জায়গা বুঝে মোদিজি নানা কথা বলেন। ধরুন বিহারে গেলেন উনি, আমি নিশ্চিত বক্তৃতা দিতে উঠে তিনি বলবেন বিহারের সঙ্গে আমার পুরানা রিস্তা হ্যায়, সেই যে জয় প্রকাশজি, কিতনা কুছ শিখা উনসে, উনি নাকি জয়প্রকাশ নারায়ণের পদপ্রান্তে বসে অনেক কিছু শিখেছেন। ১০০ শতাংশ গুল। তারপর ধরুন গোয়াতে গেছেন, আমি নিশ্চিত উনি বলবেন গোয়ার সঙ্গে ওনার পুরানা রিস্তা, সে ক্যাথিড্রাল মে যা কর মুঝে সুকুন মিলতা হ্যায়, শান্তি পাই, ইয়াহা কে সমন্দর সে মুঝে পুরানা রিস্তা হ্যায়। বাংলায় এসে তো পরজনমের ইচ্ছেও জানিয়ে গেছেন। বলেছেন, পরজন্মে নাকি এই বাংলাতেই জন্মাতে চান। জানেন না যে বাঙালি হলে হয় ইলিশ নয় চিংড়ি নয় দুটোই আর মাটন বিরিয়ানি তো মাস্ট। তো সেই মোদিজি কথায় কথায় মাতৃশক্তি কথাটা খুব ব্যবহার করেন, থেকে থেকেই মাতৃশক্তি। দেশ কি মাতৃশক্তি অব চল পড়া হ্যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। খুব জেনেবুঝে উনি কিছুই বলেন না, এটাও সেই না বুঝেই বলা একটা কথা, কিন্তু এবারে সেই মাতৃশক্তি যে সত্যিই চল পড়া হ্যায়, সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পাবেন। গতবার সংসদে ৭৮ জন মহিলা সাংসদ ছিলেন এবারে সংখ্যাটা একটু কমে ৭৩ হয়েছে। কিন্তু যাঁরা এসেছেন তাঁরা মোদিজির ঘুম কেড়ে নেবার জন্য যথেষ্ট। ওয়েনাড় থেকে প্রিয়াঙ্কা গান্ধী যে জিতবেনই তা নিয়ে বলার কিচ্ছুটি নেই। সম্ভবত রাহুলের চেয়ে বেশি মার্জিন নিয়েই জিতবেন। তাহলে তালিকাটা বানিয়ে ফেলা যাক, কংগ্রেসের প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, বর্ষা গায়কোয়াড় মুম্বইয়ের ধারাভি থেকে জিতেছেন, তুখড় বক্তা, এনসিপির সুপ্রিয়া সুলে, বলতে শুরু করলে বিজেপি হল্লা ব্রিগেডও থেমে যায়। আরজেডির মিশা ভারতী, সমাজবাদী দলের ডিম্পল যাদভ আর ২৫ বছর বয়সী প্রিয়া সরোজ আর বছর ২৯-এর কৈরানার ইকরা চৌধুরি, দুজনের বক্তৃতা শোনার মতন এবং অবশ্যই তৃণমূলের মহুয়া মৈত্র, তিনি তো মুখিয়েই আছেন। ওদিকে আছেন কঙ্গনা রানাওয়ত, প্রচুর হাস্যরসের জোগান দেবেন, আছেন হেমা মালিনী, কী বলেন তা বোঝাই যায় না, ছিলেন স্মৃতি ইরানি, এবারে হেরেছেন। মানে মোদিজির বিরুদ্ধে যে মহিলা ব্রিগেড তাদের সরব উপস্থিতি এবার সংসদ মাতাবে। এবং আপনাদের মনে থাকার কথা গত লোকসভাতেই মহিলা সংরক্ষণ বিল পাশ হয়েছিল, যদিও তা ছিল এক দিল্লি কা লাড্ডু, তার কথা একটু বলে নেওয়া যাক, কারণ এক মাতৃশক্তির কাছে ওই মহিলা সংরক্ষণ বিল যে এক বিরাট ইস্যু হবে তা বলাই বাহুল্য। সেই দেবেগৌড়া প্রধানমন্ত্রী হলেন, তাঁর ছোট্ট টেনিওরে তাঁর আইনমন্ত্রী রমাকান্ত ডি খালাপ প্রায় অবাক করে দিয়েই ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৯৬-এ সংসদে এই বিল আনেন। বিলটাকে প্রবল বিরোধিতার পরে তখনকার সিপিআই সাংসদ গীতা মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে ৩১ জনের এক যৌথ সংসদীয় কমিটির কাছে পাঠানো হয়। কমিটিতে ছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুমিত্রা মহাজন, মীরা কুমার, সুষমা স্বরাজ, উমা ভারতী, গিরিজা ব্যাস, রামগোপাল যাদব, নীতীশ কুমার, শরদ পওয়ার প্রমুখ নেতারা। এই কমিটির কেউই এই বিলের বিরোধিতা করেননি, তাঁরা বেশ কিছু পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন। প্রথম কথাটাই ছিল ওই মিনিমাম লেস দ্যান ওয়ান থার্ড-এর বদলে পরিষ্কার ওয়ান থার্ড রিজার্ভেশনের কথা বলা হোক। বিলে লোকসভা, বিধানসভায় রিজার্ভেশনের কথা বলা হয়েছিল, কমিটির রায় ছিল এমনকী রাজ্যসভা, বিধান পরিষদেও এই রিজার্ভেশন দিতে হবে। এই কমিটিই জানিয়েছিল যে আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটির কোটার মধ্যেই ৩৩ শতাংশ ওই আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটির মহিলাদের জন্য রাখা হোক। লালু, নীতীশ, মুলায়মরা এটাই চাইছিলেন। সেদিন ওই কমিটিই জানিয়েছিল, এই রিজার্ভেশন আগামী ১৫ বছরের জন্য করা হোক, তারপর প্রয়োজন মতো তা সংশোধন করা যাবে। ১৯৯৬-এর ডিসেম্বর মাসে এই কমিটি রিপোর্ট দেয়, কিন্তু নীতীশ কুমার, শরদ যাদব ইত্যাদিরা ওই আদার ব্যাকওয়ার্ড কমিউনিটির বিষয় নিয়ে আপত্তি জানাতে থাকেন, তাঁদের বক্তব্য ছিল কেবল মহিলা রিজার্ভেশন বিল আনলে কিছু শিক্ষিত শহরের মহিলারাই জায়গা পাবেন।
এইসবের মধ্যেই সরকার পড়ে গেল, নটে গাছটি মুড়োল। ৯৬-এর পরে আবার এই বিল এল কবে? ১৯৯৮, ৯৯, ২০০০, ২০০৩-এ বাজপেয়ী সরকারের আমলে। বহুবার তাঁরা বিল আনার চেষ্টা করেছেন, তাঁদের দলের মধ্যেই প্রবল বিরোধিতা ছিল, বিরোধিতা ছিল শরিক দলের তরফে এবং সমাজবাদী দল, বিএসপির বিরোধিতার কারণেই বিল পাশ হয়নি, বিল ঠান্ডা ঘরে চলে গেছে। ১৯৯৮-এ আইনমন্ত্রী থাম্বিদুরাই বিল পেশ করার পরে সংসদের ওয়েলে নেমে আসেন আরজেডি আর সমাজবাদী দলের সদস্যরা, একজন আরজেডি সদস্য সুরেন্দ্র প্রসাদ যাদব লোকসভা স্পিকার বালাযোগীর হাত থেকে বিল কেড়ে ছিঁড়ে ফেলে দেন, উনি পরে বলেছিলেন এটা নাকি তাঁকে বাবাসাহেব আম্বেদকরা স্বপ্নে আদেশ দিয়েছিলেন। এরপরে আবার সেই বিল এসে হাজির হল ২০০৮-এ মনমোহন সিং সরকারের সময়, এবারে বিজেপি দলের মধ্যেই আদিত্য যোগী গোছের কিছু মানুষের বিরোধিতার পরেও বিজেপি, কংগ্রেস, নীতীশ কুমার ইত্যাদির সমর্থনে এই বিল রাজ্যসভাতে পাশ হয়ে গেল, কিন্তু ঝামেলা কম হয়নি। আইনমন্ত্রী এইচ আর ভরদ্বাজের হাত থেকে আবার বিল কাড়ার জন্য তাঁর সামনে চলে যান এসপি সাংসদ আবু আজমি, কংগ্রেসের রেণুকা চৌধুরি ইত্যাদিরা মন্ত্রীর সামনে এসে দাঁড়ান। কিন্তু এই বিল লোকসভায় পাশ করানো যায়নি, পড়েছিল, এবং তার স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে মনমোহন সরকারের পতনের পর। এবার মোদিজি এলেন। কেউ একদিনের জন্যও এই উইমেন রিজার্ভেশন বিল নিয়ে একটা কথাও শোনেননি, সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো সেই ২০১৪তেই ছিল, ২০১৯-এ আবার আরও বড় সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়েই ফিরেছিল মোদি সরকার। না, বিল আনা হয়নি। ২০২৩-এ এসে হঠাৎ মোদিজির মনে হল ভগবান তাঁকে দিয়েই নারী সংরক্ষণ বিলটা পাশ করিয়ে নিতে চান, তাই বিল এসেছে। প্রায় হুবহু গীতা মুখার্জি কমিটিতে যা যা বলা হয়েছিল, সেগুলোই আছে এই বিলে, কিন্তু নতুন দুটো কথা এই বিলে আছে। প্রথম কথাটা হল লোকসভা আসনের ডিলিমিটেশনের আগে এই সংরক্ষণ কার্যকর হবে না, দ্বিতীয় কথাটা হল ওই ডিলিমিটেশনের জন্য জনগণনা আবশ্যিক। তার মানে বিল পাশ হয়ে গেলেও তা এখনই লাগু হবে না। কেন? কারণ আগে জনগণনা করাতে হবে, এতদিন হয়নি কেন? প্রথমে কোভিডের কারণে ২০২০তে জনগণনা হয়নি, তারপর এই জনগণনার সঙ্গেই এনআরসি-কে জোড়ার তালে আছে বিজেপি, সেটার সুযোগ তাঁরা পাননি, আপাতত তা হবে না। নতুন সরকার এসে জনগণনা করবে, সেখানেও সমস্যা আছে, বিরোধীদের দাবি, জাতিভিত্তিক জনগণনা করতে হবে ইত্যাদি।
আরও পড়ুন: Fourth Pillar | ২০২৪ এর পরে কোন কোন দলের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠল?
এরপরের সমস্যা হল ডিলিমিটেশন। কিসের ভিত্তিতে এই ডিলিমিটেশন হবে? সংখ্যার ভিত্তিতে? মানে যে রাজ্য, বিহার বা উত্তরপ্রদেশ বা মধ্যপ্রদেশে কেরালা, কর্নাটক, তামিলনাড়ু বা বাংলার চেয়ে জনসংখ্যা বেশি, সেখানে বেশি সাংসদ থাকবে? তার মানে দেশ চালাবে ইউপি, বিহার, মধ্যপ্রদেশ, কাউ বেল্টের মানুষজন? দক্ষিণের মানুষ এটা মেনে নেবেন? এই বাংলার মানুষ এটা মেনে নেবেন? মানে সেখানেও প্রচুর ঝামেলা আছে। কাজেই সেই ঝামেলার মধ্যেই পড়ে থাকবে এই নারী সংরক্ষণ বিল। কিন্তু কেন? এই ক্লজ দেওয়া হল কেন? কেন ২০২৪ থেকেই এই বিল কার্যকর করা হবে না? অসুবিধে কোথায়? যখন জনগণনা হবে, তখন তার ভিত্তিতে হবে, ডিলিমিটেশন হবে, তখন তার ভিত্তিতে আবার নতুন করেই হবে। সব দল রাজি ছিল কিন্তু এই ডিলিমিটেশন ইত্যাদির নাম করে এই সংরক্ষণ বিলকে ঝুলিয়ে রাখা হল কেন? কারণ বিজেপি তৈরি নয়, ভারত জুড়ে প্রায় ১৭০-১৮০ জন মহিলা প্রার্থী তাঁদের দাঁড় করাতে হবে, কোথা থেকে আসবেন তাঁরা? বিজেপি ২০২৪-এ ৬৯ জন মহিলা প্রার্থী দাঁড় করিয়েছিলেন, আর এই ১৭০-১৮০ জন মহিলা প্রার্থী দিতে গিয়ে তাঁদের বাহুবলীরা যদি বাদ পড়েন, তাহলে নির্বাচন সামলাবে কে? কাজেই বিল আনা হল, নির্বাচনের আগে ধামাকা, নির্বাচনের আগে এক অপটিকস, দেখুন আমরা মহিলা সংরক্ষণ বিল আনলাম, সেটাও হল আবার ডিলিমিটেশন ইত্যাদির কথা বলে বিল কার্যকরও হল না, মোদি স্টাইল পলিটিক্স। নারী সংরক্ষণ বিল তো এনেছে, পাশও করিয়েছে বিজেপি, কিন্তু বাহুবলী ব্রিজভূষণ সিংকে কি গ্রেফতার করা গেছে? উল্টে তাঁর ছেলেকে জিতিয়ে আনা হয়েছে। বিলকিস বানোর ধর্ষকদের জেল থেকে আগাম ছেড়ে দিয়ে মিষ্টি খাওয়ানো, মালা পরানো হয়নি? হাথরসের ধর্ষকদের সমর্থনে বিজেপি কি মিছিল করেনি? মণিপুরে ধর্ষিতা নারীকে উলঙ্গ করে প্যারেড করানো কি মানুষ ভুলে যাবে? শিশুদের অপুষ্টি, গর্ভবতী মহিলাদের অপুষ্টি রেকর্ড ছুঁয়েছে, এই সত্য কি ঢাকা যাবে? উজ্জ্বলা সিলিন্ডারের নামে আবার ধাপ্পা কি নারীরা বুঝতে পারবে না? মোদিজি নিজের, সরকারের ইমেজ ঠিক করার জন্য একটা বিল পাশ করিয়েছেন সত্যি, কিন্তু সেই মোদিজিই তো দেশের প্রথম আদিবাসী মহিলা রাষ্ট্রপতিকে নতুন সংসদ ভবনের উদঘাটন থেকে প্রথম দিন পর্যন্ত দূরে রাখলেন, তাঁকে ডাকাও হল না।
এটাই মোদিজির নারী সম্পর্কে ধারণা, আসলে এক মনুবাদী নারী সম্পর্কে তাঁর ধারণা লুকোতে চাইছেন, যে মনু সাফ জানিয়েই গেছেন নারী হল নরকের দ্বার। মোদিজি সেটাই মনে করেন, করেন বলেই নির্লজ্জভাবে বিবাহিত স্ত্রীকেও মর্যাদা দেবার সাধারণ ভদ্রতা দেখাতে পারেন না, যেটা করছেন তা হল বিশুদ্ধ নৌটঙ্কি। কিন্তু এবারে সেই সমস্যা এক্কেবারে ঘাড়ের উপরে, দুটো বিষয় এবারে সংসদে শুরু থেকেই বিজেপিকে পিছনে ঠেলে নিয়ে যাবে, প্রথমটা হল কৃষকদের এমএসপি নিয়ে বিল আর এই মহিলা সংরক্ষণ বিল। এই দুটো জায়গাই বিজেপির কাছেই কেবল নয় দেশের মানুষের কাছেও এক বিরাট ব্যাপার। তাই বলছিলাম, মোদিজি যখন সংসদে আসবেন, এবারে না এসে পারবেন না কারণ বিরোধীদের বিরাট উপস্থিতি, যখন আসবেন, আমার ধারণা তার আগে সিসিটিভিতে চেক করবেন মাতৃশক্তিদের কে কে আছেন সংসদ ভবনে। মহিষাসুর বর চেয়েছিলেন দেবতা, নর, বানর যেন আমায় হত্যা না করতে পারে, মহিষাসুর বধ হয়েছিলেন দুর্গার হাতে, তিনি ভাবতেই পারেন নি এক নারী তাঁকে যুদ্ধে পরাস্ত করবেন।