২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে এটাই শেষ ২১ জুলাই। আগামী একুশে জুলাই দেশে বিজেপি সরকার যেন না থাকে, বিজেপি সরকারকে ২০২৪-এ হারাতে হবে, এটাই ছিল একুশে জনসভার একমাত্র সুর। একটা লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার মেসেজ, বিজেপি হটাও দেশ বাঁচাও, ইন্ডিয়া উইল উইন। যা যা বললেন এই দুই নেতা, তার প্রত্যেকটা কথাই জাতীয় রাজনীতির কথা, ২০২৪-এর নির্বাচনকে মাথায় রেখেই বলা। আগে, কতদিন আগে এমনটা হয়েছে জানি না, সম্ভবত কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল তৈরি হওয়ার পরে এই প্রথম ২১ জুলাই মমতা তাঁর পুরো বক্তৃতায়, অভিষেক তাঁর পুরো বক্তৃতায় একবারের জন্য কংগ্রেসের নামও নিলেন না, একবারও না। সমালোচনাও নয়, সমর্থনও নয়। ক’দিন আগেই জগাই মাধাই আর গদাইয়ের সঙ্গে সতত লড়াইয়ের অন্তত একজনের সঙ্গে একটা স্থায়ী নো ওয়ার প্যাক্টে, এক অনাক্রমণ চুক্তির দিকেই যাচ্ছে তৃণমূল কংগ্রেস, সেটা পরিষ্কার। সিপিএম নিয়ে ঝাঁঝ কম, খুব কম কয়েকটা কথা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অভিষেক সেটাও বললেন না। সারা বছরে অন্য দলের বড় বড় কনফারেন্স হয়, অধিবেশন, পার্টি কংগ্রেস ইত্যাদি। তৃণমূল কংগ্রেসের ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকেই দলের রাজনৈতিক দিশা, লক্ষ্য জানিয়ে দেওয়া হয়, জানিয়ে দেন নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এবার সেখানে সামান্য পরিবর্তন, দিশা দিলেন মমতা অভিষেক দুজনে মিলে। সেটাই আজ আমাদের বিষয় আজকে, ২১ জুলাই, কী বললেন অভিষেক, মমতা?
অন্যান্য বারে মমতা বন্দ্যোপধ্যায় কিছু উর্দু শায়রি বলেন, কিছু হিন্দি শব্দ ব্যবহার করেন, এবারে মঝে মধ্যেই হিন্দিতে বলছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, এটা ছিল ওই জাতীয় রাজনীতি মঞ্চের মহড়া। একবারও কংগ্রেসের নাম না নিয়ে তিনি সাফ বুঝিয়ে দিলেন বিরোধী জোটের জন্য তিনি কমিটেড, তিনি বার্তা দিলেন কংগ্রেসের হাই কমান্ডকে, আমরা হাত বাড়িয়ে দিলাম, বল এবার আপনাদের কোর্টে, এরপরেও যদি আপনাদের রাজ্য নেতৃত্বের সুর না বদল হয়, আমাকে দোষ দেবেন না। কিন্তু অন্যদিকে সিপিএম-এর বিরোধিতা তিনি ছাড়ছেন না, তিনি কেন রাজনৈতিক মহলের সবাই জানে এই মুহূর্তে সিপিএম তৃণমূল কোনও অপ্রত্যক্ষ বোঝাপড়াও সম্ভব নয়, কাজেই মমতা জোট ভাঙার দিকে নজর দিলেন, কংগ্রেসের সঙ্গে তাঁর স্বাভাবিক সম্পর্ক ঝালিয়ে নিতে পারলে মুসলমান ভোটের যেটুকু ক্ষয় হয়েছে তা আবার পুষিয়ে নেওয়া যাবে, এটাও মমতা জানেন। এবং এই ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে বিজেপি, নরেন্দ্র মোদিকেই পখির চোখের মতো টার্গেট করলেন মমতা, বুঝিয়ে দিলেন ২০২৪ এর লড়াইয়ে বাংলায় দিদি-মোদিরই লড়াই। ১০০ দিনের টাকা দেবেন না? আটকে দেবেন? অভিষেক জানালেন নয়া কর্মসূচি, দিল্লি চলো, ২ অক্টোবর। গান্ধীর জন্মদিন আর নেতাজির স্লোগানকে অত্যন্ত ভেবেচিন্তে মিলিয়ে দেওয়ার কাজটা করে রাখলেন, পেটের লড়াই ভাতের লড়াইয়ের কথা বললেন অভিষেক, দিল্লি টাকা দিচ্ছে না, তাই পায়ে ধরে না সেধে লড়াইয়ের রাস্তায় দিল্লি চলো, কিন্তু সে আন্দোলন সত্যাগ্রহ, তাই গান্ধীর জন্মদিনে। মানে কেন্দ্রে বঞ্চনার সেই পুরনো লড়াইকে এই ইস্যুতে ঝালিয়ে রাখলেন অভিষেক।
আরও পড়ুন: Aajke | আগে বালতি উলটে দেখা…
অন্যদিকে বঞ্চনার বিরুদ্ধে কেবল আন্দোলন? না, বিকল্প পথের কথা বললেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, বললেন টাকা জোগাড় হয়ে গেছে, প্রকল্পের নাম খেলা হবে, ১০০ দিন না হোক ৪০-৫০ দিনের কাজ দেব বাংলার মানুষকে, বাংলার মানুষকে ভুখা মরতে দেব না। একজন লড়াইয়ের কথা বললেন, অন্যজন সেই লড়াইয়ের সুফল যতদিন না আসে, ততদিনের জন্য বিকল্প আয়ের ব্যবস্থার কথা বললেন। বললেন প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা টাকা আসছে না তো কী? আমরা বাড়ি তৈরি করাব, আমরা টাকা দেব। বিজেপির ভাতে মারার পরিকল্পনার বিরুদ্ধে লড়াই হবে, আলবাত হবে কিন্তু তার সঙ্গে বিকল্প পথের কথাও জানিয়ে দিলেন, আশ্বস্ত করলেন বাংলার আমজনতাকে। দুঃখপ্রকাশ করলেন পঞ্চায়েত হিংসার জন্য, মৃত্যুর জন্য। জানালেন প্রতিটি মৃত পরিবারের একজনকে হোমগার্ডে চাকরি আর দু’ লক্ষ টাকা দেওয়া হবে। বিজেপি নেতাদের বুথ স্তরে বাড়ি ঘেরাওয়ের কর্মসূচির কথা বললেন অভিষেক, শুধরে দিলেন মমতা, বললেন বুথ নয় ব্লক, আর বাড়ির ১০০ মিটার দূরত্বে প্রতীকী ঘেরাও। সব মিলিয়ে এবারের ২১ জুলাই অন্যরকম সব অর্থে, অনেক বেশি জনসমর্থন নিয়ে এবার মমতার লক্ষ্য দিল্লি, সেটা পরিষ্কার। আমরা মানুষকে প্রশ্ন করেছিলাম, এবারে ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে মমতা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একটা কথাও বলেননি, বরং বার বার বিরোধী জোটের কথাই বলেছেন, তার মানে কি এ রাজ্যে তৃণমূল আর কংগ্রেস জোট হতে চলেছে? শুনুন মানুষ কী বলেছেন।
রাজ্যসভা, লোকসভা মিলিয়ে ৩৫ জন সাংসদ, বাংলার ২২০ জন এমএলএ, ৪৫০০০-এর বেশি পঞ্চায়েতে নির্বাচিত তিনস্তরের প্রতিনিধি, রাজ্যের অধিকাংশ মিউনিসিপ্যালিটি, কর্পোরেশনের প্রতিনিধি নিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধায়ের তৃণমূল এ রাজ্যে প্রশ্নাতীত দখলদারি বজায় রেখেছেন। এ রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট যদি নাও হয়, তাদের গলার সুর নামতে বাধ্য। আর আপাতত পঞ্চায়েত ভোটের বিপুল জয়, এবং বিরোধী বৈঠকে তাঁর জন্য কংগ্রেসের, অন্য দলগুলোর আলাদা গুরুত্ব দেওয়া, তৃণমূল নেত্রীর কনফিডেন্স লেভেলকে এক চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে, তিনি তাঁর তৃণমূল দলকে নিয়ে জাতীয় মাঠে খেলার জন্য তৈরি হচ্ছেন, ২১ জুলাই সেই বার্তাই দিয়ে গেল।