১৯৮৩ প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপ। বলা ভালো কপিল ডেভিলসের বিশ্বকাপ। সবাইকে অবাক করে বিশ্বকাপ ফাইনালে দু’বারের চ্যাম্পিয়ন ক্লাইভ লয়েডের ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পরাজিত করেন কপিল-মোহিন্দর-মদন লালরা। এরইসঙ্গে ২৫ শে জুন বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন শক্তি হিসেবে নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেয় ভারত। দ্রুত গতিতে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তাও ভারতবর্ষে আকাশছোঁয়া হতে থাকে। এই বিশ্বকাপ জয়ের পর থেকেই খুদে ক্রিকেটারেরা স্বপ্ন দেখতে থাকেন ভবিষ্যতের কপিল-অমরনাথ-গাভাসকর হওয়ার। ১৯৮৩-র ২৫ শে জুন না আসলে হয়ত পরবর্তীয় ক্রিকেটীয় প্রজন্মে শচীন-সৌরভ-রাহুল-ধোনির জন্মও হত না।
৮৩ বিশ্বকাপে ভারতের প্রথম জয়
১৯৮৩-র ৯ জুন। ম্যাঞ্চেস্টারে প্রথম ম্যাচে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুখোমুখি হয় ভারত। টসে জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্ধান্ত নেয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। নির্ধারিত ৬০ ওভারে ৮ উইকেটের বিনিময়ে ২৬২ রান তোলে ভারত। ৮৯ রানের অনবদ্য ইনিংস খেলেন যশপাল শর্মা। এছাড়া সন্দীপ পাটিল করেন ৩৬ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ২২৮ রানে অল আউট হয়ে যায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। রজার বিনি এবং রবি শাস্ত্রী নেন ৩টি করে উইকেট। বলা ভালো এই ম্যাচই ভারতের বিশ্বজয়ের আগাম পূর্বাভাস দিয়েছিল। শোনা যায় ভারতের অনুশীলনে এসে স্যর গ্যারি সোবার্স ভারতীয় দলকে বিশ্বকাপের ‘ডার্ক হর্স’ বলে গিয়েছিলেন।
কপিলের চিরস্মরণীয় ১৭৫
বিশ্বকাপে ভারতের পঞ্চম ম্যাচ। প্রতিপক্ষ যেখানে জিম্বাবোয়ে। ম্যাচের প্রথম ঘন্টা অতি বড় ভারতীয় দলের অনুরাগীও নিজের দলের হয়ে বাজি ধরবেন না। একসময়ে ভারতের স্কোর ১৭/৫। একে একে প্যাভিলিয়নে ফিরে যান গাভাসকর(০), শ্রীকান্ত(০), অমরনাথ(৫), সন্দীপ পাটিল(১) এবং যশপাল শর্মা(৯)। ভারতের কাছে আবার ছিল ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচ। এরকম পরিস্থিতেই জন্ম হয় মহাতারকার। টনব্রিজ ওয়েলসের প্রতিটি ঘাস যার সাক্ষী থাকে। জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে প্রথমে ধরে খেলার চেষ্টা করেন কপিল দেব। এরপর সেট হয়ে যাওয়ার পর গিয়ার শিফট করেন হরিয়ানা হ্যারিক্যান। লফটেড কভার ড্রাইভ, স্কোয়ার কাট, নটরাজ ভঙ্গিতে শট খেলে বল পাঠান সীমানার ওপারে। যখন ইনিংস শেষ করেন তখন কপিলের নামের পাশে ‘১৭৫ নট আউট’ জ্বলজ্বল করছে। ১৬টি চার এবং ৬টি ছয়ে সাজানো তাঁর ইনিংস। অপর প্রান্তে সঙ্গী হিসেবে অবশ্যই পান সৈয়দ কিরমানি, রজার বিনি এবং মদন লালদের। বিশেষ করে নবম উইকেটে কপিল-কিরমানির ১২৬ রানের পার্টনারশিপ। ম্যাচের ফলাফল জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে ৩১ রানে জয়ী ভারত। উল্লেখ্য, কপিলের ১৭৫ দেখা হয়নি দলের সঙ্গে থাকা দিলীপ বেঙ্গসরকারের। তিনি সেই সাতটি স্টিচ নিয়ে লন্ডন হাসপাতালে ভর্তি। হাসপাতালে থেকেই রেডিও কমেন্ট্রি শোনেন। দুর্ভাগ্যের বিষয় এটাই যে এই ম্যাচটি টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়নি। কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল যে বিবিসি ধর্মঘট ডেকেছিল সেদিন। কিন্তু আসল কারণ সেই একইদিনে ছিল লর্ডসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে দ্বৈরথ। এছাড়া ম্যাঞ্চেস্টারের ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে ছিল ইংল্যান্ড বনাম পাকিস্তান।
বিশ্বকাপ সেমিফাইনাল– ভারত বনাম ইংল্যান্ড
টসে জিতে প্রথমে ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নেয় ইংল্যান্ড। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২১৩ রানে অল আউট হয়ে যায় ইংল্যান্ড। কপিল দেব নেন ৩টি উইকেট। এছাড়া রজার বিনি এবং মোহিন্দর অমরনাথ নেন ২টি করে উইকেট। ইয়ান বোথামকে যে ডেলিভারিতে ক্লিন বোল্ড করেন কীর্তি আজাদ তা আজও রহস্যের। কীর্তি আজাদ পরবর্তীতে স্বীকার করেন বলটা যে এত নীচু হবে তিনি নিজেও বুঝতে পারেননি। জবাবে ব্যাট করতে নেমে ৫০ রানে ২ উইকেট পড়ে যায় ভারতের। এরপর যশপাল শর্মা এবং মোহিন্দর অমরনাথের মধ্যে ৯২ রানের পার্টনারশিপ হয়। বব উইলিসকে দৃষ্টিনন্দন ছয় মারেন যশপাল শর্মা। একইসঙ্গে মাদ্রাজে করা বব উইলিসের স্লেজিং-এর বদলা ম্যাঞ্চেস্টারে নেন যশপাল শর্মা। অন সাইডে টিপিক্যাল যশপাল স্ম্যাশে বল সীমানার বাইরে পাঠান। যশপাল শর্মা ৬১ এবং মোহিন্দর অমরনাথ করেন ৪৬ রান। এরপরের কাজটি করেন সন্দীপ পাটিল। অধুনা টি-টোয়েন্টি স্টাইলে ৩২ বলে ৫১ রানের ঝোড়ো ইনিংস খেলেন। মারলেন ৮টি বাউন্ডারি। স্ট্রাইক রেট ১৫৯.৩৭। ৬ উইকেটে জিতে লর্ডসে ফাইনালের টিকিট পাকা করে ফেলে ভারত। অনবদ্য অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জন্য ম্যাচের সেরা হন মোহিন্দর অমরনাথ।
বিশ্বকাপ ফাইনাল
২৫ জুন। ভারতীয় ক্রিকেট ইতিহাসের ‘রেড লেটার ডে’। কেউ কল্পনাও করেনি দু’বারের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হবে ভারত। কপিলস ডেভিলস সেই অসাধ্যই সাধন করেছিল। প্রথমে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ১৮৩ রানে ভারতের ইনিংস শেষ হয়ে যায়। সর্বোচ্চ রান করেন শ্রীকান্থ(৩৮)। এছাড়া সন্দীপ পাটিল ২৭ এবং মোহিন্দর অমরনাথ করেন ২৬ রান। উইন্ডিজ বোলারদের মধ্যে অ্যান্ডি রবার্টস নেন ৩টি উইকেট। জবাবে ব্যাট করতে নেমে শুরুটা একেবারেই ভালো হয়নি। শুরুতেই বলবিন্দর সিং সাঁধু এক অসাধারণ ইনসুইঙ্গারে ক্লিন বোল্ড করেন গর্ডন গ্রিনিজকে। এরপর ভিভ রিচার্ডস নিজস্ব মেজাজে খেলতে শুরু করেন। কিন্তু তা অবশ্য দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাঁকে ফিরিয়ে দেন মদন লাল। অনেকটা দৌড়ে অসাধারণ ক্যাচ নেন অধিনায়ক কপিল দেব। এরপর একের পর এক উইকেট পড়া শুরু হয়। কিছুটা প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করেন জেফ দুজো এবং ম্যালকম মার্শাল। কিন্তু তা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল না। মাইকেল হোল্ডিংকে অমরনাথ আউট করাতেই হাজির হয়ে যায় সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ক্রিকেট দুনিয়ায় নতুন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয় ভারতে নাম। শুরু হয় এক নতুন যুগের। দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের জন্য ম্যাচের সেরা হন মোহিন্দর আমরনাথ।
সেরা ব্যাটিং
এই বিশ্বকাপে ভারতের হয়ে সবথেকে বেশি রান করেন কপিল দেব নিখাঞ্জ। সর্বমোট ৩০৩ রান করেন। গড় ৬০.৬০। সর্বোচ্চ ১৭৫। বিশ্বকাপে কপিলের পর যশপাল শর্মা করেন ২৪০ রান। গড় ৩৪.৩৪। সর্বোচ্চ ৮৯। সার্বিক দিক থেকে দেখতে হলে সর্বাধিকা রানের তালিকায় প্রথমস্থানে রয়েছেন ডেভিড গাওয়ার। রানসংখ্যা-৩৮৪। গড় ৭৬.৮০। সর্বোচ্চ ১৩০। দ্বিতীয় স্থানে ভিভ রিচার্ডস(৩৬৭)।
সেরা বোলিং
১৯৮৩ প্রুডেন্সিয়াল বিশ্বকাপে সবথেকে বেশি উইকেট নিয়েছেন ভারতের রজার বিনি। তাঁর উইকেট সংখ্যা ১৮। একটি উইকেট কম অর্থাৎ ১৭টি উইকেট নিয়ে ভারতীয় বোলারদের মধ্যে এরপরেই রয়েছেন মদন লাল। সমসংখ্যক উইকেট নিয়ে সার্বিক দিক থেকে বোলারদের ক্রমতালিকায় দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন শ্রীলঙ্কার আসান্থা দে মেল।