আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রায় রোজ তোতা পাখির মতো ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে বলে চলেছেন, টিকা এখন অগ্রাধিকার। যত দ্রুত সম্ভব, দেশের অধিকাংশ মানুষকে টিকা দিতে হবে। খুব ভালো কথা। করোনার তৃতীয় ঢেউ দরজায় কড়া নাড়ছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের দাপট একটু কমতেই, বিধিনিষেধ একটু শিথিল হতেই মানুষ দলে দলে বেরিয়ে পড়েছে। ধর্মস্থান, পর্যটন কেন্দ্রগুলিতে ভিড় উপচে পড়ছে, দূরত্ব-বিধি মানার কোনও বালাই নেই, অনেকের মুখে মাস্ক নেই। আহা, কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
আরও পড়ুন: করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা কমছে মোদির
প্রধানমন্ত্রী খুবই উদ্বিগ্ন। মঙ্গলবারও উত্তর পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলির সঙ্গে করোনা পর্যালোচনার ভার্চুয়াল বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী পর্যটন কেন্দ্রগুলির ভিড় নিয়ে চিন্তার কথা ব্যক্ত করেছেন। ফের তাঁর মুখে টিকার অগ্রাধিকারের কথা শোনা গিয়েছে। তিনি তো বলেই খালাস। কিন্তু কথা হল, পর্যাপ্ত টিকার জোগান কোথায়? দেশের মানুষকে টিকা দেওয়ার ব্যবস্থা না করে প্রধানমন্ত্রী বিদেশে টিকা পাঠিয়েছেন। তা নিয়ে বিতর্কও কম হয়নি। ভারতের মতো বিপুল জনসংখ্যার দেশে খুব কম মানুষেরই এখন পর্যন্ত দুটি ডোজের প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে।
আরও পড়ুন: পাহাড়ে মাস্ক ছাড়া টুরিস্টের ভিড় উদ্বেগ বাড়াচ্ছে: মোদি
রাজ্যে রাজ্যে টিকার জন্য রীতিমতো হাহাকার চলছে। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বারবার প্রধানমন্ত্রীকে টিকার জন্য চিঠি লিখেছেন। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা। কোথায় টিকা?
মানুষ টিকার খোঁজে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাঁদের সামর্থ আছে, তাঁরা বেসরকারি হাসপাতাল বা টিকা কেন্দ্র থেকে টাকা খরচ করে টিকার ব্যবস্থা করে নিচ্ছেন। কিন্তু বেশির ভাগ মানুষকেই ভুগতে হচ্ছে। এক সরকারি হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটে যেতে হচ্ছে। সেখানে গিয়ে দেখা গেল, টিকা নেই। আবার ছুটতে হচ্ছে অন্য হাসপাতালে বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। সেখানে গিয়ে হয়ত দেখা গেল, টিকা নেই বলে নোটিস ঝোলানো।
রোজই কোথাও না কোথাও টিকার লাইনে বিশৃঙ্খলা হচ্ছে, মারামারি হচ্ছে। শুধু আমাদের রাজ্যেই নয়, প্রায় সব রাজ্যেই এক চিত্র।
এই ছবি ২০১৬ সালের নোটবন্দির কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। ওই সময় এটিএম দেখলেই মানুষ ছুটে যাচ্ছিলেন, যদি টাকা মেলে। এক এটিএম থেকে অন্য এটিএমে ছুটতে হয়েছে মানুষকে। কী লম্বা লাইন। তারপর দেখা গেল, মেশিনে টাকা শেষ। আবার বহু এটিএম সেন্টারে গিয়ে টাকা নাই বলে নোটিস দেখে হতাশ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে। কমবেশি অধিকাংশ মানুষকে এই নিদারুণ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়েছে। দেশের নানা প্রান্তে এটিএমে মারামারি পর্যন্ত হয়েছে। টিকার লাইনেও একই ঘটনা আমরা বহু জায়গায় ঘটতে দেখেছি।
আরও পড়ুন: করোনা নিয়ে রাজ্যের মুখ্যসচিবকে চিঠি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় ভাল্লার
দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের টিকাকরণ চলতি বছর শেষ হওয়ার আগেই সেরে ফেলা যাবে বলে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের সর্বোচ্চ আদালতে হলফনামা দিয়েছে। রাজ্যগুলিকে প্রতিশ্রুতিমতো টিকার জোগান দিতে পারেনি কেন্দ্রীয় সরকার এখন পর্যন্ত। এই অবস্থায় গোটা দেশে ডিসেম্বর মাসের মধ্যে সব প্রাপ্তবয়স্ককে কী করে দুই ডোজ টিকা দেবে কেন্দ্র, তার ঠিক নেই।
টিকাকরণ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার যেমন বিরোধীদের তোপের মুখে পড়েছে, তেমনি তাদের একাধিক হাইকোর্ট থেকে শুরু করে সুপ্রিম কোর্টের ভর্ৎসনা শুনতে হয়েছে। দেশের শীর্ষ আদালত তো পরিষ্কার বলে দিয়েছে, কেন্দ্রের কোনও সুষ্ঠু টিকানীতিই নেই। তাতে অবশ্য কেন্দ্রের খুব একটা হেলদোল দেখা যায়নি। ভাবখানা এমন, যা করেছি, বেশ করেছি। কংগ্রেস নেতা পি চিদম্বরমের অভিযোগ, টিকা নিয়ে সরকারের দাবির সঙ্গে বাস্তবের আকাশ পাতাল ফারাক। বিরোধীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী টিকাকরণ বাড়ানোর কথা বললেও যথেষ্ট জোগান না থাকায় সরকারের টিকাকরণ নীতিই প্রশ্নের সামনে পড়ে গিয়েছে।
উত্তর পূর্বের রাজ্যগুলির বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী টিকাকরণ প্রকল্পকে ত্বরান্বিত করতে পরামর্শ দিয়েছেন। বিরোধীরা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ দিচ্ছেন বটে। কিন্তু তিনি কি যথেষ্ট টিকার জোগান দিতে পারছেন?
এ যেন সেই শ্রীকান্ত উপন্যাসের পিসেমশাইয়ের মতো ব্যাপার। বাঘরূপী শ্রীনাথ বহুরূপীকে মারার জন্য পিসেমশাই দেউড়ির খিড়কি থেকে চিৎকার করে বলছিলেন, সড়কি লাও, বন্দুক লাও। শরৎচন্দ্র ইন্দ্রনাথের মুখ দিয়ে বলিয়েছিলেন, লাও তো বটে। কিন্তু আনে কে?
এখানেও কিছুটা সেরকম ব্যাপার। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, টিকা দাও, টিকা দাও। টিকা তো দেবে। কিন্তু টিকার জোগান কোথায়?