এক সংখ্যালঘু প্যাটিসওলাকে ঘিরে ধরে মারল হনুমান ব্রিগেডের কিছু উন্মাদ। পুলিশ তাদের ধরল, গণ ধোলাইয়ের অভিযোগ, আধ ঘন্টায় তাঁরা বেল পেয়ে গেল। দেখে শুনে আদিত্যনাথ যোগীর বুলডোজারেই ভরসা রাখবেন অনেকে। কিন্তু এমনটা আগেও হয়েছে, বাংলার বেশ কিছু জায়গাতে দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টায়, ফেক ছবি সার্কুলেট করার অভিযোগে বেশ কিছু মানুষ গ্রেফতার হয়েছেন। আর যেহেতু এ রাজ্যে এখনও এনকাউন্টার বা বুলডোজার সংস্কৃতি চালু নেই, তাঁরা কয়েকদিনের মধ্যে, কয়েক ঘন্টার মধ্যে ছাড়া পেয়ে ‘ঝায় শ্রী রাম’ বলতে বলতে বাড়ি ফিরে গিয়েছেন। কিন্তু এবারে তো সামনে ভোট, তাই নতুনত্ব হল, তাঁদের ডেকে সম্বর্ধনা দেওয়া হল। না, এ জিনিস আগে দেখা যায়নি! গণপিটুনিতে অভিযুক্ত কয়েকজনকে সম্বর্ধনা দিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। একেই বলে ভাবাবেগের রাজনীতি। খেয়াল করে দেখুন, যখন ভারতের যত্রতত্র যখন মব লিঞ্চিং চলছে, গোরক্ষা বাহিনীর তাণ্ডব চলছে, তখনও কিন্তু এই বাংলাতে তেমন ঘটনা ছিল না। ২০২১-এর সময় থেকেই, এই শান্তিকুঞ্জের মূর্তিমান অশান্তি আসরে নামার পর থেকেই এক তীব্র ঘৃণা ছড়িয়ে পড়ল। ‘মমতা বেগম’ বলা দিয়ে যে বৃত্ত আঁকার চেষ্টা হয়েছিল, আজ তা পূর্ণ, আজ মব লিঞ্চারদের বীরের সম্বর্ধনা দেওয়া হচ্ছে। এবার আশা করাই যায়, যুবভারতীতে যারা ভাঙচুর করল, যারা ফুলের টব নিয়ে বাড়ি চলে গেল, যারা কার্পেট পিঠে নিয়ে রওনা দিল, তারাও তো এই রাজ্য সরকারের অপদার্থতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদীরা তো হনুমান বাহিনীর সম্ভাব্য ইনপুট। কাজেই এনাদেরও ফুল মালা দিয়ে সম্বর্ধনা দেবেন। আসলে বাংলা জুড়ে যাবতীয় অরাজকতাকে অক্সিজেন দিতে চান, কারণ সেখান থেকেই সমর্থন আশা করেন শুভেন্দু। আজ আবার যুবভারতী ভাঙচুরের পরে শুভেন্দু অধিকারী ঠিক সেটাই করছেন, আর সেটাই বিষয় আজকে, ‘মেসি’-র ঘোলাজলে মাছ ধরতে নেমেছেন শুভেন্দু?
যুবভারতীতে ভাঙচুর এই প্রথম নয়, সুভাষ চক্রবর্তীর চোখের সামনে তুলকালাম হয়েছে যুবভারতী স্টেডিয়ামে, ওনার আক্ষেপ এখনও মনে আছে। ১৬ অগাস্ট ইডেনে ঘটনা ঘটেছে, ১৬ জন মারা গিয়েছিলেন। ১৩ মার্চ ১৯৯৬, ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৯, ৯ ডিসেম্বর ২০১২-তে যুবভারতী গ্যালারি থেকে ছোঁড়া ইঁটে মোহনবাগানের রহিম নবির মাথা ফাটে। ধর্ম আর খেলা নিয়ে প্রায় উন্মাদ মানুষজনদের বিশৃঙ্খলা আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। কিছুদিন আগেই ২০২৪-এর জুলাই মাসে উত্তরপ্রদেশের হাথরসে এক স্বঘোষিত বাবাজির আশ্রমে ১২৩ জন মারা গিয়েছিলেন, বাবাজির কিছুই হয়নি, জামিনে বাইরে আছেন, সরকারের বদান্যতায়। এনকোয়ারি কমিটির রিপোর্টে উৎসাহী ভক্তদেরই দোষ দেওয়া হয়েছে। মাত্র কিছুদিন আগে সেপ্টেম্বর মাসে অভিনেতা বিজয়ের সভাতে পদপিষ্ঠ হয়ে মারা গিয়েছেন ৩৬ জন মানুষ। যুবভারতীর এই ‘মেসি মেস’-এ অন্তত এটাই বাঁচোয়া যে, একজন আহতও হননি, ঝড় বয়ে গিয়েছে স্টেডিয়ামের উপর দিয়ে। শুভেন্দু অধিকারী মমতার পদত্যাগ চেয়েছেন। এটা ঘটনা যে, সেলফি তুলতে ব্যস্ত ছিলেন মন্ত্রী-সান্ত্রী, ভিআইপি আর নেপো কিডেরা, এটা ঘটনা যে, আর একটু রিহার্সাল থাকলে এই ঘটনাকে অ্যাভয়েড করা যেত, এটা ঘটনা যে, এই ধরণের সমাবেশে পুলিশের আরও অনেক প্রস্তুতি নেওয়াটা দরকার ছিল। কিন্তু এটাও ঘটনা, হুজুগে পাবলিকের মন মর্জির তল পাওয়া ভারি মুশকিল। লোকজন, ক্রীড়াপ্রেমী বলছেন, আমি কেন হুজুগে বলছি? বলছি কারণ তাঁরা খেলা দেখতে তো আসেননি, তাঁরা এসেছিলেন এক তারকাকে দেখতে। স্বচক্ষ মেসিকে দেখতে কেউ ১০, কেউ ২০ হাজার টাকার টিকিট কিনেছিলেন। এবারে স্বাভাবিকভাবেই সেই মেসিকে না দেখে যদি অভিনেতা, সাংবাদিক, বাউন্সার আর মন্ত্রী-সান্ত্রীদের দেখতে হয়, তাহলে হতাশা স্বাভাবিক। আর এই ভাঙচুর লুটপাট তো ক্রীড়াপ্রেমীদের নয়, হুজুগে পাবলিকের, কাজেই তার তল খুঁজে পাওয়া অসম্ভব।
আরও পড়ুন: Aajke | শুভেন্দু ক্ষমতায় এলে দুর্গাপুজোয় বিরিয়ানি বাদ?
এই একই ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির আয়োজনে, হায়দরাবাদে ইভেন্ট হয়েছে, মুম্বাইতে হল, আজ দিল্লিতে। যে কোনও জায়গাতেই এই গন্ডগোল হতে পারত? না, কলকাতায় ফুটবলের হুজুগের সঙ্গে ওই শহরগুলোর তুলনা করাটা বোকামি। এখানে ফুটবল নিয়ে আবেগ আছে, মেসি সেই আবেগের এক চরম শিখরে। কাজেই এখানে আয়োজক আর প্রশাসনের অব্যবস্থা সেই আবেগের সঙ্গে জুড়ে এক অরাজক অবস্থা তৈরি করেছে, এটা ঘটনা। কিন্তু তাই বলে মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ? বাড়াবাড়ি, বড্ড বাড়াবাড়ি। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে, মেসিকে না দেখতে পেয়ে মেসিকে দেখতে যাওয়া লোকজন হতাশায় ভাঙচুর করেছে যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, এক বেসরকারি উদ্যোগের এই ভয়ঙ্কর ব্যর্থতার জন্য রাজ্যের বিরোধী দলনেতা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদত্যাগ দাবি করেছেন, আপনারা কি সহমত?
আসলে নির্বাচনের আগে যে কোনও সামান্য ব্যর্থতাও বিরোধীরা ইস্যু করেন, এই যুবভারতী ভাঙচুর খামোখা ব্যতিক্রম কেন হবে? আর এটা তো ঘটনাই যে, খানিক পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে এই ঘটনা এড়ানো যেত, কাজেই সেই ব্যর্থতা তো সরকারের, বিভাগীয় মন্ত্রীর আছেই। কিন্তু সেসবের পরেও সারা দেশে এমন অসংখ্য ব্যর্থতাকে হেঁসে উড়িয়ে দেবার অজস্র উদাহরণও আছে। সেই কবে লাল বাহাদুর শাস্ত্রী রেল দুর্ঘটনার পরে পদত্যাগ করেছিলেন, সেই একই নৈতিক মান আজকের রাজনীতি, সমাজনীতিতে অচল। কাজেই হুজুগের এই স্রোত, ঢেউ ইতিমধ্যেই স্তিমিত। মেসি দেশে ফিরে যাওয়ার পরে তা আরও স্তিমিত হবে, কেবল থেকে যাবে এক লজ্জা। হুজুগে পাবলিক কী পেল, কী পেল না-র চেয়েও সেটা বড়। এক ফুটবল তারকাকে ফুটবল স্টেডিয়াম থেকে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট আগেই দৌড়ে পালিয়ে যেতে হয়েছিল, এই লজ্জার ইতিহাস কিন্তু থেকেই গেল।
দেখুন ভিডিও:








