কলকাতা টিভি ওয়েব ডেস্ক: শনিবার কেওড়াতলা শ্মশান সংলগ্ন সাহাপুরে শ্রাদ্ধানুষ্ঠান হল স্বপন দে-র। সেই শ্রাদ্ধানুষ্ঠানের কার্ডও দেখার মতো। একদিকে শ্রীকৃষ্ণের ছবি, অন্যদিকে গণেশের ছবি। প্রশ্ন উঠতেই পারে, হঠাত স্বপন দে-র শ্রাদ্ধ নিয়ে খবর কেন?
সত্যিই তো। কে এই স্বপন দে, যার শ্রাদ্ধ নিয়েও খবর হবে? স্বপন দে বললে কেউ হয়ত চিনবেন না। কিন্তু যদি বলা হয়, শ্মশান স্বপন, তবেই এক ডাকে সবাই চিনে ফেলবেন।
কে এই শ্মশান স্বপন, জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে তিরিশ বছর আগে। কেওড়াতলা শ্মশান এবং আশপাশ এলাকায় স্থানীয় ক্লাবের সভাপতি বা প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে সবাই তাকে চিনত। শ্মশানে শবদাহকে ঘিরে যে অসাধু চক্র চলত, তার মূল হোতা ছিলেন এই শ্মশান স্বপন। মৃতদেহ বহন করার খাট থেকে শুরু করে বিছানা, বালিশ স্বপনের অঙ্গুলিহেলনে চালান হয়ে যেত অন্যত্র মৃতদেহ চুল্লিতে ঢোকার আগেই। তা নিয়ে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হত। এক কথায় কেওড়াতলা শ্মশান এলাকা দাপিয়ে বেড়াত শ্মশান স্বপনের বাহিনী। প্রথমদিকে তিনি কংগ্রেস নেতা হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। বাম জমানায় শাসকদলের কোনও কোনও নেতার সঙ্গে তাঁর দহরম মহরম ছিল বলেও শোনা যায়। পালাবদলের পর স্বপনের ঘনিষ্ঠতা হয় তৃণমূলের সঙ্গে।
সেই শ্মশান স্বপনের দাপট আমজনতা দেখল ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিল রাতে কেওড়াতলা মহাশ্মশানে। বিশ্ববরেণ্য অস্কারজয়ী চলচ্চিত্র পরিচালক সত্যজিৎ রায়ের শেষকৃত্য ছিল সেদিন। শ্মশান চত্বর পুলিসে পুলিসে ছয়লাপ। বিশিষ্টদের ভিড়। ভিড় তথ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে শুরু করে অনেক মন্ত্রী, নেতা, শিল্পী, সাহিত্যিকের। সত্যজিতের শেষকৃত্য বলে কথা।
সেই পুলিস, ভিআইপিদের ভিড়ে যে স্বমূর্তি ধারণ করবেন শ্মশান স্বপন, কে তা জানত। আচমকাই তিনি পুলিস অফিসারদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন। প্রয়াত সিপিএম সাংসদ বিপ্লব দাশগুপ্তের পাঞ্জাবির কলার চেপে ধরেছিল সে। গোলমালের মধ্যেই তিনি ভিড়ের মাঝে দেখতে পান কলকাতার তৎকালীন পুলিস কমিশনার বীরেন্দ্রনাথ সাহাকে। সকলে তাঁকে বীরেন সাহা বলেই ডাকতেন। স্বপন পুলিস কমিশনারকে সাহা দা বলে ডেকে বসেন। কর্তব্যরত পুলিস অফিসারদের বলেন, গোলমাল থামাতে হলে সাহা দাকে আসতে হবে এখানে।
সে এক হই হই কাণ্ড। তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তো খেপে লাল। বস্তুত তাঁর নির্দেশেই শ্মশান থেকে গ্রেফতার করা হয় শ্মশান স্বপনকে। বুদ্ধবাবুর পরামর্শেই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু পরের দিনই কমিশনার পদ থেকে সরিয়ে দেন শ্মশান স্বপনের সাহা দাকে। নতুন পুলিস কমিশনার হন তুষার তালুকদার। তখন থেকেই কলকাতাবাসীর মুখে মুখে ফিরত শ্মশান স্বপন আর সাহা দার কথা।
আরও পড়ুন: Sunil Jakhar: কংগ্রেসকে ‘গুড বাই’ জানিয়ে ফেসবুক লাইভে দল ছাড়ার ঘোষণা সুনীল ঝাখরের
দীর্ঘদিন স্বপন কারান্তরালে ছিল। রাজ্যে পালা বদলের পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হস্তক্ষেপে কেওড়াতলা শ্মশানে স্বপনের দাপট কমে। এখন আর শ্মশান ঘিরে সমাজবিরোধীদের তেমন দাপাদাপি দেখা যায় না।
২ মে কলকাতার পুলিস হাসপাতালে মৃত্যু হয় শ্মশান স্বপনের। ঘটনাচক্রে সত্যজিতেরও জন্মদিন ২ মে। স্বপনের শ্রাদ্ধবাসরে তাঁর অতীত নিয়ে কাটাছেঁড়া হল কি না, জানা নেই। কেউ ১৯৯২ সালের ২৪ এপ্রিলের ঘটনার কথা টেনে আনলেন কি না, জানা নেই তাও।তবে অনেকেই শনিবার স্বপনকে ভগবানের সঙ্গে তুলে করেন। কেউ কেউ আক্ষেপ করেন অভিভাবককে হারালেন বলে। সম্প্রতি সাহানগরের বাড়ি ছেড়ে স্বপনরা চলে যান সাহাপুর রোডে। নীরবেই চলে গেলেন এককালের দাপুটে চরিত্র শ্মশান স্বপন।