বামেরা হতাশ হবেন, বা আরও ভালো করে বলা যাক সিপিএম খানিক হতাশ। গত বেশ কিছু নির্বাচনে এক ধরনের বোঝাপড়া হওয়ার পরে এখন রাজনৈতিক চালচিত্রের ছবি আমূল পাল্টে গেছে। তিন রাজ্যে বেদম হার কংগ্রেস নেতৃত্বকে বুঝিয়ে দিয়েছে আসন ভাগাভাগি না হলে তারা হারবে, তাদের সাংসদ কমবে কেবল তাই নয়, বিজেপি বাড়বে, কারণ তাঁরা বিজেপির সঙ্গে একলা মুখোমুখি হলেই বিজেপি বাপি বাড়ি যা বলে তাদের মাঠের বাইরে বার করে দিচ্ছে। কেই বা ভেবেছিল ছত্তিশগড়ে অমনভাবে হারবে কংগ্রেস? মধ্যপ্রদেশে জিতব, কমলনাথ তো কে কে মন্ত্রী হবেন তাও ঠিক করে ফেলেছিলেন। তিন রাজ্যের হার তাদের সামনে বাস্তব ছবিটা তুলে ধরেছে, আর সেই কারণের তড়িঘড়ি করে ইন্ডিয়া জোটের বৈঠক ডেকে বসলেন এবং আবার ভুল করলেন। বুঝতে পেরেই রাহুল গান্ধী নিজেই ফোন করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে। কোর্স কারেকশন চলছে। বিভিন্ন দুতিয়ালি শুরু হয়েছে, নিজেদের মধ্যে কথাও বলা শুরু হয়েছে। এ রাজ্যের দাবি নিয়ে হোক আর তৃণমুল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের সাংসদ পদ খারিজ করার ব্যাপারই হোক কংগ্রেস সর্বশক্তি নিয়ে আপাতত তৃণমূলের পাশে। ভাবা যায়! স্বয়ং সনিয়া গান্ধী সংসদের বাইরে গান্ধীমূর্তির তলায় দাঁড়িয়ে, সামনে মিডিয়াকে বাইট দিচ্ছেন মহুয়া মৈত্র। এবং এই সবের মধ্যে যে কথাবার্তা শুরু হয়েছে তার নিট ফল এ রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল আসন সমঝোতা, আগামী ইন্ডিয়া জোটের বৈঠকে যে বোঝাপড়ার ওপরে সরকারিভাবে সিলমোহর পড়বে। ফরমুলা ৩–৩০ না ৪–৩৮, সেটাই দেখার। কিন্তু এ রাজ্যে কংগ্রেস-তৃণমূল আসন সমঝোতা প্রায় নিশ্চিত। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, লোকসভার নির্বাচনে কংগ্রেস-তৃণমূল আসন সমঝোতা হচ্ছে।
ইন্ডিয়া জোট শুরু হয়েছিল বেশ পাড়া কাঁপিয়ে। শুরুতেই শোনা গিয়েছিল, বেশিরভাগ আসনে একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থী দিয়ে বিজেপিকে ২৩০-২৪০-এর মধ্যে রাখার চেষ্টা করা হবে, এবং অঙ্কের হিসেবে সেটা অসম্ভবও নয়। অন্য দিকে রাহুল সবে শেষ করেছেন ভারত জোড়ো যাত্রা, দাড়ি কেটেছেন বটে কিন্তু সেই যাত্রা থেকে উঠে আসা কিছু কথা দেশের শিক্ষিত গণতান্ত্রিক, উদার মানুষজনদের ছুঁয়ে গেছে। হঠাৎ তাঁরা নবকুমারের মতো পথ হারাইলেন, উগ্র হিন্দুত্বের বদলে এক সফট নরম নরম হিন্দুত্ব নিয়ে মাঠে নামলেন, যে মাঠে মারাদোনারা ঘুরে বেড়াচ্ছে, এবং রাম ধাক্কা খেয়েই বুঝতে পেরেছেন জোট দরকার, হুঁশ ফিরেছে। এ রাজ্যে কংগ্রেস আর তৃণমূলের জোট কংগ্রেসকে নিশ্চিত অন্তত তিনটে আসনের হদিশ দিতে পারে। অন্যদিকে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে রাজ্যের মুসলমান ভোটের সমর্থন ধরে রাখতে পারবে তৃণমূল এটাই তো হিসেব। বিজেপির আসন কমানোই তো হিসেব।
আরও পড়ুন: বাংলার মাটি, বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল…
কিন্তু এতদিন ধরে যাবতীয় তত্ত্বকথা তাকে তুলে এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে ছিল সিপিএম। সেই জোট নিয়ে দলের বিভিন্ন মহলে, বিভিন্ন নেতাদের ভিন্ন মতামত তো ছিল আমরা জানি, জানিই তো যে রাজনৈতিক বাস্তবতা মেনেই যে দলকে কেরলে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে লড়তে হয়, সে দলের পক্ষে আরেক রাজ্যে সেই কংগ্রেসের সঙ্গেই জোট বাঁধাকে তত্ত্ব হিসেবে দাঁড় করানোটা ভারি মুশকিল। কিন্তু তাও চলছিল, সেই সেলিম সুজন শমীকরা এই সিদ্ধান্তের খবর রাখেন না তাও নয়। ওদিকে ফরোয়ার্ড ব্লকের এক অংশ মমতার সঙ্গে অন্তত একটা আসনের বিনিময়ে সমঝোতা করার কথা ভাবছেন কিন্তু এই মুহূর্তে সেটা তৃণমূল নেত্রী মেনে নেবেন বলে তো মনে হয় না। কাজেই সেই অর্থে সিপিএম-এর নেতৃত্বে বামফ্রন্টের সঙ্গে ওই আব্বাস সাব্বাস ছাড়া আর কোনও ভরসা তো দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু নওসাদ সিদ্দিকি বলেছেন বামেরা ইন্ডিয়া জোটে থাকলে কোনও আসন সমঝোতা সম্ভব নয়, কাজেই সেখানেও অসুবিধে। এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট হোক বা না হোক ইন্ডিয়া জোট ছেড়ে বামেদের পক্ষে বের হওয়া অসম্ভব। সব মিলিয়ে অন্তত এ রাজ্যে বামেরা আবার এক বড় ধাঁধার সামনে দাঁড়িয়ে যার সমাধান তাদের জানা নেই। কেবল বাংলাতেই নয় দিল্লি, পঞ্জাব, গুজরাতে আপের সঙ্গেও কথা হচ্ছে। মহারাষ্ট্রে জোট হবেই, বিহারেও হচ্ছে, তামিলনাড়ুতে জোট হচ্ছে, আরও কিছু দলকে কিছু আসন ছেড়ে দেওয়ার কথাও জারি আছে। এই ১৯ তারিখে বৈঠকে এই আসন সমঝোতা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য একটা কমিটিও তৈরি হবে। সব মিলিয়ে ইন্ডিয়া জোট এক নির্বাচনী জোট হয়ে ওঠার মুখে দাঁড়িয়ে। আমরা আমাদের দর্শকদের জিজ্ঞেস করেছিলাম, ইন্ডিয়া জোটের মধ্যে যদি আসন সমঝোতা হয় তাহলে এই রাজ্যে কংগ্রেস তৃণমূল আসন ভাগাভাগি করে লড়বে, তাতে বিজেপির ফলের উপর কি কোনও প্রভাব পড়বে? এর ফলে তাদের আসন কতটা কমতে পারে?
বিজেপিকে এক লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ হিসেবে মানুষের সামনে রাখছে মিডিয়া, প্রত্যেক সংবাদ মাধ্যমে মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায় শ্লোগানের কথাই আদতে বলা হচ্ছে, কিন্তু এখনও বিজেপি ছেড়েই দিলাম এন ডি এ তে যে দলগুলো আছে তারা সবাই মিলেও ৪০% এর বেশি ভোট পায়নি, কাজেই বিরোধীদের এক নির্বাচনী জোট তাদের সমস্যায় ফেলতে পারে, অন্তত বিষয়টা কেক ওয়াক হবেনা এটা তো বলাই যায়। সেই পথেই বাংলায় তৃণমূল আর কংগ্রেসের আসন সমঝোতার ফলে বিজেপির আসন যে কমবে তা বলাই বাহুল্য।