সিপিএমের নেতারা সেই দুষ্টু ছেলেদের গল্পটা মন দিয়ে পড়েছে, সেই দুষ্টু ছেলেগুলো একজন ব্রাহ্মণকে একটা ছাগল নিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বিভিন্ন জায়গাতে দাঁড়িয়ে সমানে বলে যাচ্ছিল যে ও ঠাকুরমশাই আপনি হাট থেকে এমন ঘেয়ো কুকুর কিনে ঘরে ফিরছেন, তাও এই অবেলায়? একবার, দু’বার, তিনবার, চারবার পাঁচবার একই কথা শোনার পরে সেই ব্রাহ্মণ সত্যিই মনে করল যে তারই চোখের সমস্যা সে একটা ঘেয়ো কুকুরকে নিয়ে ঘরে ফিরছে, তো সে তখন ছাগলটাকে ওইখানে ফেলেই ঘরে ফিরে গেল। দুষ্টু ছেলের দল ছাগল কেটে ফিস্টি করল। সিপিএম কেবল নয়, এই একই তত্ত্ব ছিল গোয়েবলসের, একই তত্ত্ব মোদিরও, ক্রমাগত একই মিথ্যে বারবার বলো, প্রকাণ্ড মিথ্যে বারবার বলতে থাকলে মানুষ একসময়ে তা সত্যি বলে মেনে নেয়, গোয়েবলস বলার বহু বহু আগে ঈশপের গল্প বা ঠাকুর শ্রী রামকৃষ্ণের উপদেশেও এই গল্প এসে গেছে। কিন্তু এই মিথ্যেকে সত্যি বলার দুটো সমস্যা আছে। ১) একজন মানুষকে অনায়াসে ঠকানো যায়, বহু মানুষকে একসঙ্গে মূর্খ বানিয়ে রাখা অসম্ভব। ২) মিথ্যে ধরা পড়ে গেলে গুডউইলে টন টন গ্যামাক্সিন পড়ে যাবে, মিথ্যেবাদীকে মানুষ বিশ্বাস করা বন্ধ করবে, আর সেই বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা ভারি কঠিন। তো আমাদের সিপিএম মানে কমরেড সেলিম সুজন শমীক ইত্যাদিরা গল্পটা পড়েছেন, গোয়েবলসের পথে চলছে কিন্তু তারা জানে না এতে তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়েছে, হচ্ছে, মানুষ তাঁদের কথায় বিশ্বাস করছেন না। আজ সেটাই বিষয় আজকে বিজেমূল না তৃণমূল? সিপিএমকে ভাবতেই হবে।
খেয়াল করে দেখুন, ২০১৪তে লোকসভার নির্বাচনে নয়, সে নির্বাচনে তৃণমূল তো আসলে বিজেপির বন্ধু শক্তি ইত্যাদি কিছু কথা বললেও, ওই বিজেমূল টার্ম তারপরে এল, ২০১৬ থেকে তা জোর পেল। বিজেপির নব উত্থানের পর থেকে এই রাজ্যে সিপিএম এক নতুন স্লোগান দিতে শুরু করেছিল, বিজেমূল। মানে তৃণমূল আসলে বিজেপির হয়েই কাজ করে, তৃণমূল বিজেপির বি টিম। লোকে কিন্তু দেখল ২০১৯-এ বিজেপির বিরুদ্ধে এ রাজ্যে তৃণমূল অল আউট লড়ল, তাদের আসন কমল, বিজেপি এতটা উঠে আসায় যে মেরুকরণ হল তাতে বিরাট পরাজয় হল বামেদের, সিপিএমের, কারণ সেই তখন থেকেই আগে রাম পরে বাম চালু হয়ে গেছে, তলায় তলায়।
আরও পড়ুন: Aajke | ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই কিল মারার শুভেন্দু
তার মূল কারণ ছিল বামেরা বিজেপি নয়, তৃণমূলকেই তাদের মূল শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল, করেছে, এখনও সেই অবস্থানেই দাঁড়িয়ে আছে। তলার বাম কর্মী সমর্থকরা তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণা, তৃণমূলকে হারানোর ইচ্ছেটাকে সাকার করার জন্যই বিজেপিকে ভোট দিতে শুরু করেছিল সেই ২০১৯ থেকে। এক বিশাল বাম ভোট চলে গেল বিজেপির দিকে তা আর ফেরার নাম নেই এবং তা যদি না ফেরে তাহলে সিপিএম শূন্যেই থেকে যাবে, এটা সম্ভবত বুঝতে পেরেছে সিপিএম কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব। মমতা আর মোদির বিরুদ্ধে একই সুরে কথা বললে তা বিশ্বাসযোগ্য হয়ে উঠবে না সেটা বুঝতে এত দেরি হল কেন? কারণ একটাই। ওনারা তৃণমূলের সমর্থনের ভিত্তিটা বুঝে উঠতে পারেননি। কারা তৃণমূলকে সমর্থন করেন? তাঁরা হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী? তাঁরা সংখ্যালঘুদের ঘৃণা করেন? তাঁরা মোদি-শাহের সমর্থক? তাঁরা হিন্দু খতরে মে হ্যায় বলে রাজনীতি করেন? তাঁদের এক বিরাট অংশই কি সংখ্যালঘু নন? এগুলোর উত্তর জানা থাকলেই বোঝা যায় যে তৃণমূল আর বিজেপির সমর্থক আলাদা, দুটো দলের মত পথ আলাদা। সিপিএম যদি বিজেপিকেই তাদের প্রধান শত্রু বলে চিহ্নিত করে, যদি তাদের প্রচারের মূল লক্ষ্য বিজেপি বিরোধিতা হয়, তাহলে লক্ষ লক্ষ সমর্থক কর্মীরা সেই বিজেপি বিরোধিতার জায়গা থেকেই আবার ঘরে ফিরবেন। কিন্তু যদি নিজেকে আদতে তৃণমূল বিরোধী বলেই চিহ্নিত করেন, যদি আসলে তৃণমূলকেই হারানোটাই মূল লক্ষ্য হিসেবে তুলে ধরেন তাহলে ওই সাধারণ কর্মী সমর্থকেরা তৃণমূলকে হারানোর সহজ উপায়টাই তো বেছে নেবে, নিচ্ছে। সেই ভোট চলে যাচ্ছে বিজেপির বাক্সে, আগে রাম, পরে বাম আর তার ফলে সিপিএমের শূন্য থেকে মহাশূন্যে হারিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর থাকছে না। এটা ভাবার কোনও কারণ নেই যে কমরেড সেলিম বা সুজন বা শমীক এই কথাগুলো জানেন না, তাঁরা সব জানেন, তাঁরা আসলে নিজের নাক কেটে তৃণমূলের যাত্রাভঙ্গ করার চেষ্টাতে আছেন। তাঁদের ভয়ঙ্কর এবং দীর্ঘ আলোচনার পরে তাঁরা আপাতত বড় শত্রু হিসেবে বিজেপিকেই চিহ্নিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সমস্যা হল সেখানেও বাধ সাধছে আরেক নতুন প্রবণতা, বাম এমনকী বিজেপির এক অংশের ভোটারেরা বিভিন্ন কারণে তৃণমূলের দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। ইন্ডিয়া টুডে-র মুড অফ দ্য নেশন বুঝুন। ওনারা এই মুহূর্তে লোকসভার নির্বাচন হলে তৃণমূল ৪৬ % ভোট আর বিজেপি ৪০ % ভোট পাবে বলে জানিয়েছেন, তো বিজেপির কিছু আহাম্মক বলেছেন ওই ৬ % আমরা ম্যানেজ করে নেব, ৬ % মানে তো তিন শতাংশ পেলেই সমান সমান। খেয়ালই করেননি যে এই হিসেবটা লোকসভা ভোটের প্রেক্ষিতে যেখানে বিজেপি এই রাজ্যে ৩/৪/৫% বেশি ভোট পায়, মানে সামনে বিধানসভাতে তৃণমূল ৪৮/৪৯% র বেশি ভোট পেতে চলেছে, বিজেপি ৩৮/৩৯% এবং সে ক্ষেত্রে তৃণমূল ২৫০ আসন পেলেও অবাক হওয়ার কথা নয়। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, কোন কারণে প্রায় ১৫ বছরের অ্যান্টি ইনকমব্যান্সি, প্রতিষ্ঠান বিরোধী সমস্ত হাওয়াকে উড়িয়ে দিয়ে তৃণমূলের সমর্থন বাড়ছে? সমস্ত রাজ্যে এগোলেও এই বাংলায় বিজেপি পিছিয়ে পড়ছে কেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
পূর্ণ বৃত্ত বলে একটা কথা আছে, জীবন এবং রাজনীতি দু’ জায়গাতেই সেটা কাজ করে। একটা বৃত্তের ওঠার এক চূড়ান্ত পর্যায়ের পরে নামা শুরু হয়, নামতে থাকে এক নতুন বৃত্ত ধরে। বিজেপির উত্থানের বৃত্ত এক পূর্ণতায় এসে ঠেকেছে। দেশে বিদেশে, অর্থনীতি, বিদেশ নীতি সর্বত্রই তার এক পিছিয়ে আসা, নামা, পতন আমরা দেখতে পাচ্ছি। এ রাজ্যও ব্যতিক্রম নয়। বামেরা যদি এই মুহূর্তে মমতা বিরোধিতার যে জায়গা বিজেপি দখল করে বসে আছে, তাতে থাবা বসাতে পারে, তাহলে বামেদের ভোট আগামী দিনে খানিক বাড়তে পারে, আর তা বাড়লে সিপিএম আবার ঘুরে দাঁড়ানোর এক স্বপ্ন দেখলেও দেখতে পারে, তা করতে গেলে তাদেরকে বিজেমূল তত্ত্ব থেকে বের হতেই হবে। সেটাই সম্ভবত সিপিএমের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বলতে চান।