এক বছর কেটে গেল, হাথরস ধর্ষণের। ১৪ সেপ্টেম্বর সাতসকালে হাথরসের সেই নির্ভয়াকে গলায় তাঁরই দোপট্টা জড়িয়ে সবার চোখের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গিয়েছিল চার যুবক। মেয়েটি দলিত বাল্মিকী সম্প্রদায়ের। ছেলে চারটি উচ্চবর্ণের ঠাকুর। অতএব তাদের তো এই কাজ করার জন্মসিদ্ধ অধিকার আছে। তাঁকে গণধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয়নি, তাঁর জিভ কেটে নেওয়া হয়েছে। হাত মুচড়ে দেওয়া হয়েছে, গলায় দুপট্টা জড়িয়ে টেনে নিয়ে যাবার সময়, তার স্পাইনাল কর্ড ভেঙে গেছে। সে থানার বারান্দায় পড়ে থেকেছে বহুক্ষণ। তারপর স্থানীয় হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে সে জানিয়েছে, তাঁকে ধর্ষণ করা হয়েছে। ধর্ষণ করেছে সন্দীপ, রামু, রবি আর লবকুশ। কাউকে গ্রেফতার করা হয়নি। খবর ছড়িয়ে পড়ার পর, ২০ সেপ্টেম্বর মানে ৬ দিন পর পুলিশ অভিযোগ দায়ের করেছে। তাঁকে জওহরলাল নেহেরু মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হসপিটাল, আলিগড়ে ভর্তি করা হয়েছে। ২২ তারিখ পুলিশ তাঁর বয়ান নিয়েছে, এরপর তাকে দিল্লিতে সফদরজং হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আরও সাতদিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করার পর সে মারা যায়। ততদিনে উত্তরপ্রদেশের পুলিশ, নানান বিবৃতি দিয়েছে, প্রথমে বলেছে ধর্ষণ হয়নি, তারপর বলেছে ফরেন্সিক রিপোর্টে কিছু পাওয়া যায়নি। তারপর বলা হয়েছে জাতিগত হিংসা ছড়ানোর জন্য বিরোধীদল চক্রান্ত করছে। এসব নানান কথা বলার পর মেয়েটি যখন মারা গেল, তখন ওই ২৯ তারিখ গভীর রাতে পুলিশ পাহারা বসিয়ে রাত ২টো ৩০মিনিটে তাঁর বাবা মা’কে না জানিয়ে, পরিবারের সম্মতি না নিয়ে, তার বাড়ির কিছুটা দূরে ধানক্ষেতে তাঁর মৃতদেহকে জ্বালিয়ে দেয়।
কেবল হাথরস নয়, তার আশেপাশে ৩০/৪০ মাইল জুড়ে ব্যারিকেড তৈরি করা হয়, কেন? যাতে সাংবাদিকরা না ঢুকে যেতে পারে। মেয়েটির বাড়িতে কড়া পাহারা বসানো হয় যাতে তাঁদের সঙ্গে সাংবাদিকরা দেখা না করতে পারে। কিন্তু মাঝরাতে ওই চিতার ছবি এক সাংবাদিক পাঠাতে পারে। পরদিন সকালে মহান ভারতের নাগরিকরা জানতে পারে এই দানবীয় ঘটনা, জানতে পারে কিভাবে, যোগী সরকার ধর্ষণকারীদের আড়াল করার চেষ্টা চালাচ্ছে। আর ক’দিন পর সেই ২৯ সেপ্টেম্বর আবার আসছে, যোগীজী, উন্নয়ন আর বিকাশের চুরি করা ছবি ছাপিয়ে বিজ্ঞাপণ দিচ্ছেন। উত্তরপ্রদেশ বিকাশ কে রাহ পর, উত্তরপ্রদেশ বিকাশপ্রদেশ।
ধর্ষণের ঘটনার, মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার ক’দিন পরে উত্তরপ্রদেশ হাইকোর্ট নিজে থেকেই মামলা দায়ের করে, অটোপসি রিপোর্ট আসে, বলা হয়, সার্ভিকাল স্পাইনে প্রচন্ড আঘাতের ফলে মেয়েটির মৃত্যু হয়েছে। আর হ্যাঁ, মেয়েটিকে ধর্ষণ করা হয়েছে, গলা টিপে মারা হয়েছে। বিচারকরা বলেন, এ ঘটনা আমাদের বিবেককে আহত করেছে। ক’দিন পরে, ওই হাথরসে মিছিল বের হল, রাষ্ট্রীয় সাবর্ণ পরিষদের উদ্যোগে, ধর্ষক ছেলেগুলোর বাবা, কাকা সেই মিছিলে হাঁটলেন। সেই চারটি ছেলের মুক্তির দাবিতে শ্লোগান উঠল। ধর্ষণে অভিযুক্তদের স্বপক্ষে মিছিল সম্ভবত কেবল আমাদের দেশেই নয়, পৃথিবীতেও এই প্রথম হল, মিছিলের আগে সভাতে বিজেপি বিধায়ককে দেখা গেল, মিছিলে হাঁটল বিজেপি নেতারা। অবাক পৃথিবী অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ স্বদেশভূমি। এই মৃত্যু উপত্যকাই তো আমার স্বদেশ, এই ধর্ষিতা ভারতভূমিই তো আমার স্বদেশ, যেখানে গেরুয়া পরা এক সন্ন্যাসী, ধর্ষিতা নয়, ধর্ষকদের পক্ষে, খুলে আম, প্রকাশ্যেই। তুলনা নয়, তুলনা করাই যায় না, তবুও আর এক রাষ্ট্রনায়কের কথা মনে পড়েই যাচ্ছে, বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় খানসেনা আর রাজাকারদের হাতে ধর্ষিতা হন কমবেশি ২ লক্ষের বেশি নারী। স্বাধীনতার পরে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান বলেছিলেন, ‘তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কী? ধর্ষিতা মেয়ের বাবার নামের জায়গায় আমার নাম লিখে দাও আর ঠিকানা লেখো ধানমন্ডি ৩২। মুক্তিযুদ্ধে তোমরা যা দিয়েছ, তার ঋণ আমি কীভাবে শোধ করব?’
অস্ট্রিয়া, পোলান্ড, হাঙ্গেরি, ফ্রান্স দখলের পর জার্মান সেনাদের ধর্ষণের ঘটনাকে খুবই সাধারণ, সৈনিকোচিত ব্যবহার বলেছিলেন হিটলার। আসলে মধ্যযুগীয় মানুষজনেরা ধর্ষণকে সেভাবেই দেখেন, ধর্ষণ এক প্রতিক্রিয়া মাত্র, নিম্নবর্ণের মেয়েরা ধর্ষিতা হয় তাদের একগুঁয়েমির জন্য। উত্তরপ্রদেশের এক বিধায়ক এ কথা বলেছেন, মানে উচ্চবর্ণের মানুষজন যখন ডাকছে, তখন চলে যা, তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী কাজ কর, না বললে ধর্ষণ তো হবেই। ওদিকে প্রচুর টালবাহানার পর যোগীজি বিরাট ঘোষণা করলেন, মেয়েটির মা বাবাকে ২৫ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। বাড়ির একজনকে চাকরি দেওয়া হবে, আর সরকারি খরচায় তাদের বাড়ি তৈরি করে দেওয়া হবে। আর তিনিই সাংবাদিকদের জানালেন যে, মেয়েটির পরিবার সিবিআই তদন্ত চাইছিল না, তিনি সিবিআই তদন্তের আদেশ দিলেন। ১ বছর কেটে গেছে না ২৫ লক্ষ টাকা, না বাড়ি না চাকরি, কিছুই হয়নি, কিন্তু মেয়েটির বাড়ির সামনে এখনও পুলিশি পাহারা রাখা আছে। আপনি চাইলেই তাঁদের বাড়ির লোকজনের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। যোগীজি সাংবাদিক পছন্দ করেন না, এ তো নতুন কিছু নয়। সারা দেশে জনমত, মিডিয়ার চাপে চারজন ধৃতদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আইনজীবীদের মতে বহু তথ্যপ্রমান লোপাট হয়ে গেছে, আইনী ফাঁক গলে তাদের বেরিয়ে আসাটা খুব অস্বাভাবিক নয়। কয়েকজন পুলিশকে ট্রান্সফার করা হয়েছে। তাঁদের শাস্তির কোনও প্রশ্নই নেই, যারা ধর্ষকদের হয়ে নির্লজ্জভাবে উমেদারি করল, তথ্য প্রমাণ লোপাটে সাহায্য করল। কিন্তু পাশাপাশি আরেকটি ঘটনাও ঘটে চলেছে, ঘটনার ক’দিন পরেই কেরালার আঝিমুখম নামে এক পত্রিকার সাংবাদিক, সিদ্দিক কাপ্পন ওই দলিত মেয়েটির পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য, হাথরস রওনা হয়েছিলেন, হাথরসের বহু আগে মথুরায় তাঁকে গ্রেফতার করা হল ৫ অক্টোবর। অভিযোগ? তিনি নাকি জাতি দাঙ্গায় উসকানি দিতে সেখানে যাচ্ছিলেন, কেবল গ্রেফতার করাই হল না, তাঁকে আইনজীবীর সাহায্যও নিতে দেওয়া হল না। আমাদের সংবিধান, আমাদের আইন বলছে গ্রেফতারের ২৪ ঘন্টার মধ্যে, অভিযুক্তকে আইনী সহায়তা দিতেই হবে। তাঁকে গ্রেফতারের কারণ জানিয়ে অ্যারেস্ট মেমো দিতে হবে। আইন বলছে, Anyone arrested in India for any crime is entitled to a lawyer of their choice — a right guaranteed under the Constitution.
হ্যাঁ, ফর এনি ক্রাইম, তাঁকে আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলতে দিতে হবে। কাপ্পনের বিরুদ্ধে ইউএপিএ লাগু করা হল, আন ল ফুল অ্যাকটিভিটিজ (প্রিভেনশন) অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট। একজন সাংবাদিক খবর জোগাড় করতে যাচ্ছে, যোগীজির মনে হল সেটা আন ল ফুল, কাজেই তাঁকে গ্রেফতার করা হল। উকিল দেখা করতে চাইলেও, দেখা করতে দেওয়া হল না। ৪৩ দিন, হ্যাঁ, ৪৩ দিন পর তাঁর উকিল তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারলেন, মামলা দায়ের হল, ইতিমধ্যে দুজন স্থানীয় আইনজীবী তাঁর মামলা লড়তে চেয়েও পিছিয়ে এসেছেন, কেন? সেটা সহজেই অনুমেয়। কাপ্পনের বিরুদ্ধে অজস্র মামলা, জাতি দাঙ্গা ছড়ানো, মিথ্যে খবর ছড়ানো, শান্তি শৃঙ্খলা ভঙ্গ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। আর এই ক’দিন আগে কাপ্পনের ৯০ বছর বয়সী মায়ের সঙ্গে দেখা করার জন্য তাঁকে পাঁচ দিনের শর্তসাপেক্ষ বেল দেওয়া হয়, পাঁচ দিন পর তিনি আবার ফিরে গেছেন জেলে, সে মামলা এখনও চলছে।
কোনও সভ্যদেশে এরকম সরকার থাকতে পারে? কোনও সভ্যদেশে ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল বার করা হয়? কোনও সভ্যদেশে ধর্ষিতা এক কিশোরীর শবদেহ, পুলিশি পাহারায় পুড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে? কোনও সভ্য দেশে, সেই ধর্ষণের ঘটনার খবর করতে যাওয়া সাংবাদিককে অপরাধ দমন আইনে গ্রেফতার করা যায়? কোনও সভ্য দেশে কোনও নাগরিককে, ৪৩ দিন আইনজীবীর সাহায্য না নিতে দিয়ে জেলে রাখা যায়? ইউপিতে সবার চোখের সামনে এই ঘটনা ঘটেই চলেছে, এবং এত কিছুর পরে সেই মুখ্যমন্ত্রী চুরি করা ফটো ছাপিয়ে নিজের উন্নয়নের কাজ জাহির করে জানাচ্ছেন, এটা ভাবা যায়? কতটা নির্লজ্জ হলে এটা সম্ভব। কিন্তু তীব্র হিন্দুত্বের ধ্বজাধারী এই মানুষটির সমর্থনে বহু মানুষ আছেন, অর্ণব গোস্বামীর মত গোদি মিডিয়ার সাংবাদিকরা আছেন, এই ক্রিমিনালকে সমর্থন করে দু মুখে প্রশংসা করছেন দেশের প্রধানমন্ত্রী! এই দেশ, এই সমাজ, এই আইনী অরাজকতার জন্য, আমাদের দেশের লক্ষ লক্ষ স্বাধীনতা সংগ্রামীরা প্রাণ দিয়েছেন, বছরের পর বছর জেলে কাটিয়েছেন তাঁদের যৌবন কাল? আর সেদিন যারা ব্রিটিশদের তাঁবেদারি করেছিল, স্বাধীনতার লড়াইতে বিশ্বাসঘাতকতা করেছিল, তারা স্রেফ হিন্দুত্বের কথা বলে এই জঙ্গলের রাজত্ব চালিয়ে যাবে? এই ২৯ সেপ্টেম্বর চলুন হাথরস, নির্যাতিতার পরিবারের পাশে দাঁড়াতে, এই জঙ্গলরাজের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে, এক নিরপরাধ সাংবাদিকের মুক্তির দাবিতে হাথরস চলুন। কোথাও তো কাউকে দাঁড়িয়ে এই উন্মাদদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে হবে। সেই দায়িত্ব নেবার সময় এসেছে, এই ঔদ্ধত্যের জবাব দেবার সময় এসেছে।