২০১৪-তে মোদিজি ক্ষমতায় এসেই ছিলেন দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক দেশজোড়া লড়াইকে সামনে রেখে। অতএব ক্ষমতায় আসার পরেই তিনি যেমন অজস্র মিথ্যে বলেন, অজস্র বাওয়াল দেন, অজস্র এমন প্রতিশ্রুতি দেন যা কখনও পূরণ হবে না, তেমনই একটা প্রতিশ্রুতি দিলেন। বাকায়দা পোর্টাল তৈরি করে লেখা হল আমরা দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ তাই এই দুর্নীতিতে জড়িত এমন লোকজনদের শাস্তি দিতে এক নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে বিচার হবে, শাস্তি হবে। কতদিনের মধ্যে? নিজেকে ভগবানের দূত বলেন মোদিজি, তিনিই জানালেন এক্কেবারে সময়সীমা দেওয়া যাচ্ছে না কিন্তু ফাস্ট, খুব তাড়াতাড়ি। তো আমরা ধরেছিলাম মাস তিন চার হবে হয়তো। খেয়াল করুন ২০১৬-তে নারদা মামলা দায়ের হয়, এখন সেই মামলার অন্যতম আসামি শুভেন্দু অধিকারী ওনার দলের সম্পদ। তো তার পরে আবার বিরাট মেজরিটি নিয়ে ক্ষমতায় বসলেন মোদিজি ২০১৯-এ, আবার সেই প্রতিশ্রুতি রিপিট করা হল, না খায়েঙ্গে না খানে দেঙ্গে ইয়ে হ্যায় মোদি কি গ্যারান্টি, এবার নির্দিষ্ট সময়সীমা দেওয়া হল, দিলেন ভগবানের সেই দূত, ২৮ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি হবে। ২০১৮-তে মহারাষ্ট্র কোঅপারেটিভ স্ক্যামের মাথা অজিত পাওয়ার এখন ওনার সম্পদ। ঠিক নির্বাচনের আগে আবার সেই দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদ, আবার সময় কমিয়ে বলা হল মাত্র ১০ দিন, ১০ দিন কে অন্দর জেল মে ভেজুঙ্গা। আবার ক্ষমতায় এলেন, এবারে অবশ্য বিজেপির নয়, মানুষ হাত পা কেটে দিয়েছেন, কিন্তু যাইহোক প্রধানমন্ত্রী হলেন, হবার পরেই জানিয়েছেন ১০০ দিনের মধ্যেই সব দুর্নীতি মামলার নিষ্পত্তি করতেই হবে। আমরা কলকাতা টিভির কর্মীরা উল্লসিত, তাহলে নরেন্দ্র মোদির নির্দেশেই জেল থেকে বেরিয়ে আসবেন আমাদের চ্যানেল সম্পাদক কৌস্তুভ রায়। আর সেটাই আমাদের বিষয় আজকে।
তো যে কথা বলছিলাম, হাজারবার মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরেও আমরা আরেকবার ধাক্কা খেয়ে মাটিতে নেমে আসা মোদিজির প্রতিশ্রুতির উপর ভরসা করতে চাই। তিনি বলেছেন দুর্নীতি মামলার নিষ্পত্তি ১০ দিনের মধ্যেই করতে হবে, ১০০ দিনের মধ্যে সব মামলার নিষ্পত্তি দেখতে চান। ৩০০ দিন জেলেই কাটিয়েছেন আমাদের সম্পাদক, আরও ৯৭-৯৮ দিন হি সহি, আমরা তাঁকে দেখতে চাই চ্যানেলের অফিসে। আমরা জানি তিনি নির্দোষ, আমরা জানি তাঁর মামলার নিষ্পত্তি হলে তিনি বেকসুর খালাস পাবেন।
আরও পড়ুন: Aajke | বামেদের ঘুরে দাঁড়ানো হল না
কেন এই আত্মবিশ্বাস? কারণ এক ঘোষিত ফোরটোয়েন্টি অপরাধী, যিনি আদালতের রায়ে জেল খাটছেন, তাঁর এক অভিযোগে এই মামলা শুরু করা হয়েছে এক নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়েই। একজন কনভিক্টেড আসামি যাকে উচ্চ আদালত চিটিংবাজির মামলায় আজীবন কারাবাসের শাস্তি দিয়েছে, সেই মানুষটা হঠাৎ ২০২৩-এ এক ইমেল করে হিসেবের এক কাগজ যাকে অ্যাকাউন্টসের ভাষায় লেজার বলে তা পাঠিয়ে দিলেন। কী করে পাঠালেন, কে জোগাল জেলের মধ্যে কমপিউটার, ইন্টারনেট? তদন্ত হবে না? কোথা থেকে সেই কনভিক্টেড আসামি তাঁর হিসেবের কাগজপত্র পেলেন যা মামলা চলাকালীন সিজ হয়ে আদালতের কাছে গচ্ছিত? কোন আদালত তাঁকে এই অ্যাকাউন্টসের খাতাপত্র দেখার অনুমতি দিয়েছে? জানতে চাইব না? এবং মজার কথা হল মিথ্যের এক ভারি সমস্যা আছে, মিথ্যে বললে তা পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে রাখতে হয়, না হলেই গোলযোগ। এখানেও সেই গোলযোগ বার বার হয়েছে। অভিযোগটা কী? ওই যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজাপ্রাপ্ত আসামির চিট ফান্ডের ব্যবসা ছিল, সেসব পয়সা নাকি বিজ্ঞাপন দেওয়ার নাম করে কলকাতা টিভিতে পাঠানো হয়েছিল, মানুষের ঘাম রক্তের পয়সা নাকি এইভাবেই এইপথেই ঘোরাফেরা করেছে। মানে মনোরঞ্জন রায় কলকাতা টিভিকে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন, সেই পয়সার কিছু অংশ রেখে আবার তা ফেরত চলে গেছে মনোরঞ্জন রায়ের কাছে। হ্যাঁ এভাবেই তো বেআইনি টাকা ঘোরে। তো আসুন সেই টাকার হিসেব নেওয়া যাক। ওই মনোরঞ্জন রায়ের হিসেবের খাতা বলছে উনি তাঁর কোম্পানির বিজ্ঞাপন বাবদ ৩৩ কোটি টাকা খরচ করেছিলেন ২০১১ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত। ওই হিসেবের খাতা বলছে মাত্র ৩ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা কলকাতা টিভির কাছে এসেছিল, বাকি টাকা বিভিন্ন চ্যানেল, বিভিন্ন খবরের কাছে গেছে, কত টাকা? ২৯ কোটি ৩১ লক্ষ টাকা। মানে মোট টাকার ১১ শতাংশ এসেছিল কলকাতা টিভির কাছে, বাকি ৮৯ শতাংশ গেছে বিভিন্ন চ্যানেল আর কাগজের কাছে, তাদেরকে ডাকা হয়েছে? সিবিআই বা ইডি তাদের দফতরে রেড করেছে? তাদের মালিক সম্পাদকদের গ্রেফতার করা হয়েছে? উত্তর, না। কেন ভাই? কারণ খুব সোজা, তাঁরা দিল্লির নির্দেশ মেনে চলছেন, আমাদের সম্পাদক সেই নির্দেশ মেনে চলেননি তাই ২০০ দিনের বেশি জেলেই আছেন। আচ্ছা এই মনোরঞ্জন রায়ের বিরুদ্ধে কত টাকা মেরে দেওয়ার অভিযোগ ছিল? ৬৩৮ কোটি টাকার ঘোটালার জন্য ওনার আজীবন কারাবাস হয়েছে, আর কলকাতা টিভির মালিকের ওপর সেই ৬৩৮ কোটির কত টাকার গরমিলের অভিযোগ এনেছে ইডি? ১.৫০ কোটি টাকার, মানে দশমিক দুই পাঁচ শতাংশের জন্য একজনকে ধরে ৩০০ দিনের বেশি জেলে রাখা হয়েছে, কিন্তু বাকি ৯৯.৭৫ শতাংশ টাকার নয়ছয়ের জন্য, পাচারের জন্য, হিসেবের গরমিলের জন্য দায়ীদের একজনও চিহ্নিতও নয়, এটা ষড়যন্ত্র নয়? এবং সেই স্যাক্রোস্যান্ট হিসেবের কাগজ যা নাকি ওই কনভিক্টেড আসামি ইডিকে দিয়েছেন, যার ভিত্তিতে ইডি কৌস্তুভ রায়কে জেলে পুরেছেন, সেটাও কি একটা? একই অ্যাকাউন্টসের নানান হিসেব ইডিই লাগাতার দিয়ে চলেছে। ১৭ জুলাই যখন কৌস্তুভ রায়কে গ্রেফতার করা হল, তখন ইডি যে বিজ্ঞাপন বাবদ টাকার হিসেব ওই মনোরঞ্জন রায়ের হিসেবের বইয়ে দেখিয়েছিল তার পরিমাণ ছিল ১.৯১ কোটি টাকা, কিন্তু যখন কৌস্তুভ রায়কে সই করতে বলা হল সেই হিসেবের পাতায় তখন তা কমে ১.৫৫ কোটি টাকা হয়ে গেল। এর কিছুদিন পরেই যখন জামিনের আবেদনে আপত্তি জানিয়ে ইডি আদালতে তথ্য পেশ করল, তখন সেই অঙ্ক কততে দাঁড়াল? আরও কমে তা হল ১.৪০ কোটি টাকা। এটা কি পি সি সরকারের ম্যাজিক, একই হিসেবের বইয়ে যে টাকা নিয়ে একজনকে গ্রেফতার করে ২০০ দিনের বেশি জেলে রাখা হয়েছে তা ক্রমশ কমে যাচ্ছে, বছর দুয়েক পরে তাহলে তো নিজে থেকেই উবে যাবে। আসলে ওই যে, মিথ্যে বলার সমস্যা হল বার বার বানাতে হয়, জেল থেকে ইমেল করা ওই হিসেবের কাগজের আসলে তো কোনও অস্তিত্বই নেই, কাজেই তা এক এক বার এক এক রকম হচ্ছে। আর সেসবের কোনও নথিই এমনকী শেষ দিনেও দিয়ে উঠতে পারলেন না ইডির উকিলরা। বিচারক চেয়েছিলেন একটা ডিমান্ড ড্রাফট, এক পাতার এক ডকুমেন্ট, ইডির উকিলরা জমা করলেন পেন ড্রাইভে ভরে ১০ হাজার পাতার নথি, হাসির রোল উঠল আদালতে। যেন তেন প্রকারেণ জেলে পুরে রাখার চেষ্টা, চেষ্টা চলছে যাতে মামলা চলতে থাকে, যাতে মামলার নিষ্পত্তি না হয়। আমরা আমাদের দর্শকদের কাছে প্রশ্ন করেছিলাম, নরেন্দ্র মোদিজি, দেশের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন দুর্নীতির সমস্ত মামলার নিষ্পত্তি ১০০ দিনের মধ্যে করতে হবে, আপনারা এটাকে সত্যি মনে করেন নাকি এটা আবার এক মিথ্যে প্রতিশ্রুতি? শুনুন মানুষজন কী বলেছেন।
আমরা জানি দেশের প্রধানমন্ত্রী রোজ মিথ্যে বলেন, নিয়ম করে মিথ্যে বলেন, তবুও সেই মিথ্যে দিয়ে মানুষকে ভোলানো যে যায়নি তাও এখন পরিষ্কার। চাকা ঘুরেছে। আমাদের একচুল ভরসাও ওনার বা ওনার কথার উপরে নেই, কিন্তু আমরা বিচার ব্যবস্থার ওপর সম্পূর্ণ ভরসা তো হারাইনি। আমরা সুবিচার চেয়েছি, আমরা চেয়েছি দুর্নীতির সমস্ত মামলার নিষ্পত্তি হোক। আমরা চেয়েছি আমাদের চ্যানেল সম্পাদক স্বাধীন গণতান্ত্রিক দেশের আর দশজন মানুষের মতোই নির্দোষ সাব্যস্ত হওয়ার পরে ফিরে আসুন দফতরে।