রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়
দিন বদলায় না!
গোটা পৃথিবীকে গিলে খেতে চায় সে-ই যে ন্যাংটো ছেলেটা
কুকুরের সাথে ভাত নিয়ে তার লড়াই চলছে, চলবে ।
পেটের ভিতর কবে যে আগুন জ্বলেছে এখনো জ্বলবে!
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কবিতা। এসব কবিতা কমিউনিস্টরা, বামপন্থীরা পড়তেন, লিখতেন, পরবর্তীতে সে পরিধি বিস্তৃত হয়েছে, তৃণমূলের সভাতেও শুনেছি, কারা মোর ঘর ভেঙেছে স্মরণ আছে ইত্যাদি গান বা কবিতা। কখনও সখনও অন্যরকম সিনেমা ইত্যাদিতেও শোনা গেছে। কিন্তু এ ভাষা ক্ষমতার শীর্ষে থাকা, রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে থাকা মানুষের মুখ থেকে শোনা যায়নি। এমনকি গদিতে বসার পর কমিউনিস্টরাও রাজা আসে রাজা যায় বলেননি, বললে সন্দেহের চোখে দেখেছেন। কিন্তু সব্বাইকে অবাক করে দিয়ে দেশের চিফ জাস্টিস, সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতি এই কথা বললেন। জাস্টিস রামানা ক’দিন আগে এক বক্তৃতা দিতে গিয়ে কেবল এই নিয়েই বললেন। বলার শুরুতেই স্পষ্ট করেই জানালেন যে কেবল সরকার বদলের ফলেই অত্যাচার মুছে যাবে এমনটা নয়। বললেন এ যাবৎ ৫০% সরকার বদলে দিয়েছে এদেশের মানুষ, নির্বাচনে পরাজিত করেছে বিভিন্ন দলের সরকারকে। কংগ্রেসকে হারিয়েছে মানুষ, মানুষ হারিয়েছে সমাজবাদী পার্টিকে, জনতা দলকে, কমিউনিস্ট পার্টিকে, ডিএমকে, এডিএমকে, তেলেগু দেশম থেকে বিজেপির সরকারকেও হারিয়েছে মানুষ। কিন্তু ভোটে হারিয়ে দিতে পারে এই অধিকার মানুষের আছে বলেই অত্যাচার কমে যাবে তার কোনও নিশ্চয়তা নেই, কোনও গ্যারন্টি নেই। পি ডি দেশাই মেমোরিয়াল লেকচার দিতে এসে তিনি এই কথা বললেন। বললেন যে সংবিধান সরকার বদলের গ্যারন্টি তো দিয়েছে, কিন্তু সেই সরকার বদলালেই অত্যাচারীদের নিশ্চিহ্ন করা যাবে এমনটা নয়। তিনি বললেন, মানুষের মুক্ত স্বাধীন চিন্তা ও মতামত প্রকাশের অধিকার মানুষকে তাঁর সম্মান নিয়ে বাঁচতে দেয়, কেবল তখনই গণতন্ত্রের পূর্ণ বিকাশ সম্ভব। নির্বাচন, রাজনৈতিক আলোচনা, সমালোচনা, বিরোধী মতামত উঠে আসাই গণতন্ত্রকে বাঁচিয়ে রাখে। ব্রিটিশরা শাসন করতো আইন দ্বারা, বাই দ্য ল, কিন্তু প্রয়োজন আইনের শাসন, অফ দ্য ল। কারণ কোনও আইন বৈষম্যমূলক হতে পারে, তার দ্বারা শাসন আইনের শাসন নয়, তা এক ধরণের অত্যাচার। তিনি বক্তৃতা শেষ করলেন এই বলে যে সেই আইনের শাসন বহাল রাখার জন্য সংবিধান স্বীকৃত অধিকার যাতে খোয়া না যায়, কেউ কেড়ে নিতে না পারে তা দেখাটা খুব জরুরি আর সেই দেখার ভারটা নিতে হবে বিচার ব্যবস্থাকেই, মানে আমাদের গণতান্ত্রিক অধিকার বজায় রাখার জন্য চাই এক স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা, যে বিচার ব্যবস্থা আমাদের সংবিধানের দেওয়া অধিকারগুলোকে অক্ষুণ্ণ রাখবে।
যে কোনও প্রতিবাদী, বামপন্থী, কমিউনিস্ট পার্টির ভাষণে যা বলা হয়, যা বলা উচিত, তা শোনা গ্যালো দেশের মুখ্য বিচারপতির গলায়। কখন? যখন দেশের যাবতীয় গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণা কে চুলোর দোরে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে মোদি – শাহ সরকার।
আসলে দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, অধিকার, মানবাধিকার। পিছিয়ে পড়া মানুষের জীবনের মানোন্নয়ন এ সব কিছুই নির্ভর করে দেশের বিচারব্যবস্থা আর দেশের চতুর্থ স্তম্ভের স্বাধীনতার ওপর। আমাদের দেশের বিচার ব্যবস্থার অবস্থাটা ঠিক কেমন? ন্যাশন্যাল জুডিশিয়াল ডেটা গ্রিড থেকে জানা যাচ্ছে কেবলমাত্র হাইকোর্টে ৫৭.৫ লক্ষ মামলা পেন্ডিং আছে, ঝুলে আছে। ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট, জেলা আদালতগুলোতে ৪৩৯ লক্ষ মামলা ঝুলে পড়ে আছে। ওই যে আদালত চত্বরে মানুষের ভিড় দেখেন, তাঁরাই ওই সংখ্যা, নিজেদেরই অজান্তে কোর্ট চত্বরের খাবারের দোকানদার, চা, সিঙাড়ার দোকানদার, টাইপিস্ট, এমন কি কুকুর বেড়ালগুলোর সঙ্গেও বন্ধুত্ব হয়ে যায় তাঁদের, মামলা শেষ হয় না। এদিকে আইন শিক্ষার প্রথম পাঠ বলছে জাস্টিস ডিলেইড ইস ইকুয়াল টু জাস্টিস ডিনায়েড, বিচারে দেরি হওয়ার মানে বিচার না পাওয়া মানেই অবিচার। সেমিনারে সুপ্রিম কোর্টের মুখ্য বিচারপতির কাছে কি এ তথ্য নেই? নিশচই আছে। তিনি কী করেছেন? এর আগের বিচারপতিরা কী করেছেন? কিছুই না। ১০ থেকে কুড়ি বছর ধরে হাইকোর্টে ঝুলে আছে ১০ লক্ষের বেশি মামলা, ২০ থেকে ৩০ বছরের ও বেশি সময় ধরে পেন্ডিং আছে দেড় লক্ষেরও বেশি মামলা, জেলা আদালতে ১০ থেকে ২০ বছরের বেশি সময় ধরে পড়ে আছে ২৭ লক্ষেরও কিছু বেশি মামলা। ২০০০ সালে বিষ্ণু তেওয়ারির বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা হয়, জেলা আদালত তাকে দোষী সাব্যস্ত করে, তার জেল হয়, ২০২০ সালে এলাহাবাদ হাইকোর্ট বিষ্ণু তেওয়ারিকে নির্দোষ বলে রায় দেয়, ইতিমধ্যে বিষ্ণু তেওয়ারি ২০ বছর জেল খেটে ফেলেছে। এই হল আমাদের বিচার ব্যবস্থা। ১৯৮১ তে দীপক জাইসি, এক নেপালের নাগরিক দার্জিলিংয়ে খুনের দায়ে গ্রেফতার হয়, ৪০ বছর পরে কলকাতা হাইকোর্ট দীপককে নির্দোষ ঘোষণা করে, ইতিমধ্যে সে দমদম জেলে ৪০ বছর কাটিয়ে ফেলেছে, রিপ ভ্যান উইঙ্কলের দ্বিতীয় সংস্করণ। জেল থেকে বেরিয়ে দেখবে এক অচেনা পৃথিবী, অচেনা মানুষ জন, জেলের বাইরে আকাশ তার কাছে অস্পষ্ট, ধোঁয়াশা। ১৯৯৬ এ রাজস্থানে সামলেটি ব্লাস্ট কেসে ৬ জন জেলে যায়, খুন, বিস্ফোরণ, অস্ত্র মামলা রুজু হয়, বিচার চলতে থাকে ২৩ বছর পর তাঁদেরকে নির্দোষ ঘোষণা করা হয়, মধ্যে প্যারোলও দেওয়া হয়নি তাদের। ১৯৮২ সালে প্রেম চাঁদকে গ্রেফতার করা হয়, তার দোকানে হলুদে ভেজাল পাওয়া গিয়েছিল, ১৩ বছর পরে ১৯৯৫ এ তাকে নির্দোষ বলে ছেড়ে দেওয়া হয়, এখানেই শেষ নয়, ২০০৯ এ তাকে সেই অভিযোগেই আবার জেলে পাঠানো হয়, এবং মজার কথা হল ২০২০ তে সুপ্রিম কোর্ট তাকে আবার নির্দোষ ঘোষণা করে ছেড়ে দেয় কিন্তু দ্বিতীয় দফাতেও তার ১১ বছর জেল খাটা হয়ে গেছে। মোট ২৪ বছর জেলের ভাত খাবার পরে সে জানলো, বা বলা ভালো, তাকে জানানো হল যে, সে নির্দোষ। এল এন মিশ্রা, রেলমন্ত্রীকে খুন করা হয় ১৯৭৫ সালে জানুয়ারি মাসে, ২০১৪ ডিসেম্বরে সেই খুনের অভিযুক্তদের দোষী বলে ঘোষণা করা হয়। গত আড়াই বছর ধরে দেশের অধ্যাপক, সাংবাদিক, সমাজকর্মী, আইনজীবী, কবি, সাহিত্যিক জেলে আছেন, ফাদার স্ট্যান স্বামী তো মারাই গেলেন। এটা আমাদের বিচার ব্যবস্থা। লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয় আইন তৈরি করতে, আরও অনেক লক্ষ কোটি টাকা খরচ হয় সেই আইন রক্ষার জন্য বিচার ব্যবস্থা চালাতে, সেই ব্যবস্থা মানুষকে এতটুকু ভরসা যোগাতে অক্ষম, তা আজ পরিস্কার, এখন সে কথা দেশের মুখ্য বিচারপতির গলাতেও শোনা যাচ্ছে।
অন্য আরেক স্তম্ভের মাথার চুল থেকে পায়ের নোখ পর্যন্ত বিকিয়ে গেছে, হ্যাঁ আমি চতুর্থ স্তম্ভের কথা বলছি, যেখানে এই মানুষের, সাধারণ গরীব মানুষের অধিকার রক্ষার কথা বলার কথা এখন তারা হিজ মাস্টারস ভয়েজ, গোলাম হয়ে গেছে। কেউ কেউ বলেন সংবাদ মাধ্যমে এত নেগেটিভ কথা কেন? বিশেষ করে সরকারের বিরুদ্ধে? সরকার কত ভালো কাজও করে, সংবাদ মাধ্যম সেই কথাগুলো বলে না কেন? কি লিবারাল কথাবার্তা, তাই না। ২০১৯-২০২০ এই মোদি সরকার, প্যান্ডেমিকের আগে পর্যন্ত কেবল সরকারি প্রকল্পগুলোর বিজ্ঞাপনে খরচ করেছে ৭০০ কোটির বেশি টাকা, হ্যাঁ ৭০০ কোটিরও বেশি। কার টাকা? আপনার আমার? কেন? সরকার আমাদের জন্য কী কী করেছে তা আমাদের জানানোর জন্য খরচ হচ্ছে। তাহলে সংবাদ মাধ্যম আবার সেই গুলোই ফলাও করে দেখাবে কেন? বরং তাদের দায়িত্ব সেই প্রকল্পে কোথায় কাজ হচ্ছে না, কোথায় দুর্নীতি হচ্ছে সেটা বলার, লেখার তুলে ধরার। কিন্তু মোদিজি তা চান না, চান না বলেই সংবাদ মাধ্যম চালায় এমন কর্পোরেট গ্রুপগুলোকেই তিনি কন্ট্রোল করা শুরু করে দিলেন, ফলে যা হবার তাই হচ্ছে, সংবাদ মাধ্যম এখন রাস্তার ধারে বিলবোর্ডের মত, সরকার কী করিতেছে, প্রধানমন্ত্রী কোন ঘোষণা করিতেছেন তার খবর ছাড়া অন্য খবর দেওয়া বন্ধ করেছে।
তার মানে গণতন্ত্রের যে পরিসরের কথা জাস্টিস রামানা বললেন, সেই বিচার ব্যবস্থা আজ পঙ্গু, সেই বিচার ব্যবস্থা মানুষকে ন্যায় বিচার দিতে অক্ষম, লক্ষ লক্ষ মামলা ঝুলে রয়েছে, বিনা বিচারে জেলে আটক রয়েছে লক্ষ মানুষ, তাদের মধ্যে দোষী যেমন আছে, নির্দোষও আছে। তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ চলতেই থাকে, মানুষ উকিলের ফিজ দিতে থাকে, আদালতের চারপাশে চক্কর কাটতেই থাকে এবং ন্যায় বিচার পায় না, অন্য দিকে তাদের কথা বলার জন্য যে চতুর্থ স্তম্ভের কথা বলা হত, তারা আজ সরকারি প্রকল্পের ঘোষক মাত্র, গণতন্ত্র সব মিলিয়ে এক প্রকান্ড তামাশা হয়ে উঠেছে। এইরকম এক পৃষ্ঠভূমিতে প্রধান বিচারপতি যখন বলেন, কেবল সরকার পাল্টালেই সুদিন আসবে, এটা মনে করার কোনও কারণ নেই, তখন আমাদের বচ্চেলোগ তালি বাজাও বলা ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না।