Saturday, July 5, 2025
HomeScrollFourth Pillar | মোদিজি রাষ্ট্রগঠন, বিকাশের অ আ ক খ জানেন না

Fourth Pillar | মোদিজি রাষ্ট্রগঠন, বিকাশের অ আ ক খ জানেন না

Follow Us :

ব্যক্তি মানুষের বিকাশ, ব্যক্তি মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন, সাধারণভাবে নির্ভর করে রাষ্ট্রের উপরে, দেশের উপরে, সমাজের উপরে। ব্যতিক্রম থাকে, কিন্তু সাধারণভাবে এটাই সত্যি। এক অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, এক স্বৈরাচারী শাসিত দেশে, এক অজ্ঞানতার অন্ধকারে পড়ে থাকা সমাজে ব্যক্তি মানুষের পূর্ণ বিকাশ, সার্বিক বিকাশ সম্ভব নয়। ঠিক সেরকমই এক রাষ্ট্রের বিকাশের জন্যও কিছু শর্ত আছে, সারা পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্রের ইতিহাস বলে, রাষ্ট্র বিকাশ, তার উন্নয়ন, অগ্রগতির জন্যও অন্তত তিনটে শর্ত আছে, তার প্রথমটা হল গণতন্ত্র। কী রকম গণতন্ত্র? গণতন্ত্র মানে কেবল ভোট নয়, ৫ বছর পরে ভোট এবং নির্বাচিত সরকার মানেই গণতন্ত্র নয়, রাষ্ট্রের প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের গণতন্ত্র, তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ গণতন্ত্রের কথা কার্ল মার্কস (Karl Marx) বলেছিলেন, বলেছিলেন রাষ্ট্রের বৃহত্তম শ্রেণির হাতে থাকবে মিন্স অফ প্রোডাকশন, উৎপাদন যন্ত্রের মালিকানা, প্রতিটা বিষয় স্থির হবে সেই বৃহত্তম অংশের মানুষের সায় নিয়ে, কেবল আইনসভা নয়। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টি (Communist party) যেখানে ক্ষমতায় এসেছে, সেখানেই এই গণতন্ত্র কোনও না কোনও কারণে, বা অকারণেই খর্বিত হয়েছে, মার্কসের তত্ত্বের প্রয়োগের সময়ে বিচ্যুতি হয়েছে, ভুল হয়েছে বারবার। কিন্তু তারপরেও ১৯১৭-এর পরেই সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের পরেই সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম কেবল নির্বাচন করার অধিকার নয়, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ফেরত নেওয়ার অধিকারও দিয়েছিল, সেখানে কেবল যারা আইন তৈরি করেন, তাঁরাই নয়, যারা কারখানার প্রশাসন চালাবেন, যাঁরা কৃষিখামারের প্রশাসন চালাবেন, তাঁদের ভুল হলে যাঁরা বিচার করবেন, তাঁদেরও নির্বাচিত করার অধিকার দিয়েছিল, স্ট্যান্ডিং আর্মি তুলে দিয়ে গণ ফৌজ তৈরি করা হয়েছিল, যেখানে প্রত্যেক সবল মানুষ সেই ফৌজের অংশ হতে পারত। উঠে গিয়েছিল স্যালুটেশন, জি হুজুর বলে কপালে হাত তোলা, কিছুদিনের জন্য হলেও এ সবই হয়েছিল, কিন্তু তারপর বিচ্যুতি, গণতন্ত্রের অভাব রাষ্ট্রের বিকাশকে করেছিল স্তব্ধ, মানুষ কিছুদিন চুপ করেছিল, তারপর প্রতিবাদ হতে শুরু করে, শেষমেশ ভেঙে যায় সোভিয়েত রাশিয়া (Russia)।

পৃথিবীর সমস্ত দেশের ইতিহাস একইরকমভাবে, রাষ্ট্রের বিকাশের ক্ষেত্রে গণতন্ত্রকে প্রধান আর প্রথম শর্ত হিসেবে গ্রহণ করেছে, সার্বিক গণতন্ত্র। প্রত্যেকটা মানুষের কথা বলার গণতন্ত্র, প্রশ্ন করার গণতন্ত্র, সমালোচনা করার গণতন্ত্র। ধরা যাক একটা কোম্পানি, তার ম্যানেজিং ডিরেক্টর আছে, ফিনান্স ডিরেক্টর আছে, প্রডাকশন অ্যান্ড কোয়ালিটি কন্ট্রোলের মাথায় একজন আছেন, এবার সেই কোম্পানির ম্যানেজিং ডিরেক্টর একটা সিদ্ধান্ত নিলেন, এমন তো হতেই পারে যে ফিনান্স ডিরেক্টর বললেন, এর ফলে কোম্পানি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তিনি বোঝালেন, বোর্ড অফ ডিরেক্টরের বৈঠকে সেই কথা বলা হল, সবাই শুনল, তার কথা মানা হল, বা মানা হল না। প্রোডাকশন হয়েছে, কোয়ালিটি কন্ট্রোল হেড বলল, চলবে না। প্রোডাকশন বাতিল হল। হয় না? হয়, বহু ক্ষেত্রেই হয়। এটাই স্বাভাবিক। যদি না হয়, তাহলে নিশ্চিত জানবেন, সে কোম্পানি উঠে যাবে।

ঠিক সেরকমই এক রাষ্ট্রের বহু প্রতিষ্ঠান আছে, আইনসভা আছে, বিচার বিভাগ আছে, পুলিশ আছে, বিভিন্ন প্রফেশনালরা আছেন, বিশিষ্ট জ্ঞানী মানুষজন আছেন, বিরোধী রাজনৈতিক দল আছে। এই সবাই যেন তাঁদের কথা বলতে পারেন, আর তাঁদের কথা শোনার মতো ধৈর্য যেন শাসকদলের নেতাদের, রাষ্ট্রপ্রধানের থাকে। একটা উদাহরণ দিই, দেশের নিয়ম আছে, নির্বাচন প্রচার সংক্রান্ত নিয়ম, নির্বাচনের আগে ৪৮ ঘন্টার কুলিং পিরিয়ড, কোনও প্রচার হবে না, আর নির্বাচনের দিনে তো প্রচার হবেই না। কিন্তু সেই গণতান্ত্রিক রীতিনীতি, আইন মেনে চলার কথা ভেবেও দেখেন আমাদের মোদিজি? কোনও একটা বিষয়েও? সারা দেশে নোটবন্দি করে দিলেন, কোনও আলোচনা? কোনও মতামত? ধরুন এদেশে যদি গণতন্ত্র থাকত, ন্যূনতম গণতন্ত্র, অন্তত নীতিন গড়করি বা রাজনাথ সিংয়েরও কথা বলার স্বাধীনতা থাকত, তাহলে তাঁরা প্রশ্ন করতেন, এটা আবার কী? পিএমও-র আমলারা বলতেন, স্যর এটা হয় না। চিফ সেক্রেটারি, দু’ দুজন উপদেষ্টা বলতেন, এটা আবার হয় নাকি? কিন্তু কেউ বলার নেই। বলল কে? কিছু মানুষ কোনও বিষয় নিয়ে আদালতে গেলেন, চিফ জাস্টিস তাঁর অবজার্ভেশনে বললেন, সংবিধান পড়ছি, আর্টিকল ওয়ানে বলা আছে এটা হবে না, হয় না। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধানের কোনও লজ্জা আছে? ধরুন মথুরা নিয়ে সম্ভল নিয়ে এক গণতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের ভূমিকা কী? আমরা জানি না। এখনও মণিপুর (Manipur) জ্বলছে, প্রধানমন্ত্রী কী ভাবছেন আমরা জানি না। কৃষক অনশনে বসেছেন, মৃত্যুপথযাত্রী, তিনি কোনও কথাই বলবেন না। আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান সেটাকেই গণতন্ত্র বলে মনে করেন। এটাই হল দেশের, রাষ্ট্রের বিকাশে গণতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে তাঁর ধারণা। মনে করে দেখুন না ডিমনিটাইজেশনের কথা, তাবড় অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ফেরত নিন, রোল ব্যাক করুন। তিনি কালো টাকা ধরতে বেরিয়েছেন, আর সেই সুযোগে, তাঁর কাছের লোকজন কালোকে সাদা করে কমিশন খাচ্ছেন। যদি পিএমও-র আমলাদের কথা বলার অধিকার থাকত, দেশের রিজার্ভ ব্যাঙ্কের গভর্নর জি হুজুর না হতেন, এবং যদি আমাদের প্রধান সেবকের কথা শোনার ন্যূনতম অভ্যেস থাকত, তাহলে দেশ এক বড় সর্বনাশের থেকে বাঁচত। একই কথা বলা যায় তড়িঘড়ি করে জিএসটি লাগু করার ক্ষেত্রে, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা (Article 370) তোলার ক্ষেত্রে, সিএএ বিল পাশ করানোর ক্ষেত্রে, কৃষি বিল পাশ করানোর ক্ষেত্রে, তাহলে দেশ অনেকগুলো বিপর্যয়ের হাত থেকে বেঁচে যেত। যায়নি কারণ গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না, বা তারা তাদের স্বাধীনতা হারিয়েছে, তারা মতামত দিতে ভয় পাচ্ছে।

আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ট্রাম্প সাহেব হাতকড়া পরিয়ে যুদ্ধবিমানে চাপিয়ে ফেরত পাঠালেন ভারতীয়দের

পরের বিষয়টা হল, রাষ্ট্রপ্রধানের ভিশন থাকতে হবে, এক স্বচ্ছ দিশা, কেবল মুখে সবকা সাথ সবকা বিকাশ বলব, আর নির্বাচনের সময় প্রকাশ্যে দেশের ২০ শতাংশ সংখ্যালঘু মানুষের বিরুদ্ধে বিষ ছড়াব, এই মানসিকতা নিয়ে রাষ্ট্রের দিশা নির্ধারণ সম্ভব নয়, যাদের মাথায় আছে সেই রাষ্ট্র, সেই কল্পিত রামরাজ্যের কথা, যার রাষ্ট্রপ্রধান তাঁর স্ত্রীকে কেবল অপবাদ সহ্য করতে হবে বলে ত্যাগ করেন, তাঁকে বনবাসে যেতে হয়, সেই রাষ্ট্র যেখানে ঘৃণ্য চক্রান্ত করে, ছলনা করে হত্যা করা হয় প্রতিদ্বন্দ্বীকে, সেই রাষ্ট্র যেখানে কেবল হিন্দুরা থাকে, যেখানে বর্ণাশ্রম আছে, যেখানে শূদ্রদের কাজ কেবল ব্রাহ্মণ আর ক্ষত্রিয়দের সেবা করা, যেখানে রাজার বচনই হল শেষ কথা। যাঁরা এই রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেন, যাঁরা এই রাষ্ট্র গড়ে তোলার জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ, তাদের দিশা থাকার কথা নয়, কারণ পৃথিবীর অন্য দেশ তাদের বিজ্ঞান নিয়ে, গবেষণা নিয়ে এগোচ্ছে, প্রত্যেকটা মানুষের বিকাশের জন্য কাজ করছে বহু মানুষ, শ্রম আর তার ভূমিকাকে মেনে নিয়েছে সবাই, তাঁরা আজ থেকে ৫০ বছর পরে মেরুপ্রদেশের পরিবেশ নিয়ে ভাবছেন, তাঁরা পরিবেশ নিয়ে ভাবছেন, তাঁরা ভবিষ্যত পরিকল্পনা করছেন সে সব মাথায় রেখে। আমার দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মনে করেন রামমন্দির (Ram Mandir) প্রতিষ্ঠার দিন হল, দেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা দিবস। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে।

এবং দরকার শিক্ষা, জ্ঞান, বিজ্ঞান, ইতিহাস ভূগোলের জ্ঞান। দেশের রাষ্ট্রপ্রধান মনে করেন, গণেশের মাথা কেটে হাতির মাথা বসানো হয়েছিল, সেটা ছিল প্ল্যাস্টিক সার্জারি। যে রামদেব বাবাকে দেখলে জড়িয়ে ধরেন, সেই বাবাজি প্রকাশ্যে বলেন অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসা ভুল, তিনি গোমূত্র, গোবর বিক্রি করছেন, এই অশিক্ষা আরএসএস–বিজেপির শিরায় শিরায়, তারা দেশকে মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, মানুষের মধ্যে অন্ধবিশ্বাস, কুসংস্কারকে জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রী প্রাণপণে এ প্লাস বি হোল স্কোয়ারের থেকে এক্সট্রা টুএবি খোঁজার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। প্রকৃত শিক্ষার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে থাকা এই রাষ্ট্রপ্রধান, দেশের বিকাশ নয় দেশের সর্বনাশ ডেকে নিয়ে আসছেন, রাষ্ট্রগঠনের তিন প্রধান শর্ত, গণতন্ত্র, দিশা, শিক্ষা, তিনটেই আজ চূড়ান্ত অবহেলিত, যাঁরা আজ এই অপশাসনের বিরুদ্ধে লড়বেন, তাঁদের মাথায় থাকতেই হবে রাষ্ট্রগঠনের এই প্রাথমিক তিন শর্তের কথা।

অন্য খবর দেখুন

RELATED ARTICLES

Most Popular


Deprecated: Automatic conversion of false to array is deprecated in /var/www/ktv/wp-content/themes/techinfer-child/functions.php on line 39