উকিল জিজ্ঞাসাবাদ আরম্ভ করিলেন,
তোমার নাম কী?
শ্রীকমলাকান্ত চক্রবর্তী।
উকিল। তোমার বাপের নাম কী?
কমলাকান্ত পিতার নাম বলিল। উকিল তখন জিজ্ঞাসা করিলেন,
তুমি কী জাতি?
হিন্দু জাতি।
উকিল। আঃ! কোন্ বর্ণ?
– ঘোরতর কৃষ্ণবর্ণ।
উকিল। দূর হোক ছাই! এমন সাক্ষী আনে? বলি-
তোমার জাত আছে?
কমলাকান্ত – মারে কে?
হাকিম দেখিলেন, উকিলের কথায় হইবে না, বলিলেন,
“ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, কৈবর্ত হিন্দুর নানাপ্রকার জাত আছে, জান তো? তুমি তার কোন্ জাতির ভিতর?”
কমলা৷ ধর্মাবতার! এ উকিলের ধৃষ্টতা দেখিতেছেন, আমার গলায় যজ্ঞোপবীত, নাম বলিয়াছি চক্রবর্তী__ ইহাতেও যে উকিল বোঝেন নাই যে, আমি ব্রাহ্মণ ইহা আমি কী প্রকারে জানিব?
১৮৮২ সালে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের লেখা কমলাকান্তের জবানবন্দি প্রকাশিত হয়েছিল, মানুষজন এই রম্যরচনা পড়ে খুব আমোদ পেয়েছিলেন, হেসেছিলেন, তার বহু কারণের একটা হল বিচার ব্যবস্থা, কাউকে দোষী সাব্যস্ত করার ব্যবস্থা, যা বঙ্কিমচন্দ্র নিজেই ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে প্রত্যক্ষ্য করেছিলেন। আজ ২০২৪, ১৪২ বছর পরে অবস্থাটা কি বদলেছে? তৎকালীন জমিদারের পেয়াদা বা পুলিশ ঠিক যেভাবে নিরপরাধ মানুষকে এনে বিচারের নামে প্রহসন চালিয়েই যেত, এখনও সেই একই পদ্ধতিতে চলছে ইডি, তাদের অভিযোগ আর বিচার। একধারে মিথ্যে অভিযোগ, অন্যধারে বিচারের দীর্ঘসূত্রিতা মানুষের ন্যায় অন্যায়ের বোধকে মূল্যহীন করে তুলছে। আরও অনেক দেরি হওয়ার আগেই আমাদের এই দিকে নজর দিতেই হবে। গত ৫-৬ বছর ধরে ইডির এই ফাংশনিং সব্বার জানা হয়ে গেছে, তারা কোনও একটা অভিযোগে আপনাকে জেলে পুরে রাখবে, এমন এক ধারায় যেখানে আপনাকেই প্রমাণ করতে হবে যে আপনি দোষী নন। আপনি সেই চেষ্টা চালিয়ে যাবেন, বিচার ব্যবস্থা খুব সস্তাও নয়, তার খরচও আকাশছোঁয়া, আপনি জেল আদালত জেল আদালত চক্কর কাটতেই থাকবেন, ইডির উকিলেরা প্রতিদিন কোনও না কোনও অজুহাতে বিচার প্রক্রিয়াকে পিছোতে থাকবে এমনভাবে যেখানে বিচারকেরও খুব একটা কিছু করার থাকবে না আর এটাই এখন নিও নর্মাল। এই একইভাবে আমাদের চ্যানেল সম্পাদককে জেলে পুরে রাখা হয়েছে আজ ৩২৭ দিন হয়ে গেল। প্রতিদিন নিয়ম করে বিচারক ইডিকে বলছেন আপনাদের তথ্য কোথায়? প্রমাণ কোথায়? ইডি বলছেন পরের দিনে, পরের ডেট এলে সেদিনে তদন্তকারী অফিসারই গায়েব, তিনি মেডিক্যাল লিভে। আর সেইজন্যই সেটাই আমাদের বিষয় আজকে।
বৃহস্পতিবারে মামলা চলাকালীন বিচারক বললেন তদন্তকারী সংস্থা গল্প লিখছেন, হ্যাঁ ইডি গল্প বানাচ্ছে, সেই কথা বিচারক নিজেই বললেন।
বিচারক বলছেন – হাইকোর্টের রায় থেকে এটা পরিষ্কার যে রায়ের সময়কালে তদন্ত শেষ হয়নি। নির্দিষ্ট কয়েকটি প্রশ্নের যুক্তিসঙ্গত জবাব প্রয়োজন।
১. কলকাতা হাইকোর্ট কৌস্তুভ রায়ের জামিন খারিজ করার পর ইডি কেমন তদন্ত করেছে? কী পেয়েছে?
২. নির্দিষ্টভাবে দেখাতে হবে যে, অভিযুক্ত প্রসিডস অফ ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অর্থাৎ পঞ্জি ব্যবসার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল।
৩. নেওয়া টাকা কেউ ফেরত দিলে সেটা কীভাবে প্রসিডস অফ ক্রাইম হতে পারে?
ইডির তরফের উকিল – বিষয়টায় আমি আসছি। তার আগে বলি যে দুটো লেজার থেকে দেখা যাচ্ছে যে কিছু অবৈধ লেনদেন হয়েছে। ট্যাম আর বার্কের সার্টিফিকেটে আমি দেখেছি ডেট টাইম আছে। সেটার বিলের সঙ্গে কোনও সামঞ্জস্য নেই। তার কয়েকটা উদাহরণ লিখিতভাবে আদালতের কাছে পেশ করলাম।
বিচারক বলছেন – বিলের সঙ্গে ট্যাম আর বার্কের সময়ের বিষয়টা কীভাবে ম্যাচ করাবেন? আমি আপনার কাছে পরিষ্কার জানতে চাইছি যে এই ব্যক্তি জেনেশুনে প্রসিডস অফ ক্রাইমের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন কি না? আপনি ২টো লেজার পাচ্ছেন। আপনাকে মনোরঞ্জন একটা লেজার দিয়েছে। কৌস্তুভ রায় একটা লেজার দিয়েছে। আপনাকে তদন্ত করে দেখতে হবে, অডিট করাতে হবে। আপনার তদন্তকারী অফিসার যদি দুটো লেজার নিয়ে বসে থাকে এবং তদন্তকারী সংস্থা গল্প লিখেই যায়, তাহলে সেটা থেকে রেজাল্ট কী করে আমি বুঝব?
আরও পড়ুন: Aajke | এগজিট পোল আর সোশ্যাল মিডিয়ার প্রচার যে সামাজিক ক্ষত তৈরি করছে তা মারাত্মক
কাজেই আবার সময়, আবার ডেট আবার সেদিন তদন্তকারী অফিসার হয় থাকবেন না নাহলে আবার একটা অজুহাত খাড়া করা হবে। ১৪২ বছর আগে এক সাক্ষী অন্তত মুখের উপর বলতে পেরেছিল, বিচারালয়ের বিচার শুরুই হয় মিথ্যে দিয়ে, আজ অভিযুক্ত প্রতিদিন সেই কথাই বলে চলেছেন মেহের আলির মতো, তফাত যাও সব ঝুট হ্যায়। বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় মনে পড়ে যাচ্ছে।
রাজা আসে যায় আসে আর যায় / শুধু পোশাকের রং বদলায়
শুধু মুখোশের ঢং বদলায়
পাগলা মেহের আলি / দুই হাতে দিয়ে তালি
এই রাস্তায়, ওই রাস্তায় / এই নাচে ওই গান গায় :
“সব ঝুট হ্যায়! সব ঝুট হ্যায়! সব ঝুট হ্যায়! সব ঝুট হ্যায়!”
জননী জন্মভূমি! সব দেখে সব শুনেও অন্ধ তুমি!
সব জেনে সব বুঝেও বধির তুমি!
তোমার ন্যাংটো ছেলেটা / কবে যে হয়েছে মেহের আলি,
কুকুরের ভাত কেড়ে খায় / দেয় কুকুরকে হাততালি…
তুমি বদলাও না ; সে-ও বদলায় না!
রাজা আসে যায় রাজা বদলায়
নীল জামা গায় লাল জামা গায়
এই রাজা আসে ওই রাজা যায়
জামা কাপড়ের রং বদলায়… দিন বদলায় না!
আজ কেবল ন্যাংটা ছেলেটাই নয়, মোদি-শাহের ব্যবস্থায় সারা দেশের প্রত্যেকটা মানুষ পাগল, প্রতিটা মানুষ অসহায়, বিচারের জন্য হাপিত্যেশ বসে থাকে, বলে তফাত যাও সব ঝুট হ্যায়।
আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাদের চ্যানেল সম্পাদক আজ ৩২৭ দিন হয়ে গেল ইডির অভিযোগে জেলে, তাঁর বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ প্রমাণিত হওয়া তো দূরস্থান, একটা প্রমাণও হাজির করা হয় নি, এই ইডি সি বি আই ইত্যাদি এজেন্সিগুলো কি বিরোধীদের চুপ করানোর জন্যই কাজ করছে? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
গোয়েবলস বুঝিয়েছিল মিথ্যে নয়, কেবল মিথ্যে নয়, বড় মিথ্যে বলো, বিগ লাই, এতবড় মিথ্যে যে মানুষের বুঝে উঠতেই সময় কেটে যাবে, সেটাই বলেছেন কৌস্তুভ রায় বৃহস্পতিবার আদালতে, এত বড় আর বিভ্রান্তিকর এই মিথ্যে যে কেবল সেই মিথ্যে অভিযোগের ভিত্তিতে জেলেই আছেন তিনি ৩০০ দিনের বেশি। একজন জেলে আছেন? দু’জন মারা গেছেন, পাঁচ জন ১০ বছর পরে জামিন পেলেন, এগুলো বড় বিষয় কিন্তু এটার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ হল এটাই যদি দেশের আইন বিচার ব্যবস্থা হয় তাহলে মানুষ সেই আইনের শাহনকে অস্বীকার করবে, মানুষ নৈরাজ্যবাদে বিশ্বাস করবে। এমনি এমনিই পৃথিবীতে নৈরাজ্যবাদের জন্ম হয় না, আইনের শাসন ভেঙে পড়লেই নৈরাজ্যবাদের জন্ম হয়, সেই নৈরাজ্যবাদ ছড়িয়ে পড়ার আগে মানুষের হুঁশ ফিরেছে, পরাস্ত হয়েছে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকার, এবার কিছু সময়ের অপেক্ষা, বাকি ব্যবস্থাতেও তার প্রভাব পড়বে।