পিয়ানোর কি-তে হাত পড়লেই হারিয়ে যেতেন মানুষটা।তেমনই হারিয়ে যেতেন টেবিল টেনিসে , ক্যারম বোর্ডেও- একবার খেলায় মন দিয়ে ফেললে শত ডাকাডাকিতেও গানের দিকে ফিরেও তাকাতেন না তিনি, আবার সুরে হারিয়ে গেলে, সুরেই বিরাজ করতেন- তিনি ভারতীয় সংগীতের অন্যতম জিনিয়াস সলিল চৌধুরী। এবছরটা সলিল চৌধুরীর ৯৯তম জন্মবার্ষিকী।
পাশ্চাত্য সংগীত এবং ভারতীয় সংগীতের এক আশ্চর্য মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন ভারতের মিউজিক্যাল এই ম্যাস্ট্রো। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় সংগীতে পাশ্চত্য সংগীতের রং লেগেছিল। গান নিয়ে পরীক্ষা-নীরিক্ষায় বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে সলিলদাকে গুরু মানতেন অনেকেই। ব্যক্তি জীবনে সলিল চৌধুরী ছিলেন এনার্জি আর সৃষ্টিশীলতার প্রতিভূ। তাঁর সুর জুড়ে থাকত অদ্ভুত এক মাদকতা।
জীবনের ছোটখাটো প্রতিটা মুহূর্তকে মনপ্রাণ দিয়ে উপভোগ করতে জানতেন তিনি। তাঁর কাছের মানুষরা বলেন, মানুষটা নাকি ছিলেন চূড়ান্ত ফাঁকিবাজ।তবে ঘুরে-বেড়িয়ে নিজের মর্জি মাফিক সময় কাটানোর পর যেটুকু সময় বাঁচত সেইটুকুই ছিল সুফানা সফর। সেই সফরে আজও মজে সংগীতপ্রেমীরা। আজও প্লে- লিস্টে সলিল চৌধুরীর একের পর এক গান মানেই নেশাচ্ছন্নতা।
একই সঙ্গে আইটিপিএ এবং বোম্বে ইয়ুথ কয়্যারের দায়িত্ব সামলেছেন সলিল।গানের পাশাপাশি সমান ভাবে পালন করেছেন সংগঠকের দায়িত্বও। কখনও কখনও সব কিছু ছেড়ে চলে গেছেন ইপ্টার ট্যুরে। অভিভাবকের মতো নজর রেখেছেন বোম্বে ইয়ুথ কয়্যারের সমস্ত সাংগঠনিক কাজকর্মে।
সলিলের সুরে ছিল দিন বদলের আহ্বান। একটা সময় ছিল, যখন একের পর বিপ্লবের গানের জন্ম দিচ্ছেন সলিল, তাঁর সেই গানই হয়ে উঠছে একটা একটা আস্ত বিপ্লব, সময়ের গান, শ্রমজীবি মানুষের জীবনের গান- এদিকে স্রষ্টা নিজেই হয়তো তখন আন্ডার গ্রাউন্ডে। তবু দমিয়ে রাখা যায়নি তাঁর সৃষ্টিকে, তাঁর বিপ্লবী মনকে।
এক আলো যেন তাঁকে ঘিরে রেখেছিল আজন্ম। নিজের সেই আলোকবৃত্তের সন্ধান সকলের মাঝে ছড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন সলিল চৌধুরী। তিনি যখন বোম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে যান, তখন সেখানে রাজ করছেন শচীনদেব বর্মণ, নৌসাদ, শংকর-জয়কিষানের মতো তাবড় সুরকাররা। এসডি- র মাটির গন্ধমাখা সুর, নৌসাদের রাগাশ্রয়ী সুরের মাঝেই সুরের এক অন্য দিগন্ত খুলে দিলেন সলিল চৌধুরী। ভারতীয় সংগীতের সঙ্গে কী সাবলীলভাবে তিনি মিলিয়ে দিলেন পাশ্চাত্য সংগীতকে।
শুধুমাত্র বাংলা বা হিন্দি ছবির গানই নয়, বেসিক বাংলা গানে একটা সময় সলিল চৌধুরীই ছিলেন পথপ্রদর্শক। তাঁর সুরের মায়াতেই বাংলা গানের শ্রোতা কখনও আপন করে নিয়েছে কোনও এক গাঁয়ের বধূর গল্প, কখনও বা রানারের ক্লান্তির দিনযাপন। কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথায় , সলিল চৌধুরীর সুরারোপ আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ব্যারিটোন মানেই আজন্মের ম্যাজিক।
সলিলের সুর শুধু হৃদয়ে বা মস্তিষ্কের জন্য নয়, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর সঙ্গীতের মাদকতা। বাংলা- হিন্দি ছাড়াও দক্ষিণী গানেও তাঁর সুরেলা ম্যাজিক ভোলার নয়। সলিল চৌধুরি আসলে ছিলেন এক ‘পাওয়ার হাউজ্’ পারফর্মার। তিনি পিয়ানোতে হাত দিলে সেই যে সুর ঝরে পড়ত, সেই সুরের ঝরনাতলায় আজও তৃষ্ণা মেটান সংগীতের পিয়াসীরা। থেমে থাকা বিপ্লব আজও বদ্ধমুষ্টি শক্ত করে সলিল চৌধুরীর গানে। পাল্টে দেওয়ার স্বপ্ন আজও শ্বাস নেয় সলিল চৌধুরীরই নামে।