৩৭০ ধারা ফেরানোর দাবি নিয়ে কার্যত রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা। রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারও যে শেষ কথা ছিল না, সেটাই এবার স্পষ্ট হল। ২০১৯ সালে বিজেপি ভারতের সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করে নেয়। তা নিয়ে সারা ভারতে তখন তোলপাড়। এবারের নির্বাচনী ফলে দেখা গেছে, কাশ্মীর উপত্যকায় ন্যাশনাল কনফারেন্স (এনসি) এবং কংগ্রেস জোট বিজেপিকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছে। নির্বাচনের আগেই কংগ্রেস ও ওমর আবদুল্লার দল এনসির মধ্যে জোট তৈরি হয়। তারা মোট ৯০টি আসনের মধ্যে ৪৯টি দখল করেছে, বিজেপি পেয়েছে ২৬টি। এভাবেই ক্ষমতা ফিরে এসেছে কংগ্রেস-এনসি জোটের হাতে। ফল ঘোষণার এক ঘণ্টার মধ্যেই এনসি চেয়ারম্যান ফারুক আবদুল্লা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে ওমরের নাম ঘোষণা করেন। কাশ্মীরে আরএসএসকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি সরকার গঠনের যে স্বপ্ন দেখছিল, জনগণ তাতে জল ঢেলে দিয়েছে।
নির্বাচনী প্রচারে মোহন ভাগবত হিন্দুদের এককাট্টা করার চেষ্টা করলেও কাশ্মীরে তাদের হতাশ করেছে জনগণ। কাশ্মীরে উন্নয়নের জোয়ার আনতে চাইলেও মোদি-অমিত শাহ জুটি মুখ থুবড়ে পড়েছে সেখানে। ভোটবাক্সে সম্পূর্ণভাবে এনসির জয়জয়কার, জোটসঙ্গী হিসেবে কংগ্রেসও শামিল হয়েছে বিজয়ী শিবিরে। ফল প্রকাশের পর যে প্রশ্নটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিয়েছিল, তা হল ৩৭০ ধারা প্রসঙ্গ। আদৌ কি বাস্তবে জম্মু-কাশ্মীরে প্রশাসনিক ক্ষেত্রে কিছু পরিবর্তন হবে? পূর্ণরাজ্যের মর্যাদাই বা কবে পাওয়া যাবে? সংবিধানে ৩৭০ ধারা কি আদৌ ফিরিয়ে দেওয়া হবে?
ইতিহাস বলে, যখন পাকিস্তান কাশ্মীর আক্রমণ করে, তখন রাজা হরি সিং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নেহরুর কাছে সাহায্য প্রার্থনা করেন এবং নেহরু তৎক্ষণাৎ সেনাবাহিনী পাঠিয়ে কাশ্মীরকে পাকিস্তানের হাত থেকে মুক্ত করেন। এর পরই হরি সিং কাশ্মীরকে ভারতের ভূখণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করতে চান এবং আজাদ কাশ্মীর ঘোষিত হয়। সেই সময় থেকেই ভারতীয় সংবিধানে অস্থায়ীভাবে ৩৭০ ধারা যুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়। বিজেপি সরকার এই ধারা প্রত্যাহার করে নেওয়ার ফলে স্বাভাবিকভাবেই উপত্যকা অঞ্চলে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়।
আরও পড়ুন: ব্যাঙ্কে পাঁচদিন কর্মদিবস, শনি-রবি ছুটি! কবে থেকে এই নিয়ম কার্যকর
রাজনৈতিক মহল মনে করে, ৩৭০ ধারা ফিরে পাওয়ার প্রশ্নটি এখন অমীমাংসিত থাকলেও এই নির্বাচনের ফল নিঃসন্দেহে কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা লাভের আকাঙ্ক্ষাকে প্রতিফলিত করেছে। স্বাধীনতার পূর্বেই জনসংঘের মূল রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল অযোধ্যায় রামমন্দির স্থাপন, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং সংবিধান থেকে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার করা। এই এজেন্ডার নেতৃত্বে তখন ছিলেন লালকৃষ্ণ আদবানি। একই সঙ্গে ৩৭০ ধারা প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকে বিরোধিতাও জানিয়েছেন তাঁরা ভোটের মাধ্যমে। এনসির প্রবীণ নেতা ফারুক আবদুল্লা জানিয়েছেন, মানুষ তাঁদের উপর এতদিন পরে আস্থা রেখেছেন। তাঁরাও মানুষের সব দাবি-দাওয়া পূরণের চেষ্টা করবেন। পুলিশি নির্যাতন বন্ধ করা হবে, দিনের পর দিন জেলবন্দি নিরপরাধ মানুষকে মুক্তি দেওয়া হবে, সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করা হবে এবং উপত্যকায় হিন্দু-মুসলিমের মধ্যে বিশ্বাসের সম্পর্ক ফিরিয়ে আনা হবে। ফারুক আবদুল্লা আরও মনে করেন, দীর্ঘ ১০ বছর পর একটি গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কাশ্মীরে, মানুষ অকপটে তাদের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেছে এবং বুঝিয়ে দিয়েছে যে, তারা ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার কখনও সমর্থন করেনি।
কাশ্মীর উপত্যকায় বিজেপির এই বিপর্যয় ও কংগ্রেসের সাফল্যের পিছনে কারণগুলো খতিয়ে দেখলে বোঝা যাবে, বিজেপি যে নয়া কাশ্মীরের প্রচার করেছিল, তার কোনও প্রভাব পড়েনি নির্বাচনে। লোকসভা নির্বাচনে কাশ্মীরের তিনটি আসনের একটিতেও প্রার্থী দিতে পারেনি বিজেপি। ৩৭০ ধারা প্রত্যাহার যে মানুষের মনে অসন্তোষ সৃষ্টি করেছে, সেটা তখন থেকেই স্পষ্ট। মূল্যবৃদ্ধির সমস্যাও কাশ্মীরের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়িয়েছে। অন্যদিকে কাশ্মীরের উগ্রপন্থী সমস্যা মোকাবিলার ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় সরকার অনেক সময় প্রয়োজনের তুলনায় বেশি কড়া পদক্ষেপ নিয়েছে, ফলে সাধারণ মানুষ অত্যন্ত অসন্তুষ্ট ছিলেন। বিজেপি সরকার চাকরি ও বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পালনেও ব্যর্থ হয়েছে। এবারের ভোটবাক্সে এসব ক্ষোভ উগরে দিয়েছে মানুষ। এ ছাড়া কাশ্মীরে এবারের নির্বাচনে এনসির বিরুদ্ধে কিছুটা লড়াই করলেও গুরুত্ব হারিয়েছে পিডিপি, পেয়েছে মাত্র তিনটি আসন। পরাজিত হয়েছেন স্বয়ং মুফতি-কন্যা ইলতিজা।
গণতন্ত্র বজায় রাখার ক্ষেত্রে কাশ্মীরের এই নির্বাচনী ফল অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, যতদিন জম্মু-কাশ্মীরে উপরাজ্যপালের হাতে প্রকৃত ক্ষমতা থাকবে, ততদিন এনসি সরকার উপত্যকার মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা কতটা পূরণ করতে পারবে, সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থেকেই যাচ্ছে।
তবে রাজনৈতিক সূত্র অনুযায়ী, যেহেতু বিধানসভায় কংগ্রেসের তুলনায় এনসির আসনসংখ্যা অনেক বেশি, তাই এনসির প্রস্তাবে সমর্থন করা ছাড়া কংগ্রেসের কাছে কোনও উপায় নেই। উপত্যকা জয়ের পর এনসি ও কংগ্রেস জোট নিজেদের বোঝাপড়া বজায় রেখে চলতে পারে কি না, সেদিকেই তাকিয়ে থাকবে সাধারণ মানুষ।
দেখুন অন্য খবর: