‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি/ ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি।’
ফি-বছর ২১ ফেব্রুয়ারি (Ekushe February) এলেই এই পংক্তি মুখে মুখে ফেরে এপার বাংলার ভাষাপ্রেমী রাজনীতিকদের ভাষণে। কিন্তু, কেউ কি জানেন এই পংক্তি, যা আজ ইতিহাস হয়ে গিয়েছে, তা কার লেখা। হলফ করে বলা যায়, অধিকাংশ মানুষই তা জানেন না। এই কবির নাম প্রয়াত আবদুল গফফর চৌধুরী (Abdul Gaffar Chowdhury)। এই গানের কথা ও সুর এতটাই মানুষকে আন্দোলিত করেছে যে, তা হয়ে উঠেছে সর্বজনীন।
আরও পড়ুন: ISRO: ইসরোর সাফল্য, তিনটি কৃত্রিম উপগ্রহকে কক্ষপথে বসিয়ে সফল উৎক্ষেপণ লঞ্চ ভেহিকলের
গত শতকের পাঁচের দশক থেকে তিনি আমরণ বাংলাদেশের (Bangladesh) রাজনৈতিক সংগ্রামের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত ছিলেন। কলেজ-ছাত্র থাকা অবস্থায় আবদুল গফফর চৌধুরী ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন, জেল খেটেছেন। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ (Bangladesh Mukti Yudhya) শুরু হলে তিনি সপরিবারে আগরতলা হয়ে কলকাতা চলে আসেন। আনন্দবাজার পত্রিকা ও যুগান্তর–এও তখন নিয়মিত লিখতেন। স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকে নিয়মিত তাঁর কথিকা প্রচারিত হতো। সে সময় এই শহরের বুদ্ধিজীবী মহলের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে, যা দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও অব্যাহত ছিল।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর দেশ সামরিক শাসনে পিষ্ট, চারদিকে ঘাতকের উল্লাস এবং মানবতার লাঞ্ছনা। যখন কেউ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের (Sheikh Mujibur Rahman) নাম নিতে সাহস পেতেন না, তখনও তিনি ইতিহাসের বর্বরতম হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেছেন। ১৯৭৬ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রথম বার্ষিকীতে তিনি ক্রোড়পত্র বের করেন।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ তাঁর অনন্য সৃষ্টি। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি যে মিছিলে মুসলিম লিগ সরকার গুলি চালিয়ে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত প্রমুখকে হত্যা করে, সেই মিছিলে তিনিও ছিলেন পেছনের সারিতে। তাই যাঁরা গুলিবিদ্ধ হন, তিনি তাঁদের দেখতে পাননি। একুশের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘আমরা আউটডোরের সামনে গিয়ে দেখি একটি লাশ পড়ে আছে। সাদা প্যান্ট পরা, সাদা শার্ট গায়ে, পায়ে জুতোও আছে, গুলিতে তাঁর মাথার খুলি উড়ে গেছে। রক্তাক্ত অবস্থায় লাশটি পড়ে আছে। সেই লাশটি দেখার জন্য শত শত লোক ভিড় জমিয়েছে। রফিকুল ইসলাম সম্ভবত তাঁর ছবি নিয়েছিলেন। পরে জানলাম যে এই লাশ শহীদ রফিকউদ্দিনের। এই লাশটি দেখার সময়ে আমার মনে কবিতা লেখার জন্য একটি ভাবের উদয় হয়েছিল। ভাবটি এসেছিল কবিতা লেখার জন্য, গান রচনার জন্য নয়। আমি গান লিখতে জানি না, আমি সুরকারও নই, গীতিকারও নই, একটি কবিতা লেখার জন্য আমার মনে যে লাইনটি এসেছিল, তা হলো, “আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি/ আমি কি ভুলিতে পারি?”’ (নেপথ্য কাহিনী: আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি: লুৎফর রহমান রিটন সম্পাদিত, আগামী প্রকাশনী।)।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর অমর গানটি প্রকাশিত হয় হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশের প্রথম সংকলন–এ, ১৯৫৩ সালে। এর আগেই গাজীউল হক ও আবদুল লতিফ একুশে ফেব্রুয়ারির শহীদদের স্মরণে দুটি গান লিখেছিলেন। আর ঢাকায় গুলিবর্ষণের ঘটনা শুনে ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই চট্টগ্রামে বসে মাহবুব উল আলম চৌধুরী লিখেছিলেন, তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘আমি আজ ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’।
‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি’ গানটিতে শুধু শহীদদের প্রতি শোকগাথা নয়, এই গানে সব ধরনের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে চিরন্তন লড়াই-সংগ্রামের কথা আছে। এই গান কেবল আবদুল গফফর চৌধুরী কিংবা এর সুরকার আলতাফ মাহমুদকেই অমর করেনি, বাঙালির চেতনাকেও করেছে তীক্ষ্ণ ও শাণিত। আসলে এটি অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের, পশুশক্তির বিরুদ্ধে মানবতার গান। গানের কয়েকটি পংক্তি হল,
‘ওরা এ দেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন বস্ত্র শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগো, তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজও, জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে।’
তথ্যসূত্র: সোহরাব হোসেন