তৃণমূলের শ্লোগান ছিল বদলা নয় বদল চাই, মানুষ সেই শ্লোগানকে সমর্থন করেছিল। যদিও খুব বিশ্বাস করেছিল বলে আমাদের মনে হয় না কারণ আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এক ধরণের হিংসা আজ নয়, স্বাধীনতার আগে থেকেই রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংগ হয়ে গেছে। সেই কবে কমিউনিস্ট পার্টির কর্মী কবি সোমেন চন্দ কে ফরোয়ার্ড ব্লকের কর্মীরা মিছিলের মধ্যেই কুপিয়ে খুন করেছিল, নেতাজীর অনুগামীরা শ্যামাপ্রসাদের মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিল ইঁট ছুঁড়ে, কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা ফরোয়ার্ড ব্লকের নেতা কর্মীদের ফিফথ কলাম তকমা দিয়ে পুলিশের কাছে ধরিয়ে দিয়েছেন আর স্বাধীনতার পরে কত শত হিংসার ঘটনা। কির্ণাহারে এক ব্রাহ্মণ ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের নির্বাচিত নেতার টিকি কেটে নিয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির কর্মীরা, তিনি ছিলেন আমাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতির প্রণব মুখার্জির বাবা। তারপর সি পি এম সি পি আই, সি পি এম সি পি আই এম এল তো এক রক্তাক্ত অধ্যায়, এ দল সে দলকে পাড়াছাড়া করেছে, কুপিয়ে মেরেছে, সর্বজনশ্রদ্ধেয় ফরোয়ার্ড ব্লক নেতা হেমন্ত বোস কে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন করা হয়েছে, সাইঁবাড়ির ঘটনা সব্বার জানা, বিপ্লবীরা ছেলের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল মায়ের ভাতের থালায়, বলা হয়েছিল শ্রেণী ঘৃণা। জরুরি অবস্থা আলাদা কিছু ছিল না, এরপর বাম জামানা। তখন হিংসা রবিঠাকুরের ভাষায়
কে বা ভ্রাতা, কে বা আত্মপর!
কে বলিল হত্যাকাণ্ড পাপ!
এ জগৎ মহা হত্যাশালা। জানো না কি
প্রত্যেক পলকপাতে লক্ষকোটি প্রাণী
চির আঁখি মুদিতেছে! সে কাহার খেলা?
হত্যায় খচিত এই ধরণীর ধূলি।
প্রতিপদে চরণে দলিত শত কীট–
তাহারা কী জীব নহে? রক্তের অক্ষরে
অবিশ্রাম লিখিতেছে বৃদ্ধ মহাকাল
বিশ্বপত্রে জীবের ক্ষণিক ইতিহাস।
হত্যা অরণ্যের মাঝে, হত্যা লোকালয়ে,
হত্যা বিহঙ্গের নীড়ে, কীটের গহ্বরে,
অগাধ সাগর-জলে, নির্মল আকাশে,
হত্যা অকারণে, হত্যা অনিচ্ছার বশে–
চলেছে নিখিল বিশ্ব হত্যার তাড়নে
ঊর্ধ্বশ্বাসে প্রাণপণে, ব্যাঘ্রের আক্রমে
মৃগসম, মুহূর্ত দাঁড়াতে নাহি পারে।
প্রতিটা পাড়ার ব্রাঞ্চ সেক্রেটারি, লোকাল কমিটি সেক্রেটারি কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া এক লাগাম ছাড়া হিংসার আগাড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সেই জামানার শেষে যখন শ্লোগান এল বদলা নয় বদল চাই তখন আমরা পুলকিত হয়েছিলাম বটে কিন্তু খুব বেশি ভরসাও ছিল না। আজ সেই শ্লোগানই আমাদের বিষয় আজকে, বদলা নয় বদল, শ্লোগান থেকে সরে আসছে তৃণমূল?
সেই শ্লোগান দেওয়ার পর থেকে নেত্রীর গলায় সেই কথা আমরা বহুবার শুনেছি, ইদানিং অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখেও শুনেছি কিন্তু বাস্তবে? না, তলার সারির কর্মীরা একইভাবে পিটিয়েছে, মেরেছে, আগুন লাগিয়েছে, একবার নয় বহুবার, নির্বাচনের সময়, নির্বাচনের পরে খুনোখুনিতে তৃণমূলের কর্মীরা হাত গুটিয়ে বসে তো ছিল না। কিন্তু সেসবের পরেও নেত্রীর মুখ থেকে বদলার কথা শোনা যায় নি। গতকাল শোনা গ্যালো, সাফ জানালেন আমাদের চার জন কে জেলে পুরলে আমরা ওদের ৮ জনকে জেলে পুরবো। মানে এবার বদলা হবে? আমরা এর আগে বলেছিলাম, সমস্ত সাংবিধানিক রীতি নীতি ভুলে, সাধারণ শিষ্ঠাচারের কণামাত্র না রেখে বিজেপি যে ভাবে সাংবিধানিক প্রপ্তিষ্ঠাগুলোকে ব্যবহার করা শুরু করেছে তা তাদের পক্ষে একদিন ব্যুমেরাং হয়ে দাঁড়াবে। বিরোধী দল যেখানে ক্ষমতায় সেখানে তাদের পূর্ণ শক্তি, প্রশাসনিক শক্তি তারা প্রয়োগ করতে শুরু করবে বিজেপির ওপর, অন্য বিরোধী দলের ওপর। সেটাই হতে চলেছে। কেরালা, তামিলনাড়ু, বিহার, বাংলা প্রত্যেক রাজ্য থেকে এইরকম ইঙ্গিত আসা শুরু হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য এ এক অত্যন্ত চিন্তার বিষয়, আমি ইডি পাঠাবো, তাহলে উনি সি আই ডি পাঠাবেন, এক অরাজক অবস্থার জন্ম হবে। কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাল সেই কথাই কি বলতে চাইলেন? টিট ফর ট্যাটই যদি করতে হয়, বদলাই যদি নিতে হয়, তাহলে রঘু ডাকাতের মত জানান দেওয়ার দরকার আছে কী? না, এতটা কাঁচা ঘুটি মমতা চালেন নি। তিনি গতকাল আসলে আগামী ২০২৪ এর নির্বাচনের মূল সুরটা বেঁধে দিলেন, আমাদের লড়াই বিজেপির সঙ্গে, বাকিরা দুধুভাতু, বাকিরা এলেবেলে, তীব্র বিজেপি বিরোধী মুসলমান ভোট কে নিজের দিকেই নিয়ে আসার চেষ্টা আর ঐ দুধুভাতু সিপিএম যদি কিছু তৃণমূল্বিরোধী ভোট পায় তো পাক, তা তো আরও ভালো। অন্যদিকে খেয়াল করুন একতাও শব্দ নেই কংগ্রেসের বিরুদ্ধে, ইসারা কাফি হ্যায়, এই মেসেজ এই মূহুর্তে কংগ্রেসের কিছু রাজ্য নেতা রাহুলের কাছে পৌঁছে দেবে, কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়া হলে বিজেপি ২/৩, সিপিএম অনন্ত শূন্য, কংগ্রেস ৩ আর তৃণমূল ৩৫/৩৬ টা আসন পাবে। মানে এর পরের বারের লোকসভাতে হতেই পারে তৃতীয় বৃহত্তম দল। এতকিছু হিসেব করেই গতকাল মমতা বলেছেন ওরা ৪ জন ভরেছে আমরা ৮ জনকে জেলে পুরবো। সেরকম কিছু করা হচ্ছে না তাও নয়, আর করতে হলে এত হাঁক দাক দিয়ে বলার মত কিছু নয়, এটা উনি বিলক্ষণ জানেন। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেষ করেছিলাম, ৪ জনের বদলে ৮ জনকে জেলে পোরার হুমকি দিলেন মূখ্যমন্ত্রী, তারমানে কি তৃণমূল বদলা নয় বদল চাই শ্লোগান থেকে সরে আসছেন? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
৩ ডিসেম্বার নির্বাচনের ফল বের হবে, সেদিন থেকেই শুরু হয়ে যাবে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের প্রস্তুতি, প্রচার আর জোটের হিসেব নিকেশ। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর দলের নেতাদের ডেকে একটা কথা সাফ বুঝিয়ে দিলেন পার্থ, কেষ্ট, বালু, জেলে থাকা প্রত্যেক নেতার সঙ্গেই দল আছে, মহুয়া মৈত্রের সঙ্গে দল আছে, দলের কোনও নেতা যেন অসহায় বোধ না করে, তিনি কংগ্রেস নিয়ে কথা না বলে রাহুল সোনিয়ার কাছে মেসেজ পাঠালেন, বক্তৃতার সিংহ ভাগ মোদি শাহের বিরুদ্ধে নিয়ে গিয়ে নিজের বিজেপি বিরোধিতার জায়গাটা স্পষ্ট করলেন আর সি পি এম কে দু চার কথা বলে তারা যে দুধুভাতু, এলেবেলে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনও জোট ইত্যাদি নয়, সেটাও বুঝিয়ে দিলেন। গতকালের তৃণমূলের বৈঠক ছিল লোকসভা নির্বাচনে কী করিতে হইবে, তা বোঝানোর বৈঠক।