জটলাটা দূর থেকেই দেখা যাচ্ছিল । কাছে যেতেই বোঝা গেল উৎসুক চোখগুলো যেন গিলে খেতে আসছে ।
পুকুরটাকে ডান হাতে রেখে এগোতে হবে কয়েক পা । ওপাশের রাস্তায় তখন বড় বড় গাড়ির সারি । মেঠো পথ । ছাদ না হওয়া গোটা কয়েক বাড়ি । রাস্তার এক দিকে গাছের ঝোপঝাড় । শেষ পাঁচ দিন ধরে খবরের শিরোনামে তো এই এলাকাই । যেখানে দুম করে আনাগোনা বেড়েছে পুলিশ কর্তাদের । এই মাটির পথে মাঝে মাঝেই পা রাখছেন জেলার তামাম প্রশাসনিক কর্তারা । এসেছেন রাজনৈতিক নেতারা । জানা-অজানা সংগঠনের প্রতিনিধিরাও ।
আমতার সারদা দক্ষিণ খাঁ-পাড়ার তিন তলা বাড়িটার সামনে বসানো হয়েছে পুলিসের আস্তানা । সিমেন্টের প্রলেপ না লাগা এই বাড়িটার ‘ছাদ থেকে পড়ে’ মৃত্যু হয়েছে ছাত্রনেতা আনিসের । পরিবারের অভিযোগ, পুলিসের পোশাকে চার জন সে রাতে বাড়িতে ঢোকেন । আনিসকে তাঁরাই ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন । যা নিয়ে জলঘোলা কম হচ্ছে না । বিতর্কে গত কয়েক দিনে যেন ‘সেলিব্রেটি’ হয়ে গিয়েছে খাঁ-পাড়ার এই এলাকাটা ।
জটলাকে পাস কাটিয়ে এগোতেই চোখে পড়ল তৎপরতা । ইতিউতি চাউনি । গত শনিবার থেকে পুকুরটার সামনে স্নানের সময় আর তেমন সমাগম চোখে পড়ে না । বাড়ির সামনে যেতেই সরে গেলেন জনা কয়েক । দরজার সামনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে চটি-জুতো । খোলা দরজা । ভিতরে ঢুকতেই চোখ গেল ঘরটার দিকে । ঘরের মধ্যে তখন রাজ্যের বিশেষ তদন্তকারী দলের প্রতিনিধিরা । গত দিনেও এসেছিলেন । আজও একবার । হালকা শীতের আমেজ কাটার আগেই আজ তাঁরা চলে আসেন । সব কথার একটাই কথা । আর একবার ময়নাতদন্ত করার অনুমতি দিন…
আরও পড়ুন: Anis Khan Murder Investigation: আমতায় ধৃত দুজনের ছবি দেখে চিনতে পারলেন না আনিসের বাবা
ঘরে লাইট বলতে তেমন কিছুই নেই । টিম টিম করছে আলোটা । সংবাদ মাধ্যমের ক্যামেরার আলোতেই যেন আজ অন্ধকার ঘরটায় আলো ফুটেছে । খাটের উপর শীর্ণ চেহারার বৃদ্ধ । এখনও ভিজে রয়েছে চোখের কোণগুলো । গত তিন দিন সে ভাবে মাথা তুলতে পারেননি সত্তর ছুঁইছুঁই সালেম খান । আজ মাথার পিছনে জুটেছে একটা বালিশ । মাথাটা একটু তুলেছেন । তা নিয়েই নাগাড়ে কথা বলে চলেছেন । দাবি একটাই । সিবিআই চাই । শুক্রবার রাতে আমতা থানার পুলিশ সব বিশ্বাসটুকুই যে শুষে নিয়েছে । রাজ্য সরকারের সিটও বুঝিয়ে দিয়েছে, আমতা পুলিশের কাজে গাফিলতি আছে । তাই তো তিন পুলিশকে সাসপেন্ড করা হয়েছে । বুধবার গ্রেফতার করা হয়েছে দুই জনকে । এক জন হোমগার্ড অপর জন সিভিক ভলান্টিয়ার । কিন্তু, তাতেও মন গলেনি আনিসের পরিবারের ।
রাজনীতির ঘোলা জলে মাছ ধরতে বাকি নেই কারও । সহানুভূতি জানাতে কে যাননি । বলে শেষ করা করা যাবে না । গত কয়েক দিনে তৃণমূল-সিপিএম নেতাদের আনাগোনা দেখা গিয়েছিল । আজ দেখা গেল অভিনেতা বাদশা মৈত্র, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায় মতো বামেদের নতুন মুখকেও । বছর দশেক আগে কামদুনিতে ধর্ষণের ঘটনায় প্রতিবাদী হিসেবে উঠে এসেছিল মৌসুমি-টুম্পাদের নাম । বুধবারের বারবেলা । আনিসের বাড়িতে দেখা গেল সেই মৌসুমি কয়ালকেও ।
বিক্ষোভ । মিছিল । প্রতিবাদ । সহানুভূতি হল । হল রাস্তা অবরোধ । পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল । কিন্তু, শুক্র-শনি-রবি-সোম-মঙ্গল-বুধ— ঠিক কী ভাবে এগিয়ে চলেছে তদন্ত স্পষ্ট হল না । সিট গঠন হয়েছে । তাও দুই দিন কেটে গিয়েছে । রাজ্য সরকার সদিচ্ছা দেখিয়েছে । তাও একাধিক প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট নয় ।
আরও পড়ুন: Anis Khan CBI: মুখ্যমন্ত্রীর বার্তার পরেও সিবিআই তদন্তের দাবিতে অনড় আনিসের পরিবার
এক) শুক্রবার রাতে পুলিশের পোশাকে যে চার জন আনিসদের বাড়িতে গিয়েছিলেন বলে অভিযোগ, তাঁরা কি পুলিসই ছিলেন?
দুই) যদি না হন, তা হলে সেই আগন্তুকরা কারা, তার হদিস কি পুলিস পেয়েছে ? যদি পুলিস কর্মীরাই সে রাতে আনিসের বাড়িতে গিয়ে থাকেন তবে তাঁরা কারা ?
তিন) আনিসকে কি ছাদ থেকে ঠেলে ফেলে দেওয়া হয়েছিল ?
চার) সে দিন রাতে সত্যি কী ঘটেছিল… মেলেনি তার উত্তরও ।
আর আনিসের পরিবার ? রাজনীতি নয় । সারদা দক্ষিণ খাঁ-পাড়া বলছে দোষীদের শাস্তি চাই ।