১০ অগাস্ট সল্টলেকে কলকাতা পুলিশের ৪ নম্বর ব্যাটেলিয়নের ব্যারাক থেকে যখন সঞ্জয় রায়কে গ্রেফতার করা হল, তখন সে থানায় গিয়েই নির্বিকার মুখে বলেছিল, আমাকে ফাঁসি দিয়ে দিন। সেদিন রাতে বলেছিল, রেপ করেছি, কিন্তু খুন করতে চাইনি, মরে গেছে বুঝতেও পারিনি, ভুল করে ফেলেছি স্যর। আর ১৮ অগাস্ট শিয়ালদহ সাবজুডিসিয়াল আদালতে সে চিৎকার করে বলল তাকে ফাঁসানো হয়েছে, আমি গরিব বলে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে। দুটোর কোনও বক্তব্যের আইনত স্বীকৃতি নেই, পুলিশের কাছে জেরার মুখে ওই ধর্ষক খুনি কী বলেছিল তারও কোনও আইনি স্বীকৃতি নেই, আবার আদালতের সামনে সাংবাদিকদের দিকে তাকিয়ে বা আদালতের ভেতরে রায় শোনার পরে আমাকে ফাঁসানো হয়েছে বলারও কোনও আইনি স্বীকৃতি থাকার কথা নয়। কিন্তু এই যে ফাঁসি দিন থেকে ফাঁসানো হয়েছে, এই জার্নিটা অসাধারণ অনেক দিক থেকে। সে অবলীলায় আদালতে রায় শোনার পরে তার রুদ্রাক্ষ পরে থাকার গল্প বলছে, যে রুদ্রাক্ষ পরেই সে ওই দিনেই কলকাতার দু’ দুটো রেড লাইট এলাকাতে গেছে, মদ খেয়েছে, অকথ্য গালিগালাজ করেছে, ওই রুদ্রাক্ষ পরেই ধর্ষণ এবং খুন না করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু এতদিন পরে এক হিন্দি সিনেমার বহু ব্যবহৃত ইমেজারিকে সামনে এনেছে, হয় ধর্ষিতার মুক্তোর হার ছিঁড়ে যায়, না হলে ধর্ষকের গলার তাবিজ পড়ে থাকে খাটের তলায়, পুলিশ গোয়েন্দারা তা পায় না, হিরো দেখে ফেলে, চিহ্নিত হয় ভিলেন। সেই বস্তাপচা গল্প সঞ্জয় রায় অনায়াসে বলে দিল বিচারকের সামনে। কিন্তু এই যুক্তি তাকে জোগাল কে? এই ভরসা তাকে দিল কে? ধরা পড়ার পরেই আমাকে ফাঁসি দাও যে ছেলেটা বলেছিল, সেই ছেলেটাই আমাকে ফাঁসানো হয়েছে বলার সাহসটা পেল কীভাবে? সেটাই বিষয় আজকে, আমাকে ফাঁসি দিন, আমাকে ফাঁসানো হয়েছে, সঞ্জয় রায়।
যে দেশে প্রতি ন’ মিনিটে একটা ধর্ষণ হয়, যে দেশের রাজধানীতে ২০২৪-এ ৫০৪ খানা খুনের ঘটনা ঘটেছে, সেই দেশে ধর্ষণ বা খুন হবে না এমনটা তো সম্ভব নয়, কিন্তু ধর্ষণ বা খুন হলে যেন অপরাধী ধরা পড়ে, কেউ যেন ওই অপরাধীকে আড়াল না করে, যে যে কারণে একজন অপরাধী এই ধর্ষণ আর খুন করার সুযোগ পেয়ে যায় তাকে চিহ্নিত করা, এই বিষয়গুলো নিয়ে মানুষজন ভাবে, আলোচনা করে। সেই দিক থেকে শহরের প্রাণকেন্দ্রে এক সরকারি হাসপাতালে ধর্ষণ আর খুন আলোড়ন তুলবে বইকী। কিন্তু আরজি করের ঘটনাতে দু’ দিনের মাথাতেই অপরাধী গ্রেফতার হল, বেশ কিছু সলিড সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তাকে গ্রেফতা করা হল, কিন্তু এক আন্দোলন শুরু হল যার মোদ্দা দাবিটাই ছিল বাকিদের ধরা হোক। এই বাকিরা কারা? বোঝার আগেই তদন্তের ভার চলে গেল সিবিআইয়ের কাছে, ইতিমধ্যেই আরজি করের অধ্যক্ষ্য থেকে মেডিক্যাল কলেজের মাথারা, পুলিশ কমিশনার থেকে ওসি, স্বাস্থ্যমন্ত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী ওই বৃহত্তম ষড়যন্ত্রকারীদের তালিকাতে চলে এসেছেন।
আরও পড়ুন: Aajke | সরকারকে ব্ল্যাকমেল করার চেষ্টা করছেন জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা?
সমাজের ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোকজনেদের বিশাল অংশ মনে করছেন এটা ধর্ষণ নয়, গণধর্ষণ, ওই আরজি কর সেমিনার হলে খুন হয়নি, অন্য কোথাও খুন করে ডেডবডি এখানে এসে ফেলে দিয়ে গেছে, বিশাল দুর্নীতির অগ্রভাগ জানতে পেয়ে গিয়েছিল এই অভয়া, কাজেই তাকে খুন করা হল, থ্রেট কালচার ইত্যাদির তত্ত্ব হাজির। হাজির আমি সোমা বলছি থেকে সূত্র থেকে পাওয়া ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে খবরের সুনামি। কী ভাবছেন এগুলো ওই সঞ্জয়ের চোখ এড়িয়ে গেছে? জেলে টিভি নেই? সে দেখেনি যে তাকে এক জনকল্লোল চিৎকার করে জানান দিচ্ছে যে সে কেবল বলি কা বকরা, তাকে কেবল ফাঁসানো হয়েছে, তার উকিলেরা দেখেনি এই কল্লোলিত রাজপথ, দেখেননি দেশের নামী দামি ল ইয়ারদের এই বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের কথা বলতে? সঞ্জয় দেখেননি ডাক্তারদের নেতারা শিরদাঁড়া দিয়ে এসেছে পুলিশ কমিশনারের হাতে? সে প্রতিদিন নিজেকে তৈরি করেছে, হয়তো নিজেকে বিশ্বাসও করিয়েছে যে সে হয়তো ছিল, কিন্তু তাকে দিয়ে এই কাজ তো করানো হয়েছে। একজন ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া খুনি সমাজের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষিত মানুষের সমর্থনে নিজেকে নির্দোষ বলার সাহসটুকু জুগিয়ে নিল। সে এখন রুদ্রাক্ষের গল্প বলছে, বলছে পুলিশ কমিশনারের কথা, অবশ্যই তাঁর পক্ষের আইনজীবীদের অর্ধেক কাজ তো সেরেই রেখেছেন জুনিয়র ডাক্তারদের নেতারা, তাঁদের করা ২৪টা প্রশ্নই তো আপাতত সঞ্জয়ের কাছে সবথেকে বড় হাতিয়ার। কিন্তু একটা মোদ্দা কথায় আসা যাক, ধরেই নিলাম এই সঞ্জয়কে ফাঁসানো হয়েছে, সে কেবল নির্দেশ মতো ধর্ষণ আর খুনটুকু করেছে, কিন্তু সে তো অগ্নিযুগের বিপ্লবী নয় যে ফাঁসিকাঠে ওঠার আগেও তাকে যারা নির্দেশ দিয়েছিল তাদের নাম বলবে না, বলে দেবে না কখন কারা তাকে কোথায় ডেকে এই নির্দেশ দিয়েছিল, বলবে না যে এই নির্দেশের বিনিময় তাকে কী দেওয়া হয়েছিল, সেই হিসসা, সেই ফ্ল্যাটবাড়ি, সেই টাকা সে কোথায় রেখেছে? মানে একটা হাই রিস্ক জোনে একটা খুন আর ধর্ষণের জন্য এরকম কিছু কনসিডারেশন তো থাকাই স্বাভাবিক, তাই না? কই ওই আমাকে ফাঁসানো হয়েছে ছাড়া সে আর কিছু বলেছে? তার উকিলরা কি একবারও এই ফাঁসানোর তত্ত্ব তাঁদের সওয়ালে এনেছেন? আনেননি। আনেননি কারণ তাঁরা জানেন গ্যালারি গরম করা এক ব্যাপার আর আদালতে সওয়াল জবাবটা আর এক ব্যাপার। কিন্তু সে যাই হোক, যাঁরা ওই গণধর্ষণ আর বৃহত্তর ষড়যন্ত্রের তত্ত্ব নিয়ে মাঠে আছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই আসলে এই ধর্ষকের, এই খুনির মুখে ভাষা জোগাচ্ছেন, এটা তাঁদের মাথায় কবে ঢুকবে জানি না। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম যে যাঁরা গণধর্ষণ বা আরও বিরাট ষড়যন্ত্রের কথা বলছেন, তাঁরাই কি এই ধর্ষক খুনি সঞ্জয় রায়ের পক্ষের যুক্তি সাজিয়ে দিচ্ছেন না? তাঁদের যুক্তি বুঝে শুনেই এই সঞ্জয় রায় যে ধরা পড়ার পরেই বলেছিল আমাকে ফাঁসিতে চড়িয়ে দিন, সেই একই মানুষ এখন আমাকে ফাঁসানো হয়েছে বলার সাহস দেখাচ্ছেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
সমাজে অপরাধ ঘটে, আর সেই বিভিন্ন অপরাধ ঘটায় কিছু অপরাধী, কিন্তু সমাজ রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে এমন কিছু থাকে যা দুর্নীতির জন্ম দেয়, সেই দুর্নীতি অপরাধের জন্ম দেয়, সেই অপরাধ বিভিন্নভাবে আমাদের সামনে আসে, কখনও চুরি, কখনও খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি। রাষ্ট্রকে দুর্নীতিমুক্ত হতেই হবে, রাষ্ট্রকে দুর্নীতিবাজ মানুষজনদের চিহ্নিত করে শাস্তি দিতেই হবে, সেটা খুব জরুরি, কিন্তু কাঠামোগত এই ত্রুটি, এই অপরাধ বেড়ে ওঠার মতো এক ব্যবস্থাকে সামনে রেখে অপরাধীদের আড়াল করা হবে, সেটাও কোনও কাজের কথা নয়। সঞ্জয় রায় ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে, অন্যধারে আরজি করের দুর্নীতি, অধ্যক্ষের গাফিলতির ফলে এই ধর্ষক খুনি সুবিধে পেয়েছে, এটা সত্যি, কিন্তু দুটো অপরাধকে একসঙ্গে জুড়ে দিতে গেলে প্রথম অপরাধকে হালকা করে দেখানো হয় আর দ্বিতীয় অপরাধকে গুলিয়ে দেওয়া হয়। সঞ্জয় রায়ের শাস্তি আমাদের খানিক স্বস্তি দেবে আর আমরা এরসঙ্গে এটাও চাইব যদি আরজি কর অধ্যক্ষ দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকেন, তাহলে তাঁরও বিচার হোক, তিনিও শাস্তি পান।