামেডানের বিরুদ্ধে প্রথম ম্যাচের দল থেকে সরিয়ে দেন বিগত আট বছর ধরে দাপটের সাথে কোয়াড্র্যাঙ্গুলার টুর্নামেন্ট খেলা বালুকে; দোহাই দেওয়া হয় তাঁর বয়সের। এর প্রতিবাদে দল থেকে সরে দাঁড়ান বালুর অন্য দুই ভাই, শিবরাম ও বিটঠল। তিন প্রধান তারকার না খেলা মেনে নিতে পারেননা হিন্দু জিমখানার সাধারণ সভ্য ও সমর্থকরা। তাঁদের সম্মিলিত প্রতিবাদের চাপে পার্সীদের সাথে ম্যাচের আগে দেওধরসাহেব অপসারিত হন, ও অধিনায়ক পদে ফিরে আসেন মুকুন্দরাও পাই। পাই দলে ফিরিয়ে আনেন তিন পালওয়ানকার ভাইকেই। ১৯২০’র ৬-৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হিন্দু বনাম পার্সী ম্যাচটিই হয় পালওয়ানকার বালুর প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে শেষ ম্যাচ। শেষ ম্যাচে কোনো উইকেট নিতে পারেননি বালু, কিন্তু বহুকালের সাথী পাইয়ের বদান্যতায় শেষ ম্যাচে তিনি শেষ পর্যন্ত বামন হয়েও চাঁদে হাত দিতে পেরেছিলেন। শেষ দিনের খেলায় মুকুন্দরাও পাই স্বেচ্ছায় দলের দায়ভার সহ-অধিনায়ক বালুর হাতে তুলে দিয়ে বিশ্রাম নেন, যার ফলে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেট জীবনের শেষ দিনে ‘চামার’ পালওয়ানকার বালু সুযোগ পান তাঁর উচ্চবর্গীয় হিন্দু সহখেলোয়াড়দের নেতৃত্ব দেওয়ার।

তাঁর অবসরের তিন বছর পর, ১৯২৩ সালে, গান্ধীজির বর্ণাশ্রমপ্রথা-বিরোধী আন্দোলনের স্রোতে হিন্দু জিমখানা এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নেয়। কোয়াড্র্যাঙ্গুলার টুর্নামেন্টের জন্য বালুর ভাই পালওয়ানকার বিটঠলকে হিন্দু দলের অধিনায়ক মনোনীত করেন। এর কয়েকমাস পরেই শুরু হয় বর্ণাশ্রম প্রথার বিরুদ্ধে সত্যাগ্রহ আন্দোলন। সেই পরিপ্রেক্ষিতে বিটঠলের মনোনয়ন শুধু ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাসে নয়, ভারতের আর্থ-সামাজিক ইতিহাসেও এক বিরাট পদক্ষেপ ছিল। বালুও এইসময় থেকেই ধীরে ধীরে সক্রিয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন ও অচিরেই ভারতের দলিত রাজনীতির এক মুখ্য নাম হয়ে ওঠেন।

RELATED ARTICLES

Most Popular

Video thumbnail
Good Morning Kolkata | সকালের গুরুত্বপূর্ণ খবর, দেখুন একনজরে সরাসরি
00:00
Video thumbnail
Sheikh Hasina | ফের সরাসরি বক্তব্য রাখছেন হাসিনা, কী বলছেন শুনুন
00:00
Video thumbnail
Rekha Patra | শুভেন্দুর সভায় অনুপস্থিত থেকে, তৃণমূলে পা বাড়ানোর সন্দেশ দিলেন সন্দেশখালির রেখা?
00:00
Video thumbnail
Rekha Patra | সন্দেশখালির 'শক্তিস্বরূপা' রেখা, শুভেন্দুর সভায় মিলল না দেখা কেন? কী হতে চলেছে?
00:00
Video thumbnail
Weather Update | ৩ দিন পর লন্ডভন্ড হবে কোন কোন জেলা? জেনে নিন আগেভাগেই
00:00
Video thumbnail
Dilip Ghosh | Suvendu Adhikari | দিলীপের প্রত্যাবর্তন, চাপে শুভেন্দু?
00:00
Video thumbnail
Rekha Patra | সন্দেশখালির শুভেন্দুর সভায় মঞ্চে নেই রেখা পাত্র, হঠাৎ কী হল? ফুলবদল কী সময়ের অপেক্ষা?
00:00
Video thumbnail
Bangladeshi Fake Voter | বাংলাদেশি বাসিন্দা, কাকদ্বীপের ভোট, নিউটন বিতর্কে নয়া মোড়
04:10
Video thumbnail
Eco ইন্ডিয়া | চেন্নাইয়ের উপকূল অঞ্চলের ভূপ্রকৃতি কীভাবে রক্ষা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা?
06:42
Video thumbnail
আমার শহর (Amar Sahar) | আম উৎসবে জমজমাট শিলিগুড়ি, উপস্থিত দেশ ও বিদেশের ৭১ জন চাষি
02:15